যতবার বিদ্রোহ ততবার আঙুল ডিপ স্টেটের দিকে, কী এই ডিপ স্টেট?
Deep State: ডেভিড রকফেলারকে ডিপ স্টেটের আধুনিক প্রতিষ্ঠাতা বলে থাকেন অনেকে। ১৯৭৩ নাগাদ ডেভিড ৮৭ জন ধনী, ক্ষমতাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেন ‘ট্রাইলেটারাল কমিশন’। যাদের মূল লক্ষ্যই ছিল...
গত কয়েক বছরে আমাদের প্রাত্যহিক লব্জে ঢুকে পড়েছে ডিপ স্টেট শব্দটি। গত কয়েক বছরে গণ অভ্যুত্থান কম হয়নি। আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলিকেই রাগে ফুঁসতে দেখেছি। প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কায় গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন হয়েছে রাজপাক্ষে সরকারের। তারপরই দেখেছি বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের তালিকায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন নেপালের জেন জি বিদ্রোহ। বিদ্রোহের ঝাঁঝ যত বেড়েছে, ততই সামনে এসেছে ডিপ স্টেট তত্ত্ব। প্রশ্ন হচ্ছে, কী এই ডিপ স্টেট? কাকে বলে ছায়া রাষ্ট্র? ছায়া রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলি ঠিক কী? কী ভাবে শনাক্ত করা যায় এই ডিপ স্টেটের কার্যকলাপ।
‘ডিপ স্টেট’, ‘স্টেট উইদিন স্টেট’ বা ‘শ্যাডো গভর্নমেন্ট’ একটি ধারণা, যা একটি ছায়া রাষ্ট্রের কথা বলে। ছায়া রাষ্ট্র এমন একটি রাষ্ট্র যার নির্দিষ্ট কোনও অবয়ব নেই। কিন্তু যার আদ্যোপান্ত নিয়ন্ত্রণ রয়েছে একটি নেপথ্য সংগঠনের হাতে। যে সংগঠন দিনের আলোয় প্রকাশ্যে কাজ করে না। যার উপস্থিতি অনেকটা প্রহেলিকাময়, ধাঁধার মতো। ছায়রাষ্ট্রের প্রতিনিধি যেন রক্তকরবীর রাজা।
‘ডিপ স্টেট ’ তত্ত্ব পৃথিবীতে প্রথম পরিচিতি পায় ১৯২৩ সালের পর। তুরস্কে তখন অটোমান শাসনের সবে সবে পতন ঘটেছে। রাষ্ট্র শাসকহীন হয়ে গেলে বিপদ। একই সঙ্গে নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বজায় রাখাটাও অত্যন্ত জরুরি। এমতাবস্থায় সে দেশের সামরিক গোয়েন্দা তথা আমলাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত কর্মীদের একাংশ মিলে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। যারা একজন প্রতিনিধিকে সামনে রেখে আড়াল থেকে নিজেদের কার্য সম্পাদনা করতেন। সেই প্রথম এই ধারণার একটি সুসজ্জিত রূপ জনসমক্ষে প্রকাশ্যে আসে।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে ‘ডিপ স্টেট’-এর ভূমিকা ছিল? যা বললেন ডোনাল্ড ট্রাম্প
তারপর ১৯৭৩ সাল। ডেভিড রকফেলার, যাকে ডিপ স্টেটের আধুনিক প্রতিষ্ঠাতাও বলে থাকেন অনেকে। ১৯৭৩ সাল নাগাদ ডেভিড ৮৭ জন ধনী, ক্ষমতাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেন ‘ট্রাইলেটারাল কমিশন’। যাদের মূল লক্ষ্যই ছিল একটা নতুন বিশ্ব গড়ে তোলা। এই কমিশনের বহু সদস্যই পরবর্তীকালে আমেরিকা-ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় পদ সামলেছেন। যেমন, জিবনিউ ব্রেজিনস্কি। তিনি ছিলেন ট্রাইলেটারাল কমিশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং বারাক ওবামার শিক্ষকও। এই মিশনের অন্যতম দুই সদস্য লুকাস পাপাডোমস এবং মারিও মন্টিও পরবর্তীতে গ্রিস ও ইতালির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। তবে এই সংগঠনের বেশিরভাগ সদস্যই বিশ্বব্যাঙ্কের শীর্ষস্থানগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে বুশ, ক্লিনটন, ডিক চেনি, আল গোরও প্রমুখের নাম বিশ্বে উল্লেখযোগ্য। একটা লম্বা সময় ধরে এঁরা সমগ্র বিশ্ব অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করে এসেছেন।
২০১৬ সালের পর ফের একবার বিশ্ব রাজনীতির ময়দানে ডিপ স্টেটের চর্চা শুরু হয়। ভারতের দুই প্রতিবেশী দেশ, বাংলাদেশ ও নেপালের গণ অভ্যুত্থানের ঘটনা ডিপ স্টেটকে পুনরায় একবার সংবাদ শিরোনামে তুলে আনে। উভয় ঘটনারই একটি সাদৃশ্যতা আছে। এক দলের নবজাগরণ এবং তার ফলে প্রতিষ্ঠিত শাসকের অবসান। ফলত, বিভিন্ন সংস্থা এবং বেশকিছু সংবাদমাধ্যম উভয় দেশের ঘটনাই ডিপ স্টেট দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে করছেন। বাংলাদেশের বেশ কিছু স্বদেশীয় সংস্থার দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতনের মার্কিন ডিপস্টেটের হাত রয়েছে।
কিন্তু হঠাৎ আমেরিকা কেন? আসলে ট্রাম্পকে চালনা করতেন যেসব মাথা তার মধ্যে একজন ছিলেন স্টিভ ব্যানন। ২০১৬ সালে স্টিভ ব্যানন বলেন— মার্কিন রাজনীতি, প্রশাসনিক কাঠামো, বাণিজ্যিক, অথনৈতিক কাঠামোর উন্নয়নে ডিপ স্টেটের নবায়ন প্রয়োজন। এবং ২০২৪ সালে নির্বাচনী প্রচারে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, তিনি ফের ক্ষমতায় এলে ডিপ স্টেটকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবেন।
আরও পড়ুন- নেপালের গণ অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের ছায়া কতটুকু?
তারপর বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং নেপালের জেন জি-দের আন্দোলন যেখানে যেখানে হয়েছে, সেখানেই কথা উঠেছে ডিপ স্টেটের। ডিপ স্টেটের প্রভাবেই নাকি জেন জি-দের উত্তেজিত করা হয়েছে। কিন্তু ডিপ স্টেট কী ভাবে প্রভাব ফেলছে জেন জি-দের উপর? বিশেষজ্ঞদের মতে, আমেরিকা একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য এখন দক্ষিণ এশিয়া। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সব আন্দোলনই হয়েছে ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিতে। ভারতের উপর চাপ দিতেই ডিপ স্টেটের এই চাল, এমনটাও মত অনেকের। একাংশের মত, লড়াইটা আমেরিকা ও চিনের কিন্তু ভারতও অদূর ভবিষ্যতে এই লড়াইয়ের অংশীদার হতে পারে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনওই সেটা চায় না। আবার বাকিদের মতে, আমেরিকা কখনোই চায় না তার প্রতিদ্বন্দ্বী চিনের কোনও মিত্র চালনা করুক কোনও রাষ্ট্র। ডিপ স্টেটের সমর্থকরা বলেন, শেখ হাসিনা চিন সরকারের মিত্র ছিলেন। কিন্তু তাঁকে সরিয়ে এসেছেন মার্কিন ঘনিষ্ঠ মুহাম্মদ ইউনূস। ডিপ স্টেট ব্যাপারটা নাকি এরকমই।
ডিপ স্টেট আসলে কী?
ডিপ স্টেট একটি ধারণা বা তত্ত্ব। যা ইঙ্গিত করে এমন এক অদৃশ্য-অপ্রকাশিত শক্তি কিংবা সংগঠনের দিকে, যে বা যারা রাষ্ট্রের ভিতর নির্বাচিত সরকার কিংবা জনগণের ইচ্ছার বিপরীত প্রান্তে থেকে ক্ষমতার পরিচালনা করেন। একটু সহজ করে বললে, আড়ালে থেকে একটি সরকারকে পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করা শক্তিকে বোঝায়। অর্থাৎ আমি-আপনি ভোট দিয়ে একটা সরকারকে ক্ষমতায় আনছি। আমরা ভাবছি তিনিই দেশ এবং দশের চালনার মূল কারণ। কিন্ত, আদতে গল্পটা অন্য। এক্ষেত্রে আমাদের নির্বাচিত সরকার প্রতিনিধি মাত্র। কার প্রতিনিধি? সাধারণের! না। গোপনে থাকা সেই তৃতীয় সংগঠনটির, যারা তাকে বিভিন্ন ভাবে প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। ডিপ স্টেট একটি হাইব্রিড নেটওয়ার্ক। যা সরকারি, কর্পোরেট এবং বেসরকারি কর্মীদের সংমিশ্রনে গঠিত। এঁরা প্রত্যেকেই ক্ষমতাশালী। এঁরা নীতি নির্ধারণ নিয়ন্ত্রণ করেন, নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ করেন।
আরও পড়ুন- নেপাল ২০০৮-২০২৫ || কী ভাবে পড়ব এই সময়কে?
ডিপ স্টেট কী ভাবে কাজ করে?
প্রভাবশালী কর্পোরেশন, গোয়েন্দা সংস্থা ও ব্যাঙ্কিং সেক্টরের মাধ্যমে ডিপ স্টেট রাষ্ট্রের নীতির ওপর প্রভাব ফেলে। এছাড়া গণমাধ্যম, প্রোপাগান্ডা , ইনফ্লুয়েন্সার এবং বিভিন্ন সমাজমাধ্যমকে হাতিয়ার করে সাধারণ জনগণের মনোভাব ও ধারণাকে প্রভাবিত করে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করে গোপনে নজরদারি রেখে তাঁদের উপর প্রভাব বিস্তার করে। যাতে ডিপ স্টেটের ইচ্ছা মতো তাঁরা কাজ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে FBI বা CIA-এর নাম যেমন উঠে আসে, তেমনই পাকিস্তানের সরকারের ক্ষেত্রে তাদের প্রশাসনিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করে সে দেশের সামরিক বাহিনী। এছাড়াও বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বা NGO-তে অর্থ বিনিয়োগকারী বেশ কিছু বৈদেশিক সংস্থা আছে। যারা এনজিওগুলিকে কাজে লাগায় দেশের জনগণের মগজ ধোলাই করতে। নেপালে জেন জি-দের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যম এমনটাই দাবি করেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, নেপালের গণ অভ্যুত্থান যতটা না মৌলিক ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল প্রভাবিত। আর এই প্রভাবকে তারা ডিপ স্টেটের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আন্দোলনকে মদত যোগায় সুদান গুরুংয়ের NGO 'হামি নেপাল'। এই বেসরকারি সংস্থায় যারা অর্থ বিনিয়োগ করে তাদের নাম দেখলে পাওয়া যায় 'Barbara foundation' এবং 'Infinity holdings'-এর নাম। Barbara Foundation USA-এর উদ্দেশ্য হল যুক্তরাষ্ট্রে অবহেলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কল্যাণ, সামাজিক অবস্থার উন্নতি এবং নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষা। এবং বারবারা ফাউন্ডেশন (নেপাল)-এর বিরুদ্ধে নেপালে বিভিন্ন আন্দোলন ও প্রতিবাদে অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, অস্ত্র ব্যবসায়ী দীপক ভট্টর Infinity foundation, হামি নেপালের সমর্থক। দীপকের বিরুদ্ধে একটি ইতালীয় কোম্পানির জন্য বন্দুক কেনার চুক্তিতে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। 'ডিপ স্টেট' প্রসঙ্গে জর্জ সরোসের নামও বারবার এসেছে। এই ধনকুবেরকে অমুক অমুকের জন্য দায়ী করেন দক্ষিণপন্থীরা। যদিও তাঁরা কখনোই এই দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ জনসমক্ষে আনতে পারেননি।

Whatsapp
