ফ্রান্সে সবচেয়ে কঠিন কর্মচারীদের সামলানো : কথাবার্তায় ফরাসি শ্রমিক ইব্রাহ

May Day in France: ফ্রান্সে শ্রমিকদের জীবন কেমন, শ্রমিকদের অধিকারই বা কতখানি? ন্যূনতম মজুরিতে চলে সংসার? ফরাসি শ্রমিকের সঙ্গে কথাবার্তায় শ্রীজাতা

শ্রীজাতা: এই সাক্ষাৎকারের প্রস্তাবে রাজি হওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ ইব্রাহ।

ইব্রাহ: আরে ধন্যবাদ কীসের, আমারও ভালো লাগছে!

শ্রীজাতা: শুরু করব তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড থেকেই — তোমার শিকড় কোথায়, জীবন আগে কেমন ছিল, এখন কেমন চলছে?

ইব্রাহ: আমি লেবাননের মানুষ। লেবাননেই আমার জন্ম আর বড় হওয়া। জীবনের একটা সময় উত্তরের ট্রিপোলিতে, সাগরের ধারে কাটিয়েছি, আর বাকি অংশ কাটিয়েছি বেইরুটে, পড়াশোনার জন্য। আমি বায়োলজিস্ট। প্রাণী জীববিদ্যায় মাস্টার্স করার সময়ে আমি বেইরুটে থাকতাম। ২০০৮ সালে আমি ফ্রান্সে স্নাতকোত্তর করতে আসি। যেহেতু আমি সবসময়ই লেবানন ছাড়তে চেয়েছিলাম, এই    সুযোগটা পেয়েই— ভিসা ইত্যাদি নিয়ে কিছু লড়াইয়ের পর — ফ্রান্সে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আমি তখন থেকে, মানে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এখানে আছি। ফ্রান্স আর ইতালি মিলিয়ে আমি প্রাগৈতিহাসিক পড়াশোনা, মানুষের বিবর্তন, সংস্কৃতি আর পরিবেশ নিয়ে পড়াশোনা শেষ করি। তারপর আমি সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আরেকটি স্নাতকোত্তর করি। অবশেষে ২০১৫ সালের শেষে, একদম কাকতালীয়ভাবে আমি মার্সেইতে চলে আসি। আর তখন থেকে এখানেই আছি।

শ্রীজাতা: আশ্চর্য, আমাদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে এতটা মিল! আচ্ছা, তোমার ফ্রান্সের ছাত্রজীবন নিয়ে একটু বলো। আমি জানি, এখানে শুধু পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়ে চলে না। তুমি কি কাজ করতে ছাত্রাবস্থায় ? কাজ করতে বাধ্য  হয়েছিলে?

ইব্রাহ: হ্যাঁ, কাজ করতে হয়েছিল কারণ ফ্রান্স বেশ খরচসাপেক্ষ দেশ—বিশেষ করে আমার মতো যদি কেউ লেবানন থেকে আসে। আমার বাবা-মা সবসময় সাহায্য করতে পারত না। আমি ফ্রান্স বেছে নিয়েছিলাম মূলত এই কারণেই— এখানে আমি কাজ করতে পারতাম, আর টিউশন ফি খুব কম। পুরোপুরি 'ফ্রি' বলব না, কারণ বছরের শুরুতে টিউশন ফিজ দিতে হয়, কিন্তু মোটামুটি ভাবে ফ্রি—অন্তত একজন লেবানিজের কাছে। আমি ফ্রান্সে আসার তিন মাস পর থেকেই কাজ শুরু করি, প্যারিসের একটা লেবানিজ রেস্তোরাঁয়। আমি সার্ভার হিসেবে কাজ করতাম। তারপর বারম্যান হিসেবেও কাজ করেছি। কাজে অনেকটা সময় চলে যেত কারণ সম্পূর্ণ সময় কাজ না করলে বাড়িভাড়া, জীবনযাত্রা— এসব সামলানো সম্ভব হতো না।

স্কুল জীবনের গল্প খুব ইন্টারেস্টিং। আমি অসাধারণ একটা ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলাম— Muséum National d’Histoire Naturelle— প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো। ফ্রান্সে ওই ধরনের শিক্ষাব্যাবস্থায় অ্যাক্সেস পাওয়া এক দারুণ অভিজ্ঞতা। আমি ভাগ্যবান কারণ আমার কলিগরা সবাই বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছিল। এটা একটা Erasmus Mundus প্রোগ্রাম ছিল, তাই শুধু 'ফ্রেঞ্চ ফ্রেঞ্চি'-দের সঙ্গে নয়— সব দেশের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ ছিল।

ছাত্রজীবনটা মোটামুটি ভালোই ছিল। তখন আমি প্যারিসে থাকতাম। আমাদের তখন কম বয়স, তাই অনেক কিছুই আমাদের জন্য ফ্রি ছিল— যেমন মিউজিয়াম ইত্যাদি। কিন্তু প্যারিস খুব নিষ্ঠুর এক শহর। বিশাল একটা শহর। একটা মিউজিয়াম সিটি। বেশ    ইম্পার্সোনাল, ঠান্ডা, ধূসর, রোদ নেই। খুব হেকটিক, খুব দ্রুত ছুটছে— তোমায় একদম গিলে ফেলতে পারে, আর তারপর মেট্রোর একদম শেষ স্টপে গিয়ে তোমায় উগরে ফেলে দেয়— আবার শুরু করো নতুন করে। আমি প্যারিসে থেকেছি, এই ধারণাটা ভালোবাসি, কিন্তু প্যারিসে থাকা তেমন এক্সাইটিং ছিল না শেষ অবধি। বেশ কঠিন ছিল।

আরও পড়ুন- অন্তরঙ্গতাই উপার্জন, অন্তরঙ্গতাই ভয়: শহরের মহিলা সেবাশ্রমিকদের রোজনামচা

শ্রীজাতা: আর ছাত্র অবস্থায় রেস্তোরাঁয় কাজ করার ব্যাপারটা? কারণ আমি জানি না লেবাননে কেমন, কিন্তু ভারতে এই ধারণাটাই নেই- পড়াশোনার সময় কাজ করা। একটু নিচু চোখেই দেখা হয়।
তোমার ক্ষেত্রে কেমন ছিল? তোমার কাজ নিয়ে ধারণা বদলেছিল ফ্রান্সে এসে? আর রেস্তোরাঁয় কাজ করার সময় তোমার সঙ্গে কেমন ব্যবহার হতো?

ইব্রাহ: আমি সবসময়ই পড়াশোনার সঙ্গে কাজ করেছি, এমনকী লেবাননেও। ১৮ বছর বয়স থেকে কাজ করছি। বাড়ি ছাড়ার পর থেকে আমি নিজের বাড়িভাড়া, নিজের খরচ নিজেই চালাতাম। এটা আসলে একটা গর্বের ব্যাপার— নিচু কিছু নয়। লোকে বলত, “তুমি একসঙ্গে পড়াশোনা আর কাজ দুটোই করছো!” মানে, তুমি নিজের খরচ চালাচ্ছ, টিউশন দিচ্ছ, আর তার ওপর ভালো রেজাল্টও করছ, দারুণ কিছু না হলেও ঠিকঠাক। এটা বাবা-মা খুব গর্ব করে বলত। পুরো সম্প্রদায়ই অনেক সমর্থন করত। সবাই বলত, “হ্যাঁ, এমনটা তো করতেই হবে এক সময়।”

অনেক দেশের মতো লেবাননেও একদিকে ধনী মানুষ আছে, মধ্যবিত্ত আছে, আবার গরিব মানুষও আছে। আমাদের অবস্থান ছিল মাঝামাঝি কোথাও। আসলে আমি কাজ করতে চাইতাম কারণ আমি স্বাধীনতা চাইতাম। কাজ মানে স্বাধীনতা। আমি নিজে গোড়া থেকে শুরু করতে চেয়েছিলাম, কারণ আমার পরিবার খুব স্বচ্ছল ছিল না। আমি ভাবতাম, “ঠিক আছে, আমি নিজেই করব। কোনও ব্যাপার না।”

আর ফ্রান্সে কাজের অভিজ্ঞতা— ওটা ধাপে ধাপে এসেছে। আমি ফ্রান্সে ১৭ বছর ধরে কাজ করছি— আমার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে, ছাত্র থাকাকালীন বা পরে, আমি অনেক পরিবর্তন দেখেছি। তুমি যে নীতির কথা বলছো, সেটা সময়ের সঙ্গে বদলেছে।

আমি লেবানিজ লোকেদের সঙ্গেই কাজ করতাম। ডায়াস্পোরা যেরকম হয়, আমরা একসঙ্গে থাকতে পছন্দ করি। এটা একদিকে ভালো, আবার অন্যদিকে খারাপও। সবটা এখন বলব না কিন্তু লেবানিজ রেস্তোরাঁয় কাজটা পেয়ে আমি খুশিই ছিলাম। কঠিন ছিল—আমার লেবানিজ সহকর্মীরা অনেকেই আমার বাবা-মায়ের বয়সি ছিল— আর তারা সেই পুরনো লেবানিজ মানসিকতা নিয়েই ফ্রান্সে চলত। অনেকটাই পুরনো ধ্যানধারণা, অনেকটাই রক্ষণশীল। কেউ কেউ মনে করত, তারা যেন সেই যুদ্ধের মধ্যেই আটকে আছে—একটা যুদ্ধ, যেটা আসলে পুরোপুরি কখনও থামেনি। হ্যাঁ, পেছনে তাকালে সেই জীবনটা কঠিন মনে হয়।

শ্রীজাতা: আর ফ্রান্সে ন্যূনতম মজুরির অবস্থা কেমন? কারণ আমি যখন আমেরিকায় ছিলাম, তখন ওইটুকু টাকায় চলা যেত না। তাই রেস্তোরাঁয় আমরা টিপস দিতাম। কিন্তু ফ্রান্সে এসে ব্যাপারটা পুরো পালটে গেল— এখানে শ্রমিকরা ঠিকঠাক বেতন পায়। তোমার মত কী? শ্রমিকদের কী কী অধিকার আছে? দিনমজুরিতে কাজ করা শ্রমিকরাও কি জীবনবীমা, মেডিক্লেম এসব পান? নিরাপদ জীবন?

ইব্রাহ: দেখ, যদি হিসেব করে চলতে জানো, তাহলে ফ্রান্সে ন্যূনতম মজুরি দিয়েও চলে যায়। মানে মুদ্রাস্ফীতি, যুদ্ধ, এইসব না থাকলে—চলে যায়। প্যারিস একটু দামি, বুঝলে! ওখানে বাড়িগুলো খুব ছোট তাই নিজের মতো একটু সময় কাটিয়ে শ্বাস নিতে গেলে বাইরে বেরোতেই হয়।

শ্রীজাতা: বুঝতে পারছি।

ইব্রাহ: ২০২৫-এর হিসেবে, ফ্রান্সে ন্যূনতম মজুরি খুব খারাপ না। তবে খুব ভালোও না।

শ্রীজাতা: কত এখন?

ইব্রাহ: ১৫০০ ইউরো হাতে। আর গ্রস ১৯০০-এর মতো। খুব বেশি তো না কিন্তু একা মানুষ হলে, আর যদি দায়িত্ব কম থাকে, তাহলে টাকাটা ম্যানেজ করা যায়। কিন্তু যাদের বাচ্চা আছে, সঙ্গী আছে, বড় সংসার আছে, অসুস্থ মা-বাবা আছে, বিশেষ করে আমাদের মতো    ডায়াস্পোরাদের, দেশে দেখাশনা করতে হতে পারে — তাহলে তো ১৫০০ কিছুই না। আসলে সমস্যা হচ্ছে, টাকাটা একজনের জন্য হিসেব করা কিন্তু আমাদের জীবন তো এক জনের না। আমরা তো অনেকজন— আলাদা আলাদাভাবে হলেও। সেখানেই গোলমাল।

শ্রীজাতা: আর কাজ খোঁজার ব্যাপারটা কেমন ছিল? তুমি তো বাইরে থেকে এসেছিলে, লেবানিজ রেস্তোরাঁয় কাজ করেছিলে। সেটা কেন? মানিয়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছিল?

ইব্রাহ: না না, ভাষার কারণে কিছু হয়নি। আমি তো সব সময় ফরাসি ভাষায় কথা বলেছি। লেবাননে স্কুল-কলেজ সব ফরাসিতেই পড়েছি। ভাষা বাধা ছিল না। বেশিরভাগ লেবানিজ ডায়াস্পোরার লোকজন ওই কাজটাই করে। কিছু কিছু শোষণ ছিল— তা আমি পরে বলব— কিন্তু তখন ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। আক্ষেপ করি না, বরং দারুণ  অভিজ্ঞতা ছিল কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমি তখন ফরাসি নিয়মটা ভালোভাবে বুঝতাম না। সেটা একটু জটিল ছিল।
আর আমাকে সম্পূর্ণ সময় কাজ করতেই হতো কিন্তু ফ্রান্সে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে সম্পূর্ণ সময় কাজ করা আইনত ঠিক না। তখন লেবানিজ রেস্তোরাঁগুলো আমাকে নিয়েছিল সম্পূর্ণ সময়ের চুক্তি ছাড়াই, নগদে টাকা দিত। একটা পা আইনি, একটা পা বেআইনি— এইভাবে চলতাম। তাই আমি ওই ডায়াস্পোরার সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। জানলে অবশ্য আমি আলাদাভাবে চেষ্টা করতাম। গ্রীষ্মে ছয় মাস সম্পূর্ণ সময় কাজ করতাম, পরে পড়াশোনার জন্য সময় রাখতাম, কিছু টাকা বাঁচিয়ে। তাহলে হয়তো ভালো হতো। তবে এখন তো আর গল্পটা নতুন করে লিখতে চাই না। তবে কেউ যদি এখন জানতে চায়, আমি বলব— যখন কাজ পাওয়া যায়, তখন কাজ করো, পাঁচ-ছয় মাসের জন্য, টাকা জমাও, তারপর আবার পড়াশোনায় মন দাও। এইভাবে ভারসাম্য রাখাই ভালো।

শ্রীজাতা: মানে তোমার অভিজ্ঞতা দিয়ে তুমি অন্যদের সাহায্য করছ। আক্ষেপ নেই।

ইব্রাহ: হ্যাঁ, ঠিক তাই।

শ্রীজাতা: তাহলে ওই যে শোষণ বলছিলে, সেটা কী ধরনের? যদি খুব অসুবিধা না হয় বলো একটু?

ইব্রাহ: না না, বলতেই পারি। অবশ্যই বলব। ওরা আমাদের ব্যবহার করত। নিয়মটাই এমন— যার প্রয়োজন আছে, সিস্টেম তাদেরই শোষণ করে। আমি তখন চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে কাজ করতাম— টানা শিফটে কাজ করতাম। সপ্তাহে ৯০ ঘণ্টা— ৪৫ ঘণ্টা ক্লাস, ৪৫ ঘণ্টা কাজ। ওই এত ক্লান্তি মেনে নেওয়াটাও একটা সমস্যা। আরেকটা বড় সমস্যা ছিল, কাজ করার অধিকার না থাকা।
তাই চালিয়ে নিতে গেলে আমাকে সবসময় বিকল্প উপায় ভাবতে হতো।
পয়সা ছিল না। ফ্রান্সে থাকা মানেই একটু 'ডান্স' করতে হয় ওই সিস্টেমের সঙ্গে। একধরনের ওয়াল্টজ— কীভাবে ওই অবস্থায় থেকে টিকে থাকা যায়।

আর যাদের সঙ্গে কাজ করতাম, রেস্তোরাঁর অন্য সহকর্মীরাও খুব একটা ভালো ব্যবহার করত না। আদেশ দিত, বকাবকি করত, ক্রেতার সামনে অপমান করত। শারীরিক হিংসা ছিল বলব না কিন্তু তার চেয়ে খুব একটা খারাপও ছিল না। আর ক্রেতারাও সবসময় ভালো না। পরিষেবার জগতে থাকলে এটা মেনে নিতেই হয়। সব ক্লায়েন্ট তো 'কুল' হয় না। সবচেয়ে কষ্টের ছিল, ওই যে ভয়! একটা চাকরি হারানোর ভয়, বাড়িভাড়া না দিতে পারার ভয়, খেতে না পাওয়ার ভয়— এইসবের জন্যই আমরা সব শর্ত মেনে নিতাম। রবিবার সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ? কোনও সমস্যা না, করে দিতাম।
এইটা বেঁচে থাকার লড়াই ছিল, সোজা কথায়।

শ্রীজাতা: ভয়ানক। কিন্তু জানা কথা, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটাই বাস্তব।

ইব্রাহ: হ্যাঁ, দুর্ভাগ্যজনকভাবেই।

শ্রীজাতা: কিন্তু এখন তো তুমি অন্যরকম একটা জগৎ তৈরি করার চেষ্টা করছ। তুমি এখনও পরিষেবার জগতেই আছো কিন্তু তোমার    ভূমিকা বদলে গেছে, তাই তো?

ইব্রাহ: হ্যাঁ। পড়াশোনা শেষ করার পর মার্সেইয়ের মিউজিয়াম— 'মিউসেম'-এ পাঁচ বছর কাজ করেছিলাম। তারপর ভাবলাম, যেটা অনেকদিন ধরে মাথায় ঘুরছিল, সেটা এবার করব— নিজের একটা রেস্তোরাঁ খোলা। আমি এখনও ভাবি— কেন এটা করতে চেয়েছিলাম? সবচেয়ে সহজ উত্তর, টাকা চেয়েছিলাম। ভাবতাম, একটা রেস্তোরাঁ খুলে ভালোভাবে চালাতে পারলে, টাকা আসবে। হয়তো সেটা সত্যিও। তবে আমি এখনও আমার উত্তর খুঁজছি। যখন দেখলাম, দৈনন্দিন জীবন কতটা জটিল হতে পারে , তখন ধারণাটা একটু বদলে গেল। শুরু থেকেই ভাবতাম, আমি যখন প্রথম এখানে এসেছিলাম, আমাকে তো কেউ একটা সুযোগ দিয়েছিল। এখন আমি যেন সেই সুযোগটা অন্য কাউকে দিতে পারি। ব্যক্তিগত কোনও উপকার না কিন্তু জীবনের প্রতি একটা দায়িত্বপালন বলতে পার।

তাই আমি আজও কাজ করতে ভালোবাসি সেইসব লোকেদের সঙ্গে, যারা হয়তো আমার মতোই এখানে এসেছে বা নয়। ছাত্র হোক বা না হোক। আমার এখন যেসব কর্মচারী আছেন, তাঁদের অনেকেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছেন— সিরিয়া, প্যালেস্তাইন— যারা অনেক বেশি লড়াই করে মানিয়ে নিতে জানে। ভাষা জানে না। ট্রমা আছে। পরিবার আছে। খুব কঠিন জীবন। তখন ভাবলাম, এই লোকগুলো অন্তত যেন মাসের শেষে একটা বেতন পায়, সামাজিক নিরাপত্তা থাকে, খাবারটা নিশ্চিত হয়। তাহলে বেঁচে থাকার বাইরেও হয়তো কিছু ভাবতে পারবে।

ব্যস, ওইটুকুই। আর তোমার প্রশ্নের উত্তরে বলি— হ্যাঁ, আমি চেষ্টা করি, আমার সঙ্গে যেভাবে আচরণ করা হয়েছিল, তার চেয়ে ভালো কিছু করার। সহজ না, এখন বুঝি, লোকজন কেন ওভাবে ব্যাবহারে করত। নিয়ম চাইলেই পালটানো যায় না। রাষ্ট্র যে সীমিত সময় কাজ করার অনুমতি দেয়, সেটা ছাপিয়ে কাউকে দিয়ে কাজ করানো খুব কঠিন। সবসময় অতিরিক্ত কোনও রাস্তা খুঁজতে হয়। আর মাঝে মাঝে তার ধাক্কাটা তোমার ওপরই ফিরে আসে।

শ্রীজাতা: মার্সেইতে তুমি প্রথমে অন্য একটা রেস্তোরাঁয় কাজ শুরু করেছিলে, ঠিক? তারপর…

ইব্রাহ: এইটা খুললাম।

শ্রীজাতা:তুমি নিজের ব্যবসা শুরু করলে। ওই রূপান্তর কতটা সহজ ছিল? ধরো, কেউ যদি কাল চায় নিজের ব্যবসা শুরু করতে, বিশেষ করে একজন বাইরের মানুষ হয়ে — ফ্রান্সে সেটা কতটা সহজ?

ইব্রাহ: আমি বলব ভীষণই কঠিন। খুবই জটিল একটা ব্যাপার। মাঝে মাঝে তো নিজেকেই প্রশ্ন করি, আমি কীভাবে পারলাম! ফ্রান্স ব্যবসা করার জন্য খুব, খুব কঠিন জায়গা। বিরাট একটা আমলাতন্ত্র আছে এখানে, আর সেটা যেন চিনা ভাষায় লেখা! আমি তো অনেক ভাষা জানি, তবুও অনেক সময় মনে হয়, “আচ্ছা, এটা আবার কী?”

শ্রীজাতা: তোমার যদি এতটা কষ্ট হয়, তাহলে অন্যদের তো আরও কঠিন লাগবে।

ইব্রাহ: ঠিক তাই। আর এমন অনেক জিনিস আছে যেগুলো হয়তো আগে ভাবতেই পারিনি। কাজ করতে করতে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম। বিশেষ করে যদি তুমি বিজ়নেস স্কুলে না পড়ে থাকো, তাহলে খুব কঠিন এই যাত্রা। অন্যরা  অভিজ্ঞতা শেয়ার করে ঠিকই, কিন্তু সেটা তো ওদের নিজের চোখ দিয়ে দেখা। তাই ব্যাপারটা মোটামুটি কঠিনই থেকে যায়। আমার মতে ফ্রান্সে সবচেয়ে কঠিন জিনিস হচ্ছে কর্মচারীদের সামলানো।

শ্রীজাতা: তাই?

ইব্রাহ:
সেটাই মনে হয় সবচেয়ে কঠিন। কর্মচারী, ওদের অধিকার, অধিকার বিষয়ক আইন  — পুরো ব্যাপারটা খুব জটিল। সত্যি বলছি, এটা এখনও আমার একটা চিন্তার জায়গা। আমি তো মনে করি এখনকার শ্রমিক আইনগুলো ২০২৫-এর কাজের পরিবেশের সঙ্গে মানানসই না। অনেকটাই বাস্তববিচ্ছিন্ন। তুমি কাউকে কাজে নিয়োগ করলে, ভরসা করে, দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলে, এর জন্য ওদের সঙ্গে অনেক তথ্য ভাগ করতেই হবে। পরে দেখা যায়, সেই তথ্যই তোমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে!

এগুলো আমার নিজের অভিজ্ঞতা। আমি তো মানবিকভাবে কর্মস্থল সামলাতে চেয়েছিলাম— যখন কিছু বলার থাকত, সরাসরি বলতাম। ছোট মিটিং ডাকতাম। কিন্তু কোনও আনুষ্ঠানিক হুঁশিয়রি ইত্যাদি কিছুই দিতাম না। কোনও রেকর্ড থাকত না যে আমি কিছু বলেছি।
কিন্তু মানুষ তো বদলায়— এটা তো স্বাভাবিক। যখন কথাবার্তার যোগাযোগ আর কাজ করে না, তখন আর একসঙ্গে কাজ করা যায় না। কিন্তু এইসব পরিস্থিতিতে সেই সম্পর্ক শেষ করাটাও ফ্রান্সে ভীষণ কঠিন।

শ্রীজাতা: বুঝতে পারছি।

ইব্রাহ: এই জিনিসগুলো আমার অনেক জন্য অনেক সমস্যা তৈরি করেছিল— বিশেষ করে যখন দ্বিতীয় রেস্তোরাঁ খুললাম। ছোট ছোট ব্যাপার, কিন্তু সমস্যার। আমার পক্ষে কাউকে একটা হুঁশিয়ারি দেওয়াটা কঠিন বিষয়। সবাই তো মানুষ, কেউ তো জড়পদার্থ নয়? আমি এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, কীভাবে সামলাব—বিশেষ করে যখন কারও ওপর ভরসা করে প্রতিদান পাই না। এখনও এসব নিয়ে ভাবি। এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ আছে সামনে।

শ্রীজাতা: হ্যাঁ, আমরা তো তোমার রেস্তোরাঁয় যাই, মজা করি, দারুণ খাবার খাই কিন্তু নেপথ্যের গল্পগুলো তো জানি না কেউই। এই    মুহূর্তে তোমার কর্মচারীদের নিয়ে একটু বলবে? ওরা ফ্রান্সে কীভাবে এল, কী খুঁজছিল?

ইব্রাহ: হ্যাঁ, বলি। এখন MOGA-তে যারা আছে— একজন গিনি রিপাবলিক থেকে, তিনজন সিরিয়া থেকে, একজন ইতালি থেকে, একজন লেবানন থেকে— আমি নিজে আর চারজন ফ্রান্স থেকে, আর একজন কলম্বিয়া থেকে।

শ্রীজাতা: দারুণ! একবার সবাইকে নিয়ে একটা ছবি তোলা উচিত, সকলের দেশের পতাকা হাতে নিয়ে।

ইব্রাহ: হ্যাঁ! ওই তিনজন সিরিয়ান রিফিউজি। একজন খুব নিবিড়ভাবে ফ্রেঞ্চ শেখার ক্লাস করছিল— ভাষাটা বেশ ভালোই শিখে নিয়েছে। বাকি দু'জনের পক্ষে একটু কঠিন—একজনের চারটে বাচ্চা, আরেকজনের পাঁচটা। সম্পূর্ণ সময় কাজের সঙ্গে ফরাসি শেখার সময়    পায় না ওরা। গিনি রিপাবলিকের যে ছেলেটা আছে, ও নিজের ডকুমেন্ট পাওয়ার অপেক্ষায়। ওর কনট্র্যাক্ট আছে আমাদের সঙ্গে, আর আমরা চাই ওর পরিবারও চলে আসুক এখানে। ফরাসি যাদের নিয়ে কাজ করি— ওরা আমার বন্ধু। আমি ইচ্ছা করে বন্ধুদের নিয়েছি, কারণ আমার এমন কাউকে দরকার ছিল যে আমার যত্ন করতে পারবে, যেমন আমি বাকিদের জন্য করে থাকি। কলম্বিয়ান মেয়েটি গত গ্রীষ্মে কাজ করেছিল, এখন দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আছে। ইতালিয়ান ছেলেটি রান্নাঘরে কাজ করে। ওঁকে চিনেছি কলম্বিয়ান মেয়েটির মাধ্যমেই। মানে একজনের হাত ধরে আরেকজন চলে আসছে। এই পর্যায়টা আসলে সবচেয়ে সহজ। কারও সিভি পেলে ফোন করি, দেখা করি। কিন্তু সত্যি বলছি, প্রতিদিন নতুন মানুষদের সঙ্গে দেখা করে কেন আমার রেস্তোরাঁতে কাজ করা উচিত বোঝানোর এনার্জি থাকে না। আমি ভালো কিছু করতে চাইছি, আশা করি সেটাই যথেষ্ট। আমার বর্তমান কর্মচারীরা হয়তো নিজেদের চেনা-পরিচিতদের বলবে, যদি ওদের বন্ধুরা কাজ খোঁজে তারা আসবে। একটা সম্প্রদায় সংযুক্তির ধারণা। LGBTQ+, আরবিভাষী, ফ্রেঞ্চ না জানা— যেমনই হও, যেখান থেকেই এসো, সবাই এখানে আসতে পারে। আগে আমার এক ট্রান্স মহিলা বন্ধুর সঙ্গে কাজ করতাম। ওরও একটা চুক্তি ছিল MOGA-তে। তুমি কাজ করো? ভালো করো? তোমার এখানে কাজ করতে ভালো লাগছে? আমরা একে অপরকে বুঝি? ব্যস, ওইটুকুই। আর কিছু লাগে না আমার।

আরও পড়ুন- ভদ্রবিত্তের কাছে ‘তুচ্ছ’ বলেই হকারদের কথা আজও ভাবে না প্রশাসন?

শ্রীজাতা: তুমি আগেই বলেছিলে একটা খুব ইন্টারেস্টিং কথা— “ওয়ার্ক ইজ ফ্রিডম।”এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, সিরিয়ান কর্মচারীদের কথা ভাবলে, তারা তো পলিটিক্যাল রিফিউজি—একদিকে ফ্রান্স নিরাপত্তা দিচ্ছে, অন্যদিকে কাজ পাওয়া ভীষণ কঠিন। সেই হিসেবে তুমি সেতুবন্ধন করছো।

ইব্রাহ: হ্যাঁ।

শ্রীজাতা: ভীষণ আশাব্যঞ্জক। তুমি বললে, একজন রূপান্তরকামী কর্মচারীও ছিলেন। সাধারণভাবে ফ্রান্সে ২০২৫ সালে, কুইয়ার সম্প্রদায়ের কাজ পাওয়া কতটা সহজ?

ইব্রাহ: আমি বলব, খুব একটা সমস্যার না। নির্ভর করে। সহজ, আবার সবসময়ে খুব সহজও না। মনে হয় এখন হয়তো একটু কঠিনই হয়েছে। জানি না কেন, মানুষ একটু একটু করে গোঁড়া হয়ে যাচ্ছে।

শ্রীজাতা: হ্যাঁ, মনে হচ্ছে অনেক কিছু আবার খারাপের দিকে যাচ্ছে।

ইব্রাহ: LGBTQ+ নিয়ে কথা বলার আগে বলি, আমি আরব, কিন্তু অনেকে আমাকে দেখে বোঝে না। দেখে ভাবে, “লেবানিজ, তাই ঠিক আরব না।” কিন্তু লেবানন তো আরব। আমি চাই না কেউ আমার জাতি বা পরিচয়ের নতুন সংজ্ঞা লিখুক। আমি যেহেতু হোয়াইট-পাসিং, আমার ক্ষেত্রে জীবন একটু সহজ হয়—আমি খুশি। কিন্তু সবার জন্য এমন না।

শ্রীজাতা: বুঝলাম।

ইব্রাহ: অনেক সময় তো শুধু 'অস্তিত্ব'-ই একটা রাজনৈতিক অবস্থান হয়ে দাঁড়ায়। তবে আমি একা না, মার্সেইতে অনেক রেস্তোরাঁ আছে যারা LGBTQ+ কমিউনিটিকে সমর্থন করে, কাজ দেয়। তাই সব কিছু একেবারে অন্ধকার না—তবে হ্যাঁ, জটিল বটে। বিশেষ করে রূপান্তরকামী মহিলাদের জন্য।

শ্রীজাতা: আর রূপান্তরকামী পুরুষদের জন্য?

ইব্রাহ: হ্যাঁ, তাদের জন্যও কিন্তু এই রক্তচোষা দুনিয়ায় রূপান্তরকামী মেয়েরা আরও বেশি সমস্যায় পড়ে।

শ্রীজাতা: কাজ পেতে ওদের এত সমস্যা কেন হয়?

ইব্রাহ: সমস্যা আইনে না— সমস্যা শুরু হয় কাজ পাওয়ার পরে।

শ্রীজাতা: মানে, সহকর্মীদের থেকে?

ইব্রাহ: হ্যাঁ, একদম। তুমি সিভি পাঠাও, ম্যানেজার বা HR-এর সঙ্গে দেখা করো, কাজ আর তোমার গুণ নিয়ে কথা হোক কিন্তু একবার ঢুকে পড়ার পর বুঝতে পারবে— ওরে বাবা, এরা সবাই ট্রান্সফোবিক! জীবন নরক করে তোলার জন্য একজন ট্রান্সফোব, হোমোফোব, জেনোফোব বা একটিমাত্র বোকা লোক থাকাই যথেষ্ট। একটা উদাহরণ দিই। আমার এক কর্মচারী মিশরের। ও ভাবে আমি রেসিস্ট। ওর অধিকার আছে এমন ভাবার— যা খুশি ভাবতেই পারে।

শ্রীজাতা: কিন্তু কেন?

ইব্রাহ: আসলে ব্যাপারটা দ্বিপাক্ষিক। আমি মনে করি, ও হয়তো আমার সঙ্গে কাজ করতে ভালোবাসে না। হয়তো ওর আমার কাজের নীতি ভালো লাগে না।তাই ঠিক করেছে, আমি রেসিস্ট। শুনলে হাসিই পায় আমার। কিন্তু সত্যি বলতে, হতে পারে আমারও কিছু অজ্ঞাত পক্ষপাতিত্ব আছে। আমি জানি, যারা বহু বছর ফ্রান্সে আছে কিন্তু এখনও ভাষাটা শেখার চেষ্টাও করেনি — ওদের জন্য একটা হতাশা কাজ করে আমার মধ্যে। আমি চাই না ওরা আমার জন্য ফরাসি শিখুক, বরং ভাষাটা না জানলে জীবন এখানে কতটা কঠিন হয়ে যায় সেটা জানি বলেই ওদের শিখতে বলি। 

শ্রীজাতা: এই সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলার জন্য কোনও মঞ্চ বা সংগঠন আছে? আগামী ২০-৫০ বছরের মধ্যে কিছু বদলাবে?

ইব্রাহ: আসলে এসব প্রশ্ন আমি নিজেকে করি না। আমি মনে করি এখানে অনেক লবি আছে, বাকি আমার আওতায় নেই। আশা করি কিছু বদলাবে কিন্তু এর জন্য প্রচুর সময় লাগে আর রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। ফ্রেঞ্চরা ওদের যেটুকু আছে তাতেই খুশি— এটাই ফ্রান্সের একটা ভালো দিক। শ্রমিক হিসেবে প্রচুর অধিকার আছে। আমি নিজে একসময় কর্মচারী ছিলাম, জানি। আমার মনে হয় এখন যোগাযোগ আপডেট করার দরকার। জেন জি আর জেন আলফা, একদম অন্যরকমভাবে কর্মসংস্কৃতিকে দেখে। আমি ওটাই সামলানোর চেষ্টা করছি। তাই এখন আর CDI (স্থায়ী চুক্তি) দিই না। হয়তো দীর্ঘমেয়াদি দিই কিন্তু এমন কিছু চাই না যাতে আমি বা ওরা কেউ আটকে পড়ে। কাজ সলে খুব ক্লান্তিকর বিষয়।

শ্রীজাতা: একদম। তাও তো আমরা আমাদের পছন্দের কাজ  করছি। তাতেও ক্লান্তি আসে।

ইব্রাহ: তাই হয়তো একদিন যদি আমি এই সব সামলানোর পথ খুঁজে পাই, তখন সময় নিয়ে ভাবব। লেবাননে কাজের ধরন একদম আলাদা— কাজ করো, টাকা পাও, ব্যাস। খুশি নও? চলে যাও। একদম সোজাসাপটা। এটাই আমার কাজের ধরন। ফ্রান্স একদম আলাদা, বিশেষ করে ফ্রেঞ্চরা। সমস্যা হলো, বাইরের লোকেরাও এখানে এসে ফ্রেঞ্চদের থেকে শিখে এটাই করে। একটা সময়ের পরে মানুষ দায়িত্ব ভুলে যায়। তখন শুধু অধিকার, অধিকার, অধিকার। হয়তো একদিন যদি আমি এই নিয়ে কিছু লিখি, সেটা আইনি ভাষায় লিখতে হবে— যা আমি জানি না। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করব না যে, “সব ভেঙে পড়েছে!” কিন্তু ভেতর থেকে কিছু একটা ভাঙন ধরেছে। শুধু আমার না, অনেকেই এই সমস্যা অনুভব করছে।

শ্রীজাতা: যেভাবে রাজনীতিতে সব বদলাচ্ছে, ফ্রান্সেও— তার প্রভাব কী হবে শ্রমিকদের উপর?

ইব্রাহ: আমার মনে হয়, অধিকার কমানো যাবে না— প্রশ্নই ওঠে না। অন্তত কাজের জায়গায় মানুষের অধিকার থাকবে কিন্তু এখন আমরা একটা মৌলিক বদলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। অর্থনীতিতে বেশি লিবারালিজম ঢুকছে। ফ্রান্স নিজেকে সোশাল বলে কিন্তু অর্থনীতি দিনকে দিন আলট্রা-লিবারাল হচ্ছে। আমি চেষ্টা করছি টাকা আর মানবিকতার মধ্যে ভারসাম্য রাখতে। কারণ টাকা রোজগার  হলো কিন্তু কোনও গল্প থাকল না, এর কোনও মানে নেই। কোনও লিগ্যাসি থাকবে না।লিগ্যাসি ছাড়া কেমন ফাঁকা বা নেতিবাচক লাগে। বুঝতে হবে, নিশ্চয়ই কিছু না কিছু গোলমাল আছে। এই সমস্যা রাজনীতি থেকে না, বরং সিস্টেমের ভেতর থেকেই আসছে। এখন VAT বাড়িয়ে দিচ্ছে অটো-আন্ত্রেপ্রেনরদের জন্য। আগে যেখানে ৪৫,০০০ ইউরো পর্যন্ত আয়ে VAT লাগত না, এখন সেটা কমিয়ে ২৫,০০০ ইউরো করে দিয়েছে।
মানে যারা ছোট ব্যবসা চালায়, যেমন আমাদের পাশের দোকানদার, তাদের জন্য খুব চাপ। আয়ের প্রায় ৫০% চলে যায়। আমি লেবানন, ইতালি আর ফ্রান্স মিলিয়ে ১৭ বছর ধরে আছি। ডিকটেটরশিপ, যুদ্ধ, বাম, ডান, এক্সট্রিম সব দেখেছি— কিছুই বদলায়    না।

শ্রীজাতা: তাহলে ফান্ডামেন্টাল পলিসি বদল না হলে কিছুই বদলাবে না?

ইব্রাহ: একদম। যা বদলাচ্ছে সেটা হলো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি— রূপান্তরকামীদের অধিকার, LGBTQ+, বিদেশিদের নিয়ে ভাবনাচিন্তা আরও জটিল হতে চলেছে। কিন্তু একবার সিস্টেমে ঢুকে গেলে শুধু সামলে চলতে হবে।  আমাদের একটু বেশি উদার হতে হবে। যেমন, গিনি থেকে আসা মামাদু — ওকে আমাদের দরকার। তুমি যে পরিষ্কার প্লেটে খাচ্ছো, সেটা মামাদু মেজেছে। একজন ফ্রেঞ্চ ওর কাজ করবে না। আমি এর চেয়ে বেশি কিছু বলব না।

রাস্তা কেন পরিষ্কার? লেবাননে তো নয়। ভারতে আমি যাইনি, জানি না কেমন, কিন্তু আমার দেশের থেকে এখানে পার্থক্য চোখে পড়ে। মার্সেই বিশ্বের অনেক শহরের চেয়ে পরিষ্কার। কারণ ডায়াস্পোরার মানুষরা এই কাজগুলো করছে। এটা খুব কষ্টকর কাজ। দুর্ভাগ্যবশত, এই কাজগুলোকে ছোট করে দেখা হয়।

শ্রীজাতা: আমরা তো এই মানুষগুলিকে চোখেই দেখি না!

ইব্রাহ: ঠিক বলেছো। আমরা ধন্যবাদটাও বলি না। এটা নীতির বাইরের সমস্যা— এটা শিক্ষার জায়গা থেকে আসা দরকার। 

শ্রীজাতা: কথাবার্তা একটু অন্ধকার দিকেই চলে গেছিল। একটু আলোভরা কথা দিয়ে শেষ করি। আগামী পাঁচ বা দশ বছরে তুমি নিজেকে কোথায় দেখছো? তুমি Community Kitchen-এর কথা বলো। কেন?

ইব্রাহ: Community Kitchen মানে তুমি ইভেন্টগুলোর কথা বলছো?

শ্রীজাতা: না, Cantine de Midi?

ইব্রাহ:
ওহ হ্যাঁ, Zaza আর বাকিদের সঙ্গে। না খেয়ে তো আমরা বাঁচব না। মানুষ খাবেই, সে রাজনীতির অবস্থা যাই হোক না কেন। এই জিনিসটা আমার খুব আশ্চর্য লাগে। সম্ভবত যখন এই রেঁস্তরার কথা প্রথম মাথায় এসেছিল তখনই একটা জিনিস চেয়েছিলাম— কোনও একটা গল্প বলার জায়গা। আর আমার মতে, খাবারের মাধ্যমে গল্প বলার চেয়ে ভালো উপায় আর হয় না। আমি যখন আমাদের মেনুটা একদিন ভালো করে দেখলাম, বুঝলাম— এটা তো আমার রান্নাঘর না। এই প্লেটটা আমি বানাচ্ছি না— Zaza বানাচ্ছে। ও আমাদের সিরিয়ান শেফ। তখন আমি ডিশগুলোর নাম পাল্টে দিলাম। বললাম, ‘এটা Zaza-র রান্না,’ কারণ আমি অনুভব করলাম এটা আমার গল্প না, ওর গল্প। ওর রান্না দারুণ। আর ঠিক দুপুরবেলায় যখন মানুষ একটু শান্তি চায়, সব ভুলে ১৫ মিনিট নিশ্চিন্তে খেতে চায়— Zaza যা পরিবেশন করে, সেটা শুধু খাবার না, ওর নিজস্ব গল্পও বটে। সেটা মানুষ অনুভব করতে পারে। অনেক ক্রেতাই এসে ওকে সাধুবাদ    দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে যায়। এই জিনিসটাই আমার কাছে সাফল্য। শুধু দিনের শেষে কত টাকা রোজগার করলে সেটাই ব্যাপার না। স্বীকৃতি বড় ব্যাপার, বিশেষ করে Zaza-এর মতো কারও জন্য, যে এখানকার ভাষাই জানে না। আমার এই জায়গাটা এখন একটি ইনস্টিটিউশন হয়ে গেছে। মানুষ এই নিয়ে কথা বলছে। তুমি যখন প্রথম এলে, দুপুরবেলা, মনে আছে?

শ্রীজাতা: হ্যাঁ, প্রথমবার এসেছিলাম লাঞ্চে।

ইব্রাহ: তখনই তো Zaza ছিল।

শ্রীজাতা: ওর হাসিটা খুব উজ্জ্বল। যত খাটনিই হোক, মুখে সবসময় হাসি।

ইব্রাহ: আমি ওকে খুব ভালোবাসি। অসাধারণ মেয়ে। আর একটা কথা বলি— Zaza হিজাব পরে। হিজাব পরা মেয়েদের চাকরি পাওয়া সত্যি খুব কঠিন।

শ্রীজাতা: হ্যাঁ, সেটা নিয়ে একটু বলো?

ইব্রাহ: ফ্রান্স অনেক বড় একটা দেশ কিন্তু বড্ড রেসিস্ট। প্রকাশ্যেও, সূক্ষ্মভাবেও। আমি বলব না যে এখানে বাইরের কেউ স্বাগত নয়, কিন্তু সাদরে গ্রহণযোগ্যও না। আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না, একটা মেয়ের হিজাব থাকলে তার চাকরি পেতে সমস্যা কেন? নিছক নির্বুদ্ধিতা। Zaza আর ওর সহকর্মী Rawa—দু’জনেই হিজাব পরে। একবার আরেকটি মেয়ে চাকরির জন্য এসেছিল। বলল, ওর আগের কাজের জায়গায় বলা হয়েছিল, কাজের সময় হিজাব খুলে রাখতে। যদিও ও রান্নাঘরে কাজ করত, যেখানে কেউ ওকে দেখতেই পেত    না! আমি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম শুনে । মেয়েরা অন্য যা খুশি পরুক, সবাই বলে ‘ফ্রিডম’ আর ‘লিবার্টি’— কিন্তু একটা মেয়ে নিজের ইচ্ছেতে হিজাব পরলে, সেটা সমস্যা হয়ে যায়? জোর করে কেউ চাপিয়ে দেয়নি, ও নিজে পরেছে। তাহলে সেটা নিয়ে এত হাঙ্গামা কেন? ইউরোপিয়ানদের কেন মনে হয় যে হিজাব পরা মেয়ে মানেই, ‘ও নিশ্চয়ই দাসী’? ও তো একটা চাকরি খুঁজছে! দাসী হবে কেন? এই জিনিসটা দাড়িওয়ালা ছেলেদের সঙ্গেও হয় না। যতক্ষণ না সে একদম ট্র্যাডিশনাল জামাকাপড় পরে, ততক্ষণ ওর দাড়ি নিয়ে কেউ কিছু বলে না।

শ্রীজাতা: তুমি কি মনে করো, এর জন্য ফ্রান্সের আইন দায়ী, যে আইনে বলা হয়েছে পাবলিক ইনস্টিটিউশনে কেউ ধর্মীয় প্রতীক পরে কাজ করতে পারবে না?

ইব্রাহ: হ্যাঁ, কিন্তু বস্তবে তো সেটা হয় না। খ্রিস্টানরা তো এখনও ক্রস পরে। আর যদি না-ও পরে, কিছু না কিছু ধর্মীয় প্রতীক তো গায়ে থাকেই। পুরো ব্যাপারটাই দ্বিচারিতা। ওরা বলে ‘সেকুলারিজম’, কিন্তু বেশিরভাগ সেকুলার স্কুলেও ক্রিসমাস ট্রি লাগানো থাকে— যেটা আদতে খ্রিস্টান না, প্যাগান সংস্কৃতির জিনিস। সেটাকে এখন ক্রিসমাস উদযাপনের অংশ বলেই ধরে নেওয়া হয়। তাহলে ওটা ঠিক, আর বাকি উৎসবগুলো ঠিক না কেন? মানুষ আসলে সেকুলারিজম বলতে ঠিক কী বোঝে, জানেই না। সরকার নিজেই সেটা স্পষ্ট করে না। একটা ক্রস লুকিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু হিজাব চোখে পড়ে। আর তারপর থেকেই মানুষ মুসলিম মেয়েদের ওপরে নিজেদের মানসিকতা চাপিয়ে দেয়। এই চাপটা ধর্ম থেকে আসে না—সমাজ থেকে আসে। 

আমি এখন একটু শান্ত, মসৃণ একটা জীবনের দিকে তাকিয়ে আছি । আমি এতদিনে নিজের কাছে প্রমাণ করে ফেলেছি যে আমি একটা রেস্তোরাঁ চালাতে পারি, একটা কমিউনিটি স্পেস গড়ে তুলতে পারি। কিন্তু এই অধ্যায় হয়তো এখন বন্ধ করার সময় আসছে। এই ফরম্যাটে আর বলার মতো গল্প নেই আমার কাছে। আমার এটা মেনে নেওয়া খুব দরকার যে আমি এই কাজটাই সারাজীবন করব না। রেস্তোরাঁর কাজ মানসিক শান্তি দেয় না। প্রচুর সময় খায়। পুরো শরীরটা কাজে লাগাই, রিটার্ন আসে সামান্য। তাই আমার পরের অধ্যায়টা বদলের। একটা ক্লান্তিকর জিনিসকে কীভাবে আরও প্রাণময় করা যায়— সেই চেষ্টা। আমি আরও বেশি করে বন্ধুদের সঙ্গে কাজ করতে চাই। জানি না আর কতদিন এভাবে চালাতে পারব। আবার হয়তো আঁকতে বসব। Moga রেস্তোরাঁ যেন শুধু একটা খাবারের বা সার্ভিসের জায়গা না হয়— পার্টি, কনসার্ট, এক্সিবিশনের জায়গা হয়ে উঠুক।

শ্রীজাতা: যেমন ওই ফোটোগ্রাফির ইভেন্টটা করেছিলে?

ইব্রাহ:
হ্যাঁ, একদম। ওটা ছিল ডিসেম্বরে। জানুয়ারিতেও একটা করেছিলাম। ফোটো এক্সিবিশন করেছিল আমার এক বন্ধু—যে ছ’বছর জেরুজালেমে ছিল, গাজা যুদ্ধের আগের সময়টা ও জানে। ওর লেখা কিছু টেক্সট এখনও আমাদের দেওয়ালে আছে— ফরাসি আর আরবি ভাষায়। এই দেওয়ালগুলো শুধু খাবার বা কর্মনীতি নয়— আরও গল্প বলার জায়গা হতে পারে। ক্লেয়ার, আমার বন্ধু এসেছিল ছবি নিয়ে। আমি বললাম, যা পারি, এই দেওয়াল জুড়ে দেখিয়ে দিই।’ তারপর জানুয়ারিতে আবার এসে ক্লেয়ার একটা মনোলগ পারফর্ম করল—ওর জেরুজালেমের জীবনের ওপর একটা থিয়েটার পিস। এখন ওটা নিয়ে ট্যুর করছে। এইটা শুধু রেস্তোরাঁ না— একটা ভেসেল। সৌন্দর্য দেখানোর। গল্প বলার। সামনে এগোনোর।

More Articles