অগ্নিপথের আগুনে রেলের ক্ষতি ১,০০০ কোটির বেশি, এক দশকে সর্বাধিক

অগ্নিপথ নিয়ে সারা দেশ জ্বলেছে। বিক্ষোভের আগুন নেভাতে নাজেহাল হয়েছে পুলিস প্রশাসন। জনরোষ সবচেয়ে বেশি আছড়ে পড়েছে রেলের ওপর। টিভি ক্যামেরায় বারবার জ্বলে উঠেছে রেলের ঝলসে যাওয়ার ছবি। রেলের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করতে বসেছেন আধিকারিকরা। বিহার থেকে তেলেঙ্গানা দাউ দাউ করে জ্বলেছে রেলের কামরাগুলো। ভারতীয় রেল জানাচ্ছে, তাদের ক্ষতির পরিমাণ ১০০০কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে রেলের সম্পত্তির ধ্বংস যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে টিকিট ক্য়ানসেল ও ট্রেন বাতিলের টাকা ফেরত। ক্ষোভের আগুন নিভল কি না বলা মুশকিল তবে লেলিহান শিখা এবারও গ্রাস করল শতাব্দীপ্রাচীন এই পরিবহণ সংস্থাকে।

আন্দোলনকারীরা রেলের সম্পত্তি এবং প্রায় কয়েক ডজন ট্রেনে আগুন লাগিয়েছেন। এর আগে রেল জানিয়েছিল, শুধু চারদিনের প্রতিবাদেই ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এরপরে রেল জানায়, ৬০ কোটি টাকার যাত্রীদের টিকিট ক্যানসেল হয়েছে। রেল জানিয়েছে, গত দশকে এই ক্ষতি সর্বাধিক। সব রাগ কেন বারবার রেলের ওপর গিয়ে পড়ে তার কোনও সদুত্তর নেই।

ট্রেন তৈরির খরচ

রেলের আধিকারিকরা জানিয়েছেন, একটা জেনারেল কোচ তৈরি করতে খরচ হয় ৮০ লাখ টাকা। একটা স্লিপার কোচ তৈরি করতে খরচ হয় ১.২৫ কোটি টাকা, অন্যদিকে একটা এসি কোচ নির্মাণের খরচ ৩.৫ কোটি টাকা। একটা রেল ইঞ্জিন তৈরি করতে সরকারকে ট্যাঁক থেকে ২০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করতে হয়। ১২ কোচের প্যাসেঞ্জার ট্রেন নির্মাণের খরচ প্রায় ৪০ কোটি টাকা। ২৪ কোচের ট্রেন তৈরির খরচ প্রায় ৭০ কোটি টাকা। কোনও প্রকল্প নিয়ে রাগ জমতে পারে, কোনও আইন নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হতে পারে, এ তো বিচিত্র নয়। আশ্চর্যের হল রাগ দেখানোর জন্য রেল কোচ আদর্শ জায়গা! দাউ দাউ করে জ্বলছে সরকারি সম্পত্তি, এতেই কি একমাত্র ক্ষোভের আগুন নেভে! সরকারি সম্পত্তি আদতে কার টাকা! এটা তো কোনও গৌরী সেনের পয়সা নয়, এতো বলাই বাহুল্য যে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করে আসলে নিজেদের অর্থে আগুন দেওয়া হচ্ছে।

অতীতের রেকর্ড

অতীতের সব রেকর্ডকে ভেঙে দিল অগ্নিপথের আগুন। রেল মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২০-২১ সালে আইন শৃঙ্খলার অবনতির জন্য রেলের ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪২৭.২০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ সালে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০০কোটি টাকা।

আরও পড়ুন-দূরপাল্লার যাত্রায় আজও শেষ কথা, কেন লাল-নীল-সবুজ হয় রেলের কামরা?

অগ্নিপথে বেশি জ্বলল বিহার

অগ্নিপথের আগুনে শুধু বিহারেই রেলের ক্ষতি ৭০০ কোটি টাকা। এক বিবৃতিতে সরকারি ভাবে এই তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় রেল। ওই বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, গত কয়েকদিনের বিক্ষোভের জেরে মোট ৬০টি বগিতে আগুন দেওয়া হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ১১টি ইঞ্জিন। এছাড়াও বিহারের একাধিক জেলার একাধিক স্টেশনে তাণ্ডবের জেরে ভেঙে তচনছ হয়ে গিয়েছে রেলের বহু সম্পত্তি।

কেন্দ্রের অগ্নিপথ প্রকল্প ঘোষণার পর থেকেই উত্তাল বিহার। বক্সার, নওয়াদা, ছপরা, বেগুসরাই, আরা, মুঙ্গের, জেহানাবাদের মতো এলাকায় ছড়িয়েছে বিক্ষোভ। রেলের পাশাপাশি অবরোধ করা হয় জাতীয় সড়ক। টায়ার জ্বালানো, পাথর ছোঁড়া, গাড়ি ও ট্রেন ভাঙচুরের মতো ঘটনাও ঘটেছে।

সিএএ, ক্ষতি ১০০ কোটি

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদ। এখনও স্মৃতির আরশিতে ফিকে হয়ে যায়নি দিনগুলো। তবে সেই বিক্ষোভ ঘিরে রেলের ক্ষতির হিসেব নিকেশ করতে বসলে শিউরে উঠতে হয়। ২০১৯ সালের সেই বিক্ষোভে রেলের ক্ষতি হয়েছিল একশো কোটি টাকার বেশি, বছরের শেষ দিনে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায় উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেল। যদিও এর আগে ভারতীয় রেলের তরফে বলা হয়েছিল, পূর্ব রেলের ক্ষতির পরিমাণ ৮০ কোটি টাকা।

সিএএ বিরোধী আন্দোলনে যেমন অসমে রেলের সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনই পশ্চিমবঙ্গে মালদহে দু’টি স্টেশনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হয় বলেও দাবি রেলের। ২০১৯ সালের শেষ দিনে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের তরফে জানানো হয়, নয়া আইনের প্রতিবাদে ৯ ডিসেম্বর থেকেই উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের বিভিন্ন এলাকায় রেলের সম্পত্তির উপর আঁচ আসতে শুরু করে। সেই ক্ষতি এখনও পুরোপুরি মেরামত করে উঠতে পারেনি রেল।

কৃষি আইনের প্রতিবাদেও রাগ গিয়ে পড়েছিল রেলের ওপর। বারবার আন্দোলনকারীরা দেশের নানা প্রান্তে ট্রেনের চাকা স্তব্ধ করেছেন। বিক্ষোভের আঁচ এতটাই গনগনে ছিল যে, শেষপর্যন্ত মোদি সরকারকে পিছু হটতে হয়।

৫ বছর পর্যন্ত জেল

শুধু অগ্নিপথ নিয়ে আন্দোলনেই নয়, অতীতে অনেক ক্ষোভের আগুনে পুড়েছে ট্রেন। আগুন লাগানো ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে রেল যুক্ত নয় এমন ঘটনাতেও ট্রেনের উপরে আক্রমণ চলে। ট্রেন তো বটেই স্টেশন-সহ রেলের অনেক সম্পত্তি নষ্ট হয়। এমন অপরাধ রুখতে কড়া আইন রয়েছে রেলের। রেলওয়ে প্রোটেকশন ফোর্স (আরপিএফ) রেলের সম্পত্তি নষ্ট করার দায়ে কাউকে গ্রেফতার করলে কেমন সাজা হতে পারে তার উল্লেখ রয়েছে রেলের আইনে।

১৯৮৯ সালের রেলওয়েজ আইনের ১৫১ ধারায় এই ধরনের অপরাধে কেমন সাজা হতে পারে তা স্পষ্ট করে উল্লেখ রয়েছে। আইন বলছে এমন অপরাধে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। সেই সঙ্গে জরিমানাও হতে পারে দোষীদের। আবার জেল ও জরিমানা দুইই হতে পারে। রেলের আইনে এমনটাও বলা রয়েছে যে, আরপিএফ চাইলে পরোয়ানা ছাড়াই অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে পারে।

কেন্দ্রের স্বল্পমেয়াদী সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ প্রকল্প `অগ্নিপথে’র বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রতিবাদ হয়েছে। বিহার থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে তেলেঙ্গনা, সর্বত্রই প্রতিবাদের ধরনটা ছিল একই। রেলের সম্পত্তি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ। অথবা, রেল স্টেশন বা লাইনের ক্ষতি করা।

ভারতীয় রেলের ওপর এই ধরনের হামলা প্রথম না। কারণ, যাই হোক না-কেন, প্রতিবারই বিক্ষোভকারীদের যেন টার্গেটই থাকে ভারতীয় রেলের ক্ষতি করা। ১৬৮ বছরের সংস্থাকে এজন্য কম খেসারত দিতে হয় না! এমনিতেই ভারতীয় রেল লক্ষ লক্ষ দেশবাসীকে ভর্তুকিযুক্ত মূল্যে ভ্রমণ করায়। তার ওপর এই বিক্ষোভ। যেন রেলপথে বা স্টেশনে বিক্ষোভ না-হলে, ভারতে বিক্ষোভ পূর্ণতা পায় না, তা নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয় না! তাই বারবার নানা ইস্যুতে বিক্ষোভ আছড়ে পড়ে এদেশের রেলপথে।

সরকারের সম্পত্তি কি গৌরী সেনের টাকায় নির্মিত!

More Articles