কেন সাতটি নতুন জেলার সিদ্ধান্ত মমতার? জানুন আসল কারণ

জেলা ভেঙে নতুন জেলা তৈরি করা ভারতের প্রত্যেকটি রাজ্যের ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। আর এই জেলা ভাগ করার কারণ সব জায়গাতেই প্রায় সমান। যদি কোনও জেলা আকারে ছোট হয়, তাহলে সেই জেলা পরিচালনা হয় অনেকটাই সহজ।

১ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলায় নতুন সাতটি জেলা তৈরি করার কথা ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ, এবারে পশ্চিমবঙ্গর জেলা-সংখ্যা ২৩ থেকে বেড়ে হলো ৩০। এই নতুন জেলাগুলির মধ্যে রয়েছে সুন্দরবন, বসিরহাট, বিষ্ণুপুর, ইছামতি, রানাঘাট, বহরমপুর এবং কান্দি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই উত্তর ২৪ পরগনা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা ভাগ করার প্রস্তাব এনেছিলেন। তবে সেই সময় এই জেলা ভাগ করা না হলেও, ২০২২-এর স্বাধীনতা দিবসের আগেভাগেই এক নতুন চমক নিয়ে হাজির হলেন মুখ্যমন্ত্রী।

একটি প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত হয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা ভেঙে সুন্দরবন নামের একটি আলাদা জেলা গঠন করা হয়েছে। এর আগেই যদিও সুন্দরবন পুলিশ ডিভিশন ভাগ করা হয়েছিল। অন্যদিকে উত্তর ২৪ পরগনা জেলাকে ভেঙে তৈরি হবে দু'টি নতুন জেলা- ইছামতি এবং বসিরহাট। ইছামতি জেলাটি তৈরি হবে বনগাঁ এবং বাগদা ডিভিশন মিলিয়ে। অন্যদিকে, বসিরহাট হবে স্বাধীন একটি জেলা। পাশাপাশি, নদিয়া জেলাকে ভেঙেও তৈরি করা হয়েছে একটি পৃথক জেলা- রানাঘাট। বাঁকুড়াকে ভেঙে তৈরি হয়েছে বিষ্ণুপুর। অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ জেলা ভাগ হচ্ছে তিনটি ভাগে। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে মুর্শিদাবাদ জেলা আকারে অনেকটাই বড়। তাই মুর্শিদাবাদ জেলা ভেঙে তিনটি জেলা তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মুর্শিদাবাদ ভেঙে তৈরি হবে দু'টি নতুন জেলা বহরমপুর এবং কান্দি। অন্যদিকে, মুর্শিদাবাদ জেলাটির নাম পরিবর্তিত হয়ে হবে জঙ্গিপুর। জেলার ভাঙা-গড়ার পর্ব শুরু হতে না হতেই শুরু হয়েছে বিতর্কের পালা। বিজেপি দাবি করছে, নাম পরিবর্তন না করে মুর্শিদাবাদকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা উচিত। অন্যদিকে, কংগ্রেস দাবি করছে, মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ভুলে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

জেলা ভেঙে নতুন জেলা কেন তৈরি হয় ভারতে?
জেলা ভেঙে নতুন জেলা তৈরি করা ভারতের প্রত্যেকটি রাজ্যের ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। আর এই জেলা ভাগ করার কারণ সব জায়গাতেই প্রায় সমান। যদি কোনও জেলা আকারে ছোট হয়, তাহলে সেই জেলা পরিচালনা হয় অনেকটাই সহজ। প্রশাসনকে একত্র করে সেই জেলার অভ্যন্তরীণ কাজকর্ম পরিচালনা এবং প্রশাসনের সকলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হয় সহজ। অনেক সময় আবার স্থানীয় দাবি মেনেও করা হয়ে থাকে এই জেলা ভাগের কাজ।

আরও পড়ুন: পার্থ প্রথম নন, এর আগেও প্রকাশ্যে গণরোষের শিকার হয়েছেন যে মন্ত্রীরা

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে, অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ওয়াইএস জগনমোহন রেড্ডি অন্ধ্রপ্রদেশে ১৩টি নতুন জেলার শিলান্যাস করেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনী প্রচারের সময় তিনি এই ১৩টি নতুন জেলা তৈরি করার ঘোষণা করেছিলেন। আর চলতি বছরের এপ্রিলে তাঁর কথা রাখলেন অন্ধপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর ভাষণে তিনি বলছেন, বিকেন্দ্রীকৃত এবং অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের প্রশাসন পরিচালনা অনেক সহজ এবং প্রশাসনের অভ্যন্তরেও থাকে স্বচ্ছতা। পাশাপাশি মাথায় রাখা হয় সেই জেলার উন্নয়নের কথাও।

জেলা ভাগ করার এই কারণগুলি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও একইরকমভাবে প্রযোজ্য। ২০১১ সালের জনসংখ্যা রিপোর্ট অনুযায়ী, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের ২৩টি জেলার প্রত্যেকটিতে গড়ে ৪০ লক্ষ মানুষ বসবাস করেন। অর্থাৎ, জনসংখ্যার দিক থেকে দেখতে গেলে, ভারতের অন্যান্য রাজ্যের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি রাজ্যের গড় জনসংখ্যা অনেকটাই বেশি। এতদিন পর্যন্ত অন্ধ্রপ্রদেশে ১৩টি জেলার প্রত্যেকটিতে গড়ে বসবাস করতেন ২০ লক্ষ মানুষ। জগন্মোহন রেড্ডি এই ১৩টি জেলা ভেঙে ২৬টি জেলা তৈরি করার পর অন্ধ্রপ্রদেশের প্রতিটি জেলার গড় জনসংখ্যা নেমে এসেছে প্রায় ১০ লক্ষর ঘরে। পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে এই সংখ্যাটা প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। শুধুমাত্র, উত্তর ২৪ পরগনা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলাতেই জনসংখ্যা ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী যথাক্রমে ১ কোটি এবং ৮০ লাখ। যেখানে উত্তর ২৪ পরগনা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার আয়তন যথাক্রমে ৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার।

কাদের নির্দেশে হয় এই জেলা ভাগ?
ভারতের কোনও একটি রাজ্যের জেলা ভাগের সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে সেই রাজ্যের রাজ্য সরকারের হাতে। বিধানসভা অথবা বিধান পরিষদে একটি বিশেষ বিল পাশ করে অথবা একটি আদেশনামা জারি করে রাজ্য সরকার এই জেলা ভাগ করতে পারে। এই জায়গায় কেন্দ্রীয় সরকার কোনওরকম অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ করতে পারে না।

কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে বিষয়টা তখনই পৌঁছয়, যখন সেই এলাকার কোনও রেলস্টেশন অথবা কোনও একটি জেলার নাম পরিবর্তন করা হয়। তবে যদি রাজ্য সরকারের হাতে নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট থাকে, তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে খুব একটা বেশি কিছু বাকি থাকে না।

বিগত কয়েক বছরে কতগুলি জেলা তৈরি হয়েছে ভারতে?
বিগত কয়েক দশক যাবৎ ভারতে জেলার সংখ্যা একটা নির্দিষ্ট হারে বৃদ্ধি পেতে থেকেছে। ২০০১ সালের জনগণনা অনুসারে ভারতে সর্বমোট জেলার সংখ্যা ছিল ৫৯৩। ২০১১ সালের জনগণনার সময় এই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় ৬৪০-এ। এই মুহূর্তে ভারতে প্রতিটি রাজ্য মিলিয়ে সর্বমোট জেলার সংখ্যা ৭৭৫। ভারতের সবথেকে বেশি জেলা রয়েছে উত্তরপ্রদেশে। এই রাজ্যে বর্তমান জেলার সংখ্যা ৭৫। তারপরেই রয়েছে মধ্যপ্রদেশ, যেখানে বর্তমান জেলার সংখ্যা ৫২। অন্যদিকে গোয়ায় জেলার সংখ্যা সব থেকে কম, ২।

রাজ্যের আয়তন অথবা তার জনসংখ্যার নিরিখে কখনওই জেলার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় না। জেলার সংখ্যা বৃদ্ধি করা অথবা হ্রাস করা সম্পূর্ণরূপে সেই রাজ্যের সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি লোকসভা আসন রয়েছে। অন্যদিকে ১ আগস্ট ৭টি নতুন জেলা ঘোষণার পরে সর্বমোট জেলার সংখ্যা হতে চলেছে ৩০। অন্যদিকে, অন্ধ্রপ্রদেশে যেখানে এই মুহূর্তে জেলার সংখ্যা ২৬, সেখানেই লোকসভা আসনের সংখ্যা মাত্র ২৫। আবার, তামিলনাড়ুতে যেখানে ৩৯টি লোকসভা আসন রয়েছে, সেখানে জেলার সংখ্যা মাত্র ৩৮। লোকসভা আসনের সংখ্যা অনুযায়ী উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের পরেই তামিলনাড়ুর অবস্থান হলেও, জেলা-ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেকখানি এগিয়ে তামিলনাড়ু। অর্থাৎ, কোনও রাজ্যে জেলার সংখ্যা নির্দিষ্ট কোনও ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে না। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য মাঝেমধ্যেই সেই নির্দিষ্ট রাজ্যের রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জেলার সংখ্যা কমবেশি করা হয়। আর সেটা সম্পূর্ণরূপে সেই রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়, কেন্দ্রীয় সরকার বা অন্যান্য রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপ এখানে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

মমতা কেন নিলেন এমন সিদ্ধান্ত?
মমতার এই জেলাভাগের সিদ্ধান্তের পিছনে বহু কারণ থাকতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, উত্তর ২৪ পরগনা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো কিছু জেলায় জনসংখ্যার পরিমাণ এতটাই বেশি যে, শুধুমাত্র একটি সদর শহরের মাধ্যমে পুরো জেলার প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা খুবই কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার পাশাপাশি, বাঁকুড়া, নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদ, জনসংখ্যার নিরিখে এই তিনটি জেলাও খুব একটা পিছিয়ে নেই। তাই সঠিক কারণ না জানালেও, সম্ভবত জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্যই এই জেলা ভাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

 

More Articles