বিহারের রাজনীতিতে প্রশান্ত কিশোর! নির্বাচনের সমস্ত সমীকরণ তছনছ করে দেবেন?

Prashant Kishor in Bihar Politics: তিন বছর আগে তিনি জন সুরজ পার্টি গড়ে তুলে বিহার জুড়ে প্রচার শুরু করেছেন। তিনি বারবার বলেন, বিহারের মানুষকে জাতের বেড়া ভেঙে নিজেদের জন্য নতুন দিশা তৈরি করতে হবে।

প্রশান্ত কিশোর-কে ভোটকুশলী হিসেবে চেনে ভারতীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডল, তবে এবার তিনি নিজেই ভোটযুদ্ধে নেমেছেন। ৪৮ বছর বয়সি এই নেতা প্রথম ভোট ময়দানে এসেছিলেন গুজরাটে নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্ব নেওয়ার মাধ্যমে। এর পর থেকেই তিনি একাধিক রাজ্যের নির্বাচনে ভোটকুশলী হিসেবে কাজ করেছেন। শুধু বিজেপি নয়, কংগ্রেস, জেডিইউ, তৃণমূল কংগ্রেস এবং তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) প্রায় সব প্রধান দলকেই তিনি জয়ের পথ দেখিয়েছেন।

প্রশান্ত কিশোর প্রথমে জেডিইউতে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু নীতীশ কুমারের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে তিনি নিজেই নতুন রাজনৈতিক দল জন সুরজ পার্টি গড়ে তোলেন।  যদিও সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন, নিজে প্রার্থী হবেন না, শুধু দলের প্রার্থীদের প্রচারে সাহায্য করবেন। এক বছর ধরে বিহারের প্রতিটি জায়গা চষে বেড়াচ্ছেন, প্রচার করছেন দলের।

বিহারের রাজনীতিতে প্রশান্ত কিশোরের আগমন নতুন উত্তেজনা তৈরি করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, তিনি নতুন ভোটারদের আকৃষ্ট করছেন। এতে বিজেপির মূল সমর্থনে সরাসরি প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা আছে। পিকে কখনও জাতপাতকে গুরুত্ব দেননি। তিনি চাইছেন নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে এবং মানুষকে সচেতন করতে। বারবার তিনি বলেছেন, বিহারের মানুষকে বুঝতে হবে কীভাবে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। রাজনীতির পুরনো নিয়ম ও জাতভিত্তিক ফাঁদ ভেঙে নিজেদের জন্য নতুন পথ তৈরি করতে হবে। তিন বছরের প্রচারে তিনি যুবসমাজের মধ্যে ইতোমধ্যেই সাড়া ফেলেছেন। পিকে-র দাবি, তাঁর লক্ষ্য শুধু ভোট জেতা নয়, বরং মানুষকে বুঝতে সাহায্য করা এবং রাজনীতিতে নতুন দিশা দেখানো। তাই এবারের ভোট কেবল আসন ভাগের জন্য নয়, বরং রাজনীতিতে নতুন ধারা কেমন কাজ করে তা দেখারও সুযোগ।

আরও পড়ুন

রাহুলের যাত্রায় বিহারে কংগ্রেসের ভোটভাগ্য ফিরবে?

ভোটকুশলী হিসেবে তাঁর পরিচিতি নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোট ছিল তাঁর হাতেখড়ি। মোদির দিল্লি জয়, ২০১৫ সালে পাঞ্জাবে কংগ্রেস নেতা অমরিন্দর সিংয়ের জয়, ২০১৯ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে জগনমোহন রেড্ডি, ২০২০ সালে দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও এম কে স্ট্যালিনের জয়, সব জয়ই তাঁর কৌশলে পাওয়া। ব্যর্থ হয়েছেন মাত্র একবার, ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটে।

এবার পিকে শুধু ভোটকুশলী নয়, নিজেই রাজনীতির অংশ হয়ে বিহারের নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চাইছেন। তিন বছর আগে তিনি জন সুরজ পার্টি গড়ে তুলে বিহার জুড়ে প্রচার শুরু করেছেন। তিনি বারবার বলেন, বিহারের মানুষকে জাতের বেড়া ভেঙে নিজেদের জন্য নতুন দিশা তৈরি করতে হবে। যদি জাতভিত্তিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা ভেঙে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি না আসে, মানুষ একইভাবে অন্যের হাতের পুতুল হয়ে থাকবে বলে দাবি পিকের।

প্রশান্ত কিশোরের প্রচারণায় অংশ নেওয়া জনতার প্রায় ৮০ শতাংশ তরুণ। তাঁরা রাজনীতিতে পরিবর্তন চাইছে কি না, তা আগামী নির্বাচনের ফলাফলে বোঝা যাবে। অন্যদিকে, মিডিয়ারও আকর্ষণ পিকে-র ব্যক্তিত্ব। নির্বাচন নিয়ে তাঁর মতো বিস্তারিত সাক্ষাৎকার আর কেউ দিচ্ছেন না।  ভোটের পর তিনি কোনো জোটের দিকে ঢলবেন না, এ কথাও তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন।

পিকে-র সদিচ্ছা ও সমালোচনার ভাষা এমন যে সাধারণ মানুষও তা শুনছে। মোদি, নীতীশ কুমার, লালু-পুত্র তেজস্বী ও রাহুলের রাজনীতি নিয়ে তিনি খোলাখুলি সমালোচনা করছেন। মোদি প্রসঙ্গে বলেছেন, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যগুলোতে মোদি শিল্পকারখানা স্থাপন করছেন, কিন্তু বিহারে তা করছেন না। ফলে, বিহারের যুবকরা অন্য রাজ্যে সস্তা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। পিকে বলেন, মোদি বিহারে শিল্পকারখানা স্থাপন করছেন না কারণ, বিহারে শিল্পকারখানা হলে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ুতে সস্তা শ্রমিক পাওয়া যাবে না। পিকে মনে করিয়ে দিয়েছেন— প্রধানমন্ত্রী গুজরাটে বুলেট ট্রেন চালানোর কথা বলেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরির কথা বলেন, অথচ বিহারে বলেন আরও বেশি খাদ্য দেওয়া হবে, আরও বন্দে ভারত ট্রেন চালানো হবে। এর ফলে আরও বেশি শ্রমিক অন্য রাজ্যে চলে যাবেন বলে তাঁর দাবি। পিকে জোর দিয়ে বলেন, বিহারের যুবসমাজকে আর সস্তা শ্রমিক হিসেবে কাজ করানো চলবে না।

জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমারের রাজনীতি প্রসঙ্গে বলেন, নীতীশের রাজনীতি শেষ, এবার ২০টি আসনও জেডিইউ জিততে পারবে না। কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে বলেন, তাদের নিজস্ব কিছু নেই, তারা লালু প্রসাদের অনুসারী। তেজস্বী লালু বাবার ‘জঙ্গলরাজে’ আবদ্ধ। পিকের কথায়, তেজস্বী ও রাহুল দুজনই শুধু পুরনো রাজনৈতিক প্রথার মধ্যে আটকে পড়েছেন।

আরও পড়ুন

কেন নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান না প্রশান্ত কিশোর?

উল্লেখ্য, শাসক দল এনডিএ রাজ্যবাসীর জন্য এককালীন ১০ হাজার টাকা, শিক্ষিত বেকারদের জন্য ২ হাজার টাকা মাসিক ভাতা এবং প্রতিটি পরিবারের জন্য সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। অন্যদিকে পি কের প্রতিশ্রুতি মূলত মানুষের ‘পলায়ন’ কমানো। অর্থাৎ ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমানো। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, বিহারের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭.২% (প্রায় ৭৪.৫৪ লাখ) মানুষ অন্য রাজ্যে বসবাস করেন, যাদের মধ্যে ২২.৬৫ লাখ বা ৩০% মানুষ কর্মসংস্থানের কারণে অন্য রাজ্যে গিয়েছেন। তবে এত দিন পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে ধারণা করা হয়। তাঁদের অন্য রাজ্যে কাজের খোঁজে যাওয়া পি কের কাছে ‘পলায়ন’। তিনি বলছেন, “হয় দেড়শ আসন পাব, নয়তো দশেরও কম। ফল যা-ই হোক, থেমে যাব না।”

পাশাপাশি এ কথাও মনে রাখা দরকার জন সুরজ পার্টির আয় ব্যয়ের হিসেব জনসমক্ষে নেই। যদিও ভোটকুশলী একটি পডকাস্টে  এসে বলেছেন, যেহেতু প্রত্যেক বছর সরকারের কোষাগারে কর জমা দেওয়া হয়, তার মানে আসলে জন পরিসরে তার স্বচ্ছ হিসেব রয়েছে।

এবারের বিহার বিধানসভা নির্বাচন শুধু রাজ্য নয়, জাতীয় রাজনীতিকেও প্রভাবিত করবে। ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নীতীশ কুমারের ভবিষ্যত, বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদ এবং ইন্ডিয়া জোটের ক্ষমতা— এই সবই নির্ভর করছে এই ভোটের ফলাফলের উপর। প্রশান্ত কিশোর তরুণ ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণ করছেন, নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রচার করছেন এবং পুরনো রাজনৈতিক প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করছেন ঠিকই। তবে ভোটের প্রাক্কালে পিকের ক্ষমতা নিয়ে দুটি প্রশ্ন সামনে উঠে আসছে। প্রথম, তিনি কি জনসমর্থনকে ভোটে রূপান্তর করতে পারবেন? দ্বিতীয়, তিনি কীভাবে প্রতিষ্ঠিত দলের প্রভাব মোকাবিলা করবেন?

More Articles