মহারাষ্ট্রের স্টিয়ারিং অটোচালকের হাতে, বিজেপির তুরুপের তাস একনাথ?

মহারাষ্ট্রের স্টিয়ারিং থাকল একনাথের হাতে। এ কি শুধুই বিজেপির দেওয়া পুরস্কার? বোধহয় না, এটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলেও একমাত্র কারণ নয়।

নতুন পাশার চাল। কিস্তিমাত। মহারাষ্ট্রের ডামাডোলের প্রধান কারিগর হিসেবে বারবার সামনে এসেছেন একনাথ শিন্ডে। কিন্তুন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এও বলেছেন, পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে গেছেন দেবেন্দ্র ফড়নবিস। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসতে পারলেন না। দুই বারের মুখ্যমন্ত্রীকে হতে হল একনাথের ডেপুটি। বিজেপি যাঁকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে আবার ক্ষমতায় ফিরল, তাকে পুরস্কার দেবে না, তা হয় নাকি! তাই মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বিদ্রোহী একনাথ। ডেপুটি দেবেন্দ্র। নাটকের এই পর্বের পেছনেও বিজেপির মাস্টার স্ট্রোকের গল্প। কী ভাবে?

মহারাষ্ট্রের কুর্সিতে বসলেন একনাথ শিন্ডে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথগ্রহণ করলেন শিবসেনার এই বিদ্রোহী নেতা। উপমুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলেন মহারাষ্ট্রের দু’বারের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিস।মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নাম ঘোষণার পর শিন্ডে বলেন, ‘‘বালাসাহেবের হিন্দুত্বের কথা ভেবে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের বিধায়করা নিজ নিজ কেন্দ্রে উন্নয়নমূলক কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’’ ফড়নবিসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শিন্ডে বলেছেন, ‘‘বিজেপির ১২০ জন বিধায়ক রয়েছে। তার পরও মুখ্যমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেননি ফড়নবিস। ওঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, অমিত শাহের প্রতিও কৃতজ্ঞ’’।

মহারাষ্ট্রের স্টিয়ারিং থাকল একনাথের হাতে। এ কি শুধুই বিজেপির দেওয়া পুরস্কার? বোধহয় না, এটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলেও একমাত্র কারণ নয়। একনাথের হাতে মহারাষ্ট্রের স্টিয়ারিং তুলে দেওয়ার পেছনে বিজেপির প্রধান উদ্দেশ্য আরেকটু গভীর, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে যা বিজেপির মাস্টার স্ট্রোক। এর দ্বারা এক ঢিলে দুই পাখি মারা হল বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। এক, একনাথ শিন্ডে এবং তাঁর অনুগামীদের উদ্ধব ঠাকরের দিকে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হল। দুই, উদ্ধব-সহ অন্যান্য বিরোধীরা বারবার বিজেপির বিরুদ্ধে ক্ষমতা হরণের যে অভিযোগ করছিল, তা বন্ধ করা গেল।

আরও পড়ুন-বাল ঠাকরের আদর্শ অতীত, মহারাষ্ট্রের স‌ংকটে নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ উদ্ধব ঠাকরের

দেবেন্দ্র ফড়নবিসকে মহারাষ্ট্রের উপ-মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এমনটাই জানালেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা। তিনি জানান, বিজেপি প্রমাণ করেছে যে দলের কারও পদের লোভ নেই। ফড়নবিস নিজেই সরকারের বাইরে থাকতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁকে একনাথ শিন্ডের ডেপুটি হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক মহল মন করছে, মহারাষ্ট্রে উদ্ধবের সরকার ভাঙার পেছনে বারবার দেবেন্দ্রর নাম নিয়েও চর্চা হয়েছে। তাই তাঁর যে পদের মোহ নেই, তা প্রমাণ করার দায় ছিল বিজেপির। সেইসঙ্গে শিবসেনা বারবার অভিযোগ করে, উদ্ধবের সরকার ফেলে দিতে চাইছে বিজেপি। এই অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার তাগিদ ছিল বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের?

বিজেপি তাঁকে ব্যবহার করলেও পুরস্কার পেয়ে খুশি শিন্ডে।

তিনি এদিন বলেন, ‘আমরা রাজ্য এবং বিধায়কদের নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নের জন্য মহা বিকাশ অঘাড়ি ত্যাগ করেছি। বিজেপির বেশি বিধায়ক থাকা সত্ত্বেও বালাসাহেবের সৈনিককে মুখ্যমন্ত্রী করার ফড়নবিসের সিদ্ধান্তকে আমি স্বাগত জানাই তাঁকে ধন্যবাদ জানাই'।

বিজেপির তাস, যাঁকে কেন্দ্র করে আবর্তিত মহা-নাটক

তাঁর রাগের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়ে তাঁকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করেছে বিজেপি। দু’দশকেরও প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি সঙ্গে যুক্ত। বরাবরই প্রচারের আলো থেকেও দূরে থাকতে ভালোবাসেন। চারবারের বিধায়ক। সামলেছেন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে একসময় অটোও চালিয়েছিলেন। ৫৮ বছরের সেই একনাথ শিন্ডেই এবার বসলেন মহারাষ্ট্রের কুর্সিতে। রাজনৈতিক গুরু আনন্দ দীঘে মৃত্যুর পর থানেতে শিবসেনার খুঁটি শক্ত করতে শিন্ডের বড় ভূমিকা ছিল।

১৯৬৪ সালে সাতারাতে জন্ম একনাথের। একাদশ শ্রেণির পর পড়াশোনা ছেড়ে দেন তিনি। ১৯৮০ সালে বালাসাহেব ঠাকরের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিবসেনা যোগ দেন। সেই সময় একাধিক আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন একনাথ। ৪০ দিন জেলও খাটেন শিন্ডে। একদা থানে শহরের অটো ড্রাইভার শিন্ডে ধীরে ধীরে দলে পরিচিতি লাভ করতে থাকেন। শীর্ষ নেতৃত্বের নজরেও আসেন। ১৯৯৭ সালে থানে পুরনিগমের কর্পোরেটর পদে বড় ব্যবধানে জয় পান।

২০০১ সালে থানে পুরনিগমের দলনেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০০৪ অবধি ওই পদে ছিলেন শিন্ডে। এর আগে মহারাষ্ট্র বিধানসভায় বিরোধী দলনেতার দায়িত্বও পালন করেছেন শিন্ডে। ২০১৪ সালে বিজেপি-শিবসেনা জোট সরকারের মন্ত্রীও হন। আচমকা কী কারণে শিন্ডে বিদ্রোহী হলেন, সেটাই ছিল লাখ টাকার প্রশ্ন। তবে চমক রয়েছে অন্য জায়গায়। যেই শিন্ডে সম্প্রতি উদ্ধবের ছেলে তথা রাজ্যের মন্ত্রী আদিত্য ঠাকরের সঙ্গে অযোধ্যা সফরেও গিয়েছিলেন, সেই শিন্ডের চালেই কিস্তিমাত হলেন উদ্ধব।

২০০৪, ২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের ভোটে সেনার টিকিটে মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে পরপর জয়ী হয়েছেন। যখন মহাবিকাশ অঘাড়ি সরকার তৈরি হয়, তিনি আরবান ডেভলপমেন্ট ও পাবলিক ওয়ার্কস দফতরের মন্ত্রী ছিলেন। পরে তিনি আরবান অ্যাফেয়ার্স দফতরের মন্ত্রী হন। শোনা যায়, সেনার নেতৃত্বের সঙ্গে ইদানিং তাঁর বনিবনা হচ্ছিল না। তিনি বেশ ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই কি এই গা ঢাকা? তিনি যে কারণেই গা ঢাকা দিন, মোদ্দা কথা হল, তাঁর রাগকেই কাজে লাগিয়েছে বিজেপি।

একনাথ সামনে, পেছনে বিজেপি

বিদ্রোহী একনাথ। আপাতভাবে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, তিনিই উদ্ধব সরকারের বাড়া ভাতে ছাই দিলেন। বিজেপির পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ার যে যথেষ্ট কারণ আছে, তা একেবারেই অগ্রাহ্য করার বিষয় নয়।

এমএলসি ভোটে বিজেপি-র কাছে হারের কয়েকঘণ্টা কাটতে না কাটতেই শিবসেনা দলে ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দেয়। প্রায় ২০ জন বিধায়ককে সঙ্গে নিয়ে ‘বেপাত্তা’ হয়ে যান মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন নগরোন্নয়ন মন্ত্রী একনাথ শিন্ডে। শিবসেনা নেতার এ হেন পদক্ষেপ ঘিরে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে শোরগোল পড়ে যায়। মহারাষ্ট্র বিধান পরিষদের নির্বাচনে শিবসেনার বিধায়কদের বিরুদ্ধে ক্রস ভোটিংয়ের অভিযোগের পর পরই বিধায়কদের নিয়ে ‘গা-ঢাকা’ দেন শিন্ডে। প্রথমে থাকেন সুরাটের হোটেলে, পরে যান গুয়াহাটি। এরপর শুরু হয় অঙ্ক কষা। সরকারের টিকে থাকা নিয়ে তখনই আশঙ্কা দেখা যায়।

এরপরে জল গড়ায় সুপ্রিম কোর্টে। বুধবার রাতে রাজ্যপালের নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ চেয়ে শিবসেনার তরফে জানানো আবেদন দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘন্টা শুনানির পর নাকচ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি সূর্যকান্ত এবং বিচারপতি জেবি পাড়িয়ালার বেঞ্চ রাজ্যপাল নির্দেশিত নির্ঘণ্ট মেনেই আস্থাভোট গ্রহণের নির্দেশ দেয়। এর পরেই ‘ফেসবুক লাইভ’ করে পদত্যাগের কথা জানান উদ্ধব ঠাকরে। তারপর নতুন সরকার গড়ার আনন্দে বিজেপির অন্দরে খুশির হাওয়া। মুখ্যমন্ত্রী হবেন দেবেন্দ্র ফড়নবিস, এ আর কী এমন আশ্চর্যের।

২০১৪-১৯ মহারাষ্ট্রে বিজেপি-শিবসেনা জোটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন দেবেন্দ্র ফড়নবিস। ২০১৯ এর বিধানসভা ভোটের পর শিবসেনার সঙ্গে জোট ভেঙে যাওয়ায় এনসিপি প্রধান শরদ পাওয়ারের বিদ্রোহী ভাইপো অজিতের সমর্থন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন দেবেন্দ্র। অজিত হন উপমুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এনসিপি পরিষদীয় দলে ভাঙন ধরাতে ব্যর্থ হয়ে ৮০ ঘণ্টার মধ্যে ইস্তফা দিতে হয়েছিল তাঁকে। সেই জ্বালা যে তিনি ভুলতে পারেননি, এই সত্যিটা বোঝার জন্য বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। তাই হয়ত তাঁর পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ার এত তাগিদ! এক্ষেত্রে তিনি পাশে পেয়ে যান গোসা ঘরে খিল দেওয়া বিদ্রোহী একনাথকে। এত করেও রাজনীতির খেলা এতই ক্রূর, এবারও আর তাঁর রাজার মুকুট পরা হল না!

More Articles