ফের ফরাসি বিপ্লব? কেন পালাবদল চাইছে ফ্রান্স?
Bloquons tout: ফরাসি জাতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একসঙ্গে জোট বাঁধতে সক্ষম। বিক্ষোভ, মিছিল, আন্দোলন ফ্রান্সে এক প্রকার ‘জাতীয় খেলা’। বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে আসেন। এটি ফরাসি পরিচয়েরই অঙ্গ।
প্রতি বছর, সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে লা রঁত্রে (la rentrée)-র সময় একই ঘণ্টা বাজে। লা রঁত্রে হলো বছরের সেই মুহূর্ত, যখন গ্রীষ্মের ছুটি শেষে গোটা দেশ আবার ছন্দে ফেরে। অগাস্ট মাসকে ফ্রান্সে প্রায় সর্বজনীন ছুটির মাস হিসেবে ধরা হয়— বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ থাকে। তারপর ধীরে ধীরে ফ্রান্স স্বাভাবিক কার্যকলাপে ফিরে আসে। বাচ্চারা স্কুলে ফেরে, কর্মীরা কাজে ফেরে, দোকানপাট তাদের নিয়মিত সময়সূচিতে খোলে, এমনকি সরকারও স্বল্প বিশ্রামের পর ফের সক্রিয় হয়। গণমাধ্যমও নতুন অনুষ্ঠান নিয়ে হাজির হয়। এসময় লা রঁত্রে লিতেরেয়ার (rentrée littéraire) বা সাহিত্যের পুনরাগমন হয়, যা বইয়ের জগতে বছরের সবচেয়ে বড় ইভেন্ট (২০২৫ সালেই ৪৮৪টি বই প্রকাশিত হয়¹)। আর ফ্রান্সের বাকি অংশের মতোই শ্রমিক সংগঠনগুলিও আবার রাস্তায় নেমে আসে। সাধারণত শিক্ষক, রেলকর্মী, নার্সেরা প্রথমে রাস্তায় নামে, শ্লোগান দেয়, রাস্তা অবরোধ করে তাদের দাবি-দাওয়া শোনানোর জন্য।

ফ্রান্সে ম্যাক্রোঁর পদত্যাগের দাবিতে হাজার হাজার মানুষ (ছবিসূত্র - এক্স হ্যান্ডেল)
কিন্তু এ বছর শ্রমিক সংগঠনগুলোর হাওয়া কেড়ে নিল সোশ্যাল মিডিয়া। ২০২২ থেকে ফরাসি রাজনীতির অস্থিরতার জেরে সোশ্যাল মিডিয়ায় আহ্বান জানানো হয়েছিল: Bloquons tout!² (সবকিছু বন্ধ করো!)। সংগঠনগুলোর বাইরে গিয়ে এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে লাখ লাখ মানুষ যুক্ত হন³। পুলিশের হিসাবমতো প্রায় ২ লক্ষ, আর সংগঠনগুলোর হিসেবে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ অংশ নেন। এটাই স্পষ্ট ভাবে দেখিয়ে দিল যে ফরাসি জনগণ কতটা ক্ষুব্ধ এবং অবহেলিত বোধ করছে।
আরও পড়ুন- ২ বছরে ৫ বার প্রধানমন্ত্রী বদল, কেন ক্ষোভে ফুঁসছে ফ্রান্স?
“আমরা ষোড়শ লুইয়ের সময় করেছি, আবারও করতে পারি!”
সব বিক্ষোভের কেন্দ্রে রয়েছেন ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। নিজের মতে চলার জন্য তিনি ‘জুপিটার’⁴ নামে পরিচিত। মাত্র তিন বছরে পাঁচজন প্রধানমন্ত্রী বদলেছেন। প্রায় এক বছর আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর বামপন্থীরা অল্প ব্যবধানে এগিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারপরও ম্যাক্রোঁ এমন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করলেন, যেখানে জনগণের রায় প্রতিফলিত হয়নি। এই বঞ্চনাই জনগণের ক্ষোভ বাড়িয়েছে। তার ওপরে এসেছে একের পর এক সংস্কার— অবসরের বয়স বাড়ানো (সর্বোচ্চ শর্তে ৬২ বছর), দু’টি সরকারি ছুটি বাতিল, জ্বালানির ওপর ভ্যাট ৫.৫% থেকে ২০%-এ বাড়ানো⁵, বেকার ভাতা থেকে বছরে পাঁচদিন কেটে দেওয়া⁶, আর গরিবদের তুলনায় ধনীদের অনুপাতে কম কর দেওয়ার ফলেই ১০ সেপ্টেম্বর বুধবারের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মূল স্লোগান হয়ে ওঠে— “ম্যাক্রোঁ পদত্যাগ করো!”

ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ
“সর্বত্র পুলিশ, কোথাও ন্যায়বিচার নেই”
এই আন্দোলনের জন্য প্রায় ৮০ হাজার⁷ পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সেই তুলনায় ১৪ জুলাই, ফরাসি জাতীয় দিবসে গোটা দেশে মোতায়েন করা হয়েছিল ৬৫ হাজার ইউনিট। উভয় ক্ষেত্রেই মূলমন্ত্র ছিল আঁটোসাঁটো ব্যবস্থাপনা রাখা। যদিও আয়োজকদের পক্ষ থেকে কোথাও হিংসার পরিকল্পনা ছিল না। অধিকাংশ বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ এবং সুসংগঠিত ছিল। মাত্র ৬০০ জনেরও কম বিক্ষোভকারীকে⁸ হিংসাত্মক আচরণের জন্য গ্রেফতার করা হয়েছিল— মিছিলে অংশগ্রহণকারী প্রায় ২ লক্ষ মানুষের মধ্যে যা মাত্র ০.৩%। অর্থাৎ গণমাধ্যমের প্রচারিত “ভয়াবহ ব্যারিকেড”-এর সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক বিপুল। তবে ২০১৮-২০১৯ সালের ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলনের সময় যেমন পুলিশের নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল⁹, এবারও বহু ভিডিওতে দেখা গেছে পুলিশ মারধর করছে। এমন দিনকাল এল যে ইরানও মন্তব্য করেছে, “ফরাসি সরকার ও পুলিশ যেন জনগণের শান্তিপূর্ণ, নিরস্ত্র প্রতিবাদের সময় আইন মেনে চলে এবং বলপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকে।”¹⁰ কী বিদ্রূপ!

ফ্রান্সে বিক্ষোভ (ছবিসূত্র - এক্স হ্যান্ডেল)
আরও পড়ুন- ফ্রান্সে সবচেয়ে কঠিন কর্মচারীদের সামলানো : কথাবার্তায় ফরাসি শ্রমিক ইব্রাহ
“একটাই সমাধান: বিপ্লব”
ফরাসি পঞ্চম প্রজাতন্ত্র যেন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। সমাজ আর একক নেতার শাসন মেনে নিতে রাজি নয়। সংসদ ভীষণ অস্থির, প্রায়শই সরকারকে অনাস্থা প্রস্তাবে ফেলছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও দুই দশকের বেশি সময় ধরে একই ধারা— চরম ডানপন্থীরা দ্বিতীয় দফায় উঠে আসে, আর জনগণ মন্দের ভালোকে বেছে নেয় ভয়াবহকে ঠেকাতে। আশার আলো আছে, তবে তা শাসকদের ভেতর থেকে নয়। নাগরিক উদ্যোগে গণভোট (référendum d’initiative citoyenne) বা ষষ্ঠ প্রজাতন্ত্র গঠনের মতো নতুন ধারণা উঠছে আন্দোলন ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর আলোচনায়। মানুষ পরিবর্তন চায় শান্তিপূর্ণভাবে। এর প্রমাণ হচ্ছে, যতক্ষণ না হিংসা শুরু হয়, আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন অটুট থাকে।¹¹

ফ্রান্সে বিক্ষোভ (ছবিসূত্র - এক্স হ্যান্ডেল)
১০ সেপ্টেম্বর লা রঁত্রে-র ইতিহাসে একটি বড় মাইলফলক। প্রথমত এই আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত, সংগঠিত আন্দোলন নয় (যদিও কিছু সংগঠন পরে যুক্ত হয়েছিল)। দ্বিতীয়ত, সবাই মেনে নেয় এটি একাধিক আন্দোলনের সূচনা, যা হয়তো পরিবর্তন আনতে পারবে। আর শেষ কথা হলো, এটি প্রমাণ করল যে ফরাসি জাতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একসঙ্গে জোট বাঁধতে সক্ষম। বিক্ষোভ, মিছিল, আন্দোলন ফ্রান্সে এক প্রকার ‘জাতীয় খেলা’। বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে আসেন। এটি ফরাসি পরিচয়েরই অঙ্গ।
আরও পড়ুন- ধৈর্যই এ শহরে আমার পরম বন্ধু | ফরাসি বন্ধুদের চোখে কলকাতা
প্রেসিডেন্ট সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত, তাই জনগণের দাবির প্রতি সাড়া দেওয়া তাঁর দায়িত্ব। জনগণ তাঁকে পদত্যাগ করতে বলতে পারে, সরকারকেও বাধ্য করতে পারে। ফ্রান্সের শ্রমজীবীরা এই আন্দোলনগুলো থেকেই ৫ সপ্তাহের বেতনসহ ছুটি অর্জন করেছে, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা, সমলিঙ্গের বিয়ের অধিকার— আরও বহু অধিকার, যা ফ্রান্সকে বসবাসযোগ্য করেছে।
ফ্রান্সে আন্দোলন একধরনের সামাজিক অভিজ্ঞতা। প্রতিবাদে গেলে দেখা যায় অপরিচিতদের সঙ্গে হঠাৎই রাজনীতি নিয়ে আলাপ জমে যায়, সমস্যার কথা হয়— সমাধানের চেয়ে সমস্যা নিয়েই বেশি আলোচনা হয় যদিও। কিন্তু বোঝা যায়, আপনি কোনো বৃহৎ কিছুর অংশ। পাশে হাঁটতে থাকা অচেনা মানুষটি হঠাৎই সহযোদ্ধা হয়ে ওঠে। সে-ও পরিবর্তন, ন্যায়, আর সমতার স্বপ্ন দেখে। বিশ্বের আর কোথায় অচেনা মানুষের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাজনীতি নিয়ে আলাপ করা যায়? কলকাতার চায়ের দোকানে।
তর্জমা - সঙ্গীতা ঘোড়ই
সূত্রনির্দেশ
(এক) ফ্রেঞ্চইনফো.এফআর
(দুই) ব্লক এভ্রিথিং
(তিন) ৩রা সেপ্টেম্বর ইউনিয়নগুলি ১৮ই সেপ্টেম্বর ধর্মঘটে সম্মত হয়েছে।
(পাঁচ) সারভিস-পাবলিকডটএফআর
(ছয়) বেকার ভাতা এখন ৩০ দিনের ক্যালেন্ডার মাসের ভিত্তিতে গণনা করা হয়। ১২ x ৩০ = ৩৬০ দিন। ভাতার দৈনিক গড় পরিমাণ ৪৫০/দিন যা প্রতি বছর ২২৫০ হ্রাস করে।
(সাত) ফ্রেঞ্চইনফো.এফআর ব্লকস টট মুভমেন্ট
(আট) লেপারিসিয়েনডটএফআর
(নয়) ফ্রেঞ্চইনফো.এফআর
(দশ) এফআরডটইরনাডটআইআর
(এগারো) এফআরডটস্ট্যটিস্টাডটকম
Whatsapp
