দূরপাল্লার যাত্রায় আজও শেষ কথা, কেন লাল-নীল-সবুজ হয় রেলের কামরা?
একবিংশ শতাব্দীতে আইআরসিটিসি পেলাম আমরা। ২০০২ সালে শুরু হয়েছিল এই বুকিং।
এখন ভারতের অতি প্রত্যন্ত প্রান্তেও রেলের সঙ্গে পরিচিত মানুষ। কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন গ্রামের পাশে দুরন্ত গতিতে ছুটে যাওয়া রেলগাড়ি বাচ্চাদের কাছে ছিল অপার রহস্যের বিষয়। নিশ্চিন্দিপুরের এক নেহাত গ্রাম্য কিশোর তার দিদিকে নিয়ে ছুটে যেত ট্রেন দেখবে বলে। সেই অপু, সেই দুর্গা সেসময়ের বাংলার গ্রামীণ বালক-বালিকারই প্রতিচ্ছবি। বিভূতিভূষণের কলমে তার একটা মায়ামাখা রূপ গভীর ছাপ ফেলেছে বাঙালির যৌথমানসে। এখনও রেললাইনের পাশের বস্তি বা অতি-জীর্ণ বাড়িঘর পেরনোর সময় এমন ছেলেমেয়ে দল বেঁধে রেল দেখতে আসে। মাটি কাঁপিয়ে লোহার পাতের ওপর ছুটে চলেছে দীর্ঘ সরীসৃপ। দরজার খাঁজে খাঁজে বসে-দাঁড়িয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে কত কত মানুষ। সরে যাচ্ছে জানলার সারি। প্রতিটা জানলা অন্যরকম। কিছু কামরার আবার জানলা আটকানো। কাঁচের ওপারে পর্দার ফাঁক দিয়ে হয়তো চোখে পড়ছে এক-দু'খানা জলের বোতল। রেলের কামরার ভেতরটা কেমন হয়? যারা দেখেনি, তারা উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। কেউ বা মানুষ দেখেই খুশি। হাত নেড়ে টাটা করাটাই খেলা। পথচলতি মানুষজন, ট্রেনের যাত্রীদেরও ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে একটা চাপা কৌতূহল থাকে। সিনেমায় যেমন দেখায়, সেরকম কামরা থাকেটা কোথায়? চোখে দেখেনি বেশিরভাগই। একপাশে টানা করিডর, অন্যদিকে কুপ। যাঁরা ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী, হাতে সময় রয়েছে, তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই প্লেনের থেকে ট্রেনে যাওয়া পছন্দ করেন। তবে তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ প্রায় থাকে না বললেই চলে। অথচ ইন্টারভিউয়ের উদ্দেশ্যে দূর দেশে পাড়ি দেওয়া যুবকটিও বাথরুমের সামনে গাদাগাদি করে বসে সেই প্রথম শ্রেণির ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করে। রেলের বৈশিষ্ট্য এই। উচ্চমধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষ, সবাই একই ট্রেনে যাত্রা করেন।
মানুষের কৌতূহল এই ভিন্ন ভিন্ন কামরার ভিন্ন ভিন্ন রঙ নিয়েও। কেন কোনওটা লাল, কোনওটা নীল আবার কোনওটা সবুজ? কীসের ভিত্তিতে হয় এই রঙ? আসুন, আজ জেনে নেওয়া যাক।
লাল কামরা
লাল রঙের এই কামরাগুলোকে বলা হয় লিঙ্ক হাফম্যান বুশ। ২০০০ সালে জার্মানি থেকে এই কোচগুলো ভারতে আনা হয়। তখন জার্মানিতেই এই কোচ তৈরি হতো। এখন অবিশ্যি পাঞ্জাবের কাপুরথালাতেই এই কোচ তৈরি হয়। এই কোচ নির্মিত হয় মূলত অ্যালুমিনিয়ামে। এর ফলে অন্যান্য কোচের থেকে অনেকটাই হালকা এই কামরাগুলো। এছাড়াও এতে ডিস্ক ব্রেক ব্যবহার করা হয়। ফলে ২০০ কিমি প্রতি ঘণ্টা বেগে ছুটতেও এই কোচগুলোর অসুবিধে হয় না। এই জন্য 'রাজধানী' ও 'শতাব্দী'-জাতীয়'-জাতীয় দ্রুত গতির ট্রেনে এই কামরাগুলো ব্যবহার করা হয়। যদিও ধীরে ধীরে সমস্ত ট্রেনেই এই কামরা দেওয়ার কথা ভাবছে রেল কর্তৃপক্ষ।
আরও পড়ুন: এই গাড়ি চড়েই দেশ ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা ছিল সুভাষচন্দ্রের
নীল কামরা
নীল রঙের কামরাগুলোকে বলা হয় আইসিএফ (ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরি) কোচ। এলবিএইচ-এর মতো অ্যালুমিনিয়াম না, এই কামরাগুলো তৈরি হয় লোহা দিয়ে। এতে এয়ার ব্রেক থাকে। চেন্নাইয়ে অবস্থিত ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরিতে তৈরি হয় বলে এই নাম কোচগুলোর। ইন্টিগ্রেটেড কোচও বলা হয় অনেক সময়। মূলত নানা মেল ট্রেন, ইন্টারসিটিতে ব্যবহৃত হয়। এর গতি ৭০ থেকে ১৪০ কিমি প্রতি ঘণ্টা। লোহার তৈরি বলে কোচগুলো ভারী।
সবুজ কামরা
সবুজ কামরা মূলত 'গরিব রথ' ট্রেনে ব্যবহৃত হয়। মিটার গজ লাইনে যে ট্রেনগুলো চলে, সেখানে অবশ্য বাদামি রংও ব্যবহার করা হয়। ন্যানো গজের লাইনে ব্যবহার করা হয় হালকা সবুজ কামরা। যদিও এখন ন্যানো গজের ট্রেন তেমন চলে না ভারতে।
ভারতে রেল চলাচল শুরু হয় ১৮৫৩ সালে। মূলত মালপত্র পাচার ও অফিসারদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াতের সুবিধের জন্য ভারত ও আফ্রিকায় ট্রেন নিয়ে আসে ব্রিটিশরা। ধীরে ধীরে মধ্যবিত্তও এতে জায়গা পায়। এই ট্রেন কিন্তু ভারতের জাতীয়তাবাদ গঠনে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল। মধ্যবিত্তর রেলভ্রমণ ‘দেশ’ সম্পর্কে একটা সার্বিক ধারণা গড়ে তুলতে আহায্য করে। এবং এই দেশের সর্বত্র নিজের শ্রেণির একইরকম দুর্ভোগ দেখে তাদের মধ্যে একাত্মবোধ গড়ে উঠতে থাকে। গড়ে ওঠে এক অভাববোধও। সেই হীনম্মন্যতাই জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি। সেসময় বহু স্টেশন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ভারতীয় রেল সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে স্বাধীনতার পরে। আঞ্চলিক ক্ষেত্রগুলোতে, প্রান্তিক স্থানগুলোতেও রেল পোঁছতে শুরু করে দেশভাগের পরপরই। সমস্ত ভারতীয় রেলের নেটওয়ার্ককে বিভিন্ন জোনে ভাগ করে নেওয়া হয়। ভারত-পাকিস্তান রেল চলাচল শুরু হয় ১৯৭৬-এ। বিংশ শতাব্দীর শেষদিকেই ট্রেনের আধুনিকীকরণ শুরু হয়েছে পুরোদমে। আটের দশকে স্টিম ইঞ্জিনের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হল। আট থেকেই নয়ের দশকের মধ্যে বিদ্যুতের লাইন তৈরি হল প্রায় ৪৫০০ কিমি ট্র্যাকের ওপর। ১৯৮৫ থেকে চালু হল অনলাইন রিজার্ভেশন সিস্টেম। ১৯৯৫-এর মধ্যে গোটা দেশেই ছড়িয়ে পড়ল এই CONCERT (কান্ট্রিওয়াইড নেটওয়ার্ক অফ কম্পিউটারাইজড এনহ্যান্সড রিজার্ভেশন অ্যান্ড টিকেটিং)। একবিংশ শতাব্দীতে আইআরসিটিসি পেলাম আমরা। ২০০২ সালে শুরু হয়েছিল এই বুকিং। বর্তমানে ১ লক্ষ ২০০০০ কিমির বেশি রেললাইনের জাল ছড়ানো রয়েছে ভারতে। বর্তমানে প্রায় সাত হাজার রেল স্টেশনে ওয়াইফাই সংযোগের ব্যবস্থা হয়েছে। রেল মন্ত্রক বলছে, খুব দ্রুত এই সুবিধে আরও বাড়ানোর ব্যবস্থা করবে সরকার। অবশ্য ততদিনে সাধারণ মানুষ আর দূর পাল্লার ট্রেনে যাতায়াত করতে পারবেন কি না, এও ভেবে দেখার বিষয়। এক ট্রেনে সকল শ্রেণির যাত্রা নিকট ভবিষ্যতেই স্বপ্ন হয়ে উঠতে চলেছে আবার।