নেপালের গণ অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের ছায়া কতটুকু?
Nepal Gen Z protest: কোভিডের মতো ঘাতক মহামারীকে গা-ছাড়া ভাবে নিয়েছিলেন ওলি। ফলে শিক্ষিত যুক্তিবাদী ছেলেমেয়েরা তাঁকে নিয়ে কখনই খুশি ছিল না। সেই দলে যোগ দিয়েছে সুযোগসন্ধানী দক্ষিণপন্থীরা।
ইতিহাস বলছে বিপ্লবের নেপথ্যে থাকে কোনো মহৎ সামাজিক ন্যায়প্রতিষ্ঠার অভীপ্সা। আর সেই লড়াইয়ে পুরোভাগে নেতৃত্বদান করেন বিদ্রোহী স্পার্টাকাস। একুশ শতকের অভ্যুত্থানের কোনো একক নায়ক নেই। কোনো একটি পক্ষ নেই, এমনকী কোনো সুপরিকল্পনাও নেই। রয়েছে অসংখ্য স্টেকহোল্ডার। বেয়াড়া রোখ। কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম, যেখানে বামপন্থী-ডানপন্থীকেও জনস্রোতে একসাথে দেখা যেতে পারে। বিশ শতকের চশমায় এই ঘটনাপ্রবাহকে দেখে যিনি ভিড়মি খাবেন তাঁর জন্যে আরও বিস্ময় বাকি। একটি বিপ্লবের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ফল কোনো অলিগার্ক পাবে, সেই অলিগার্কের থাকা না থাকাই এত বড় হয়ে যাবে যে শাসককে গদিচ্যুত করবে মানুষ, স্মরণাতীত কালে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা কঠিন। নেপালের ছাত্রজনতার বিদ্রোহকে আপাত ভাবে দেখলে কিন্তু তেমনটাই মনে হবে। মনে হবে, ফেসবুক ট্যুইটারের মতো সারভিলেন্স অর্থনীতির প্রধান স্থপতির অনুপস্থিতি একদল ছেলেমেয়েকে পথে নামাল, তারা বুকে গুলি খেল, শাসককে টেনে নামাল। অথচ এই ফেসবুকের বিপজ্জনক অ্যালগোরিদমই হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বাস্তুচ্যুত করেছিল। তাহলে কি নব্যপুঁজিবাদ রোবট মব পেয়ে গেল?
ঘটনাপ্রবাহ দেখতে দেখতে অবধারিত ভাবেই মনে পড়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানের কথা। কেপি ওলি শর্মার সঙ্গে শেখ হাসিনার মিল অনেক। দু'জনেই বারবার ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন, গদিচ্যুত হতে পারেন তা শেষমুহূর্ত পর্যন্ত আঁচ করতে পারেননি। একই ভাবে দু'জনকে সেফ প্যাসেজ দিয়েছে সেনা। উন্মত্ত জনতা রোষের চেহারা ৩২ ধানমন্ডির সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছিল এই প্রতিবেদক। আজ একই ভাবে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যখন আগুন ধরাচ্ছে উন্মত্ত মানুষ, সেই অগ্নি নির্বাপনের জন্যে অপেক্ষমান হাজারো প্রশ্ন। স্রেফ সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করার দায়েই সরতে হলো কেপি শর্মা ওলিকে? নেপালের ভবিষ্যত ভারত না চিন কোন দেশের চাপে পরাভূত হবে নেপাল? কে হবেন নেপালের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী?
আরও পড়ুন- ভারতে মেডিক্যাল ট্যুরিজমের রমরমা! কেন একদিকে মুনাফা অন্যদিকে হতাশা?
২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করার নেপালে জেন জি অভ্যুত্থানের চুম্বক। কেপি ওলি কখনও বোঝেননি নতুন প্রজন্মের কাছে সোশ্যাল মিডিয়া স্রেফ যোগাযোগের মাধ্যম নয় বরং মতপ্রকাশের মাধ্যম। সেই যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার অর্থ মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। কন্ঠরোধ। কন্ঠোরোধ করলে এই অবদমনের ফল হবে তৎক্ষণাত, আছড়ে পড়বে দ্বিগুণ শক্তিশালী টর্নেডো হয়ে। ঠিক বাংলাদেশে ইন্টারনেট শাটডাউন যেভাবে হিতে বিপরীত হয়ে ফিরে এসেছিল। এই সিদ্ধান্ত আসলে তরুণ প্রজন্মের স্নায়ু সংবেদ না বোঝারই ফল। মনে রাখতে হবে, অতীতেও ক্ষমতায় এসে (২০১৮-২০২১) কেপি ওলি ডিজিটাল টেকনলজি বিল সামনে এনেছিলেন যা আসলে কণ্ঠরোধের ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখেছিল সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ আজকের রাগের পূর্বাপর রয়েছে। এই রাগ যখন স্ফূলিঙ্গে পরিণত হচ্ছে, তখন কেপি ওলির নির্দেশে সেনা গুলি চালাল। অন্তত ১৯জন প্রতিবাদীর প্রাণ গেল। নেপাল এত বড় গণহত্যা জনযুদ্ধের (২০০৬) পর নেপালে ঘটেনি। ফলে জেন জি-র কোনো পূর্বস্মৃতি নেই। এই আকস্মিকতায় তারা বদলার দাবিতে মারমুখী হয়ে ওঠে। আর সেটাই হয়ে দাঁড়ায় এই বিদ্রোহের টার্নিং পয়েন্ট। ঠিক যেমন আবু সইদ, মীর মুগ্ধদের মৃত্যুতে কোটা সংস্কার আন্দোলন অন্য মাত্রা নেয়। নেপালের তরুণ তরুণীরা ১৯টি প্রাণ ঝরে যাওয়ার পর শুধু যে বাড়ি ফিরতে চায়নি তা-ই নয়, তারা বারবার বলেছে, শেষ দেখতে চাই। কেপি ওলির ইস্তফাতেও তারা খুশি নয়। তাদের দাবি বিচার।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কোটা সংস্কারকে ঘিরে শুরু হলেও তার শিকড় ছিল অনেক গভীরে প্রোথিত। পরপর দুটি নির্বাচনকে সন্দেহাতীত ভাবে প্রহসনে পরিণত করেছিলেন শেখ হাসিনা। নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে ক্ষমতায় এসে কেপি ওলি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সংবিধানিক সংস্কার, সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেসবই কথার কথা হয়ে থেকে গিয়েছে। এ বছরই জুলাই মাসে ওলির ক্যাবিনেট মন্ত্রী রাজকুমার গুপ্ত এবং বলরাম অধিকারীকে ৭.৮ মিলিয়ন এবং ৩.২ মিলিয়ন টাকা ঘুষ চাওয়ার অভিযোগে পদত্যাগ করতে হয়। তাদের অডিও টেপ সামনে এসেছিল। ভিজিট ভিসা স্ক্যামে নাম জড়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখকের। যেখানে কাজের জন্যে বিদেশ যাওয়ার ভিসা দিয়ে অবৈধভাবে টাকা তোলা হয়। ঠিক বাংলাদেশের মতোই 'নেপোকিড'দের বিলাস-বৈভবে মোড়া জীবন দিনগত পাপক্ষয়ে জীবন কাটানো সাধারণ ছেলেমেয়েদের চক্ষুশূল হয়েছে নেপালে।
চটেছে সাধারণ মানুষ, উঠে এসেছে সব পক্ষ। মানুষ বুঝেছে মুখে সততার কথা বললেও ওলি কোনো সংস্কারের পথে হাঁটবে না। ছাত্র, শিক্ষক সবস্তরের মানুষ ক্রমে সুর চড়িয়েছে। কোভিডের মতো ঘাতক মহামারীকে গা-ছাড়া ভাবে নিয়েছিলেন ওলি। ফলে শিক্ষিত যুক্তিবাদী ছেলেমেয়েরা তাঁকে নিয়ে কখনই খুশি ছিল না। সেই দলে যোগ দিয়েছে সুযোগসন্ধানী দক্ষিণপন্থীরা। রয়েছে জোট সরকারে অর্থবান প্রতিপক্ষ, রয়েছে রাজতন্ত্রের কায়েমী স্বার্থ। এভাবে ভাবলেও বাংলাদেশের সঙ্গে চরিত্রগত ভাবে মিল পাওয়া যাবে নেপালের।
আরও পড়ুন- নেপালে জেনারেশন জি-এর বিপ্লব, কেন ফুঁসছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা
বাংলাদেশের সঙ্গে এই আন্দোলনের মূলগত ফারাক লাভের প্রশ্নে। হাসিনা সরকারকে যে কারণে দিল্লির পুতুল সরকার বলা হয়, নিসন্দেহে ওলির সরকারকে সেই একই কারণে চিনের ক্রীড়ানক বলা যেতে পারে। ২০২০ সালের জুনেই নতুন মানচিত্রে সিলমোহর দেন ওলি। সেই ম্যাপে ভারতের প্রায় ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে নিজেদের বলে দাবি করে নেপাল। অভিযোগ, টিকে থাকতে উগ্র জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেমই হাতিয়ার ছিল ওলির। এই মানচিত্র সামনে আসার আগে চিনের রাষ্ট্রদূত হোউ ইয়ানকির সঙ্গে ঘনঘন বৈঠক করেছিলেন ওলি। এই সময়েই ওলি দাবি করেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম অবতার রাম নেপালের রাজপুত্র ছিলেন এবং অযোধ্যর অবস্থান নেপালেই ছিল। আরএসএস মুখপত্র বারবার ওলির প্রগলভতার সমালোচনা করেছে।
হাসিনা সরকারের পতনের পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বে নেন মুহাম্মদ ইউনূস। বাংলাদেশের গণ অভ্য়ু্ত্থানকে মেটিক্যুলাসলি ডিজাইনড বলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন পরিকল্পিত। নেপালে এই বিদ্রোহের পর অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে উঠে আসছে বলেন্দ্র শাহ-র নাম। বলেন্দ্র কর্ণাটকে পড়াশোনা করেছেন। স্বাধীন প্রার্থী হিসেবে ভোটে জিতেছেন। বদলে দিয়েছেন নেপালের বহু সমীকরণ। যুবসমাজে তাঁর জনপ্রিয়তা তুলনারহিত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে র্যাপ লিখে জনপ্রিয় হয়েছেন। রাষ্ট্রপরিচালিত হত্যার বদলা চাইতে তাঁর বৃষস্কন্ধেই ভরসা রাখবে ক্লান্তপ্রাণ জেন জি? তিনিও কি একটি পরিকল্পিত অভ্যুত্থানের 'মাস্টারমাইন্ড'? দাবার বোর্ডের অশ্ব? নাকি বোড়ে?

Whatsapp
