পার্থ প্রথম নন, এর আগেও প্রকাশ্যে গণরোষের শিকার হয়েছেন যে মন্ত্রীরা

এই প্রথম নয়, এর আগে এই দেশের নানা প্রান্তে হেভিওয়েটদের লক্ষ্য করে জুতো ছোড়া হয়েছে। এই প্রবণতা হাত থেকে রেহাই পায়নি মার্কিন মুলুকও।

নিয়োগ দুর্নীতির আগুনে ফুটছে রাজ্য। ক্ষোভের আগুন যে কতটা গনগনে হতে পারে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল ২ অগাস্ট। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দিকে আচমকা ছুটে এল চটি। তবে এই প্রথম নয়, এর আগে এই দেশের নানা প্রান্তে হেভিওয়েটদের লক্ষ্য করে জুতো ছোড়া হয়েছে। এই তালিকায় কাদের নাম করা যায়, সেই নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে বলা দরকার, এই প্রবণতা হাত থেকে রেহাই পায়নি মার্কিন মুলুকও। সারা বিশ্ব দেখেছে, জুতো ছুটে আসায় কীভাবে জর্জ ডব্লিউ বুশের মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপের পার্সোনালিটিও এক ঝটকায় খানিক ম্লান হতে পারে, সেই সঙ্গে বিব্রত, অসহায় হতে পারে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীরা।

পার্থকে চটি, লক্ষ্যভ্রষ্ট
আদালতের নির্দেশ মেনে প্রতি ৪৮ ঘণ্টায় ১ বার করে ইডি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে চলেছে। মঙ্গলবার তাঁকে আনা হয় জোকা-র ইএসআই হাসপাতালে। হাসপাতালের বাইরে তখন সাংবাদিকদের ভিড়। এসেছেন কৌতূহলী মানুষ। পরীক্ষার পর পার্থবাবুকে বের করে গাড়িতে তুলতে যাবেন ইডি আধিকারিকরা, ঠিক তখনই প্রায় সকলকে অবাক করে পার্থর দিকে উড়ে এল মহিলাদের একপাটি চটি।

এই পরিস্থিতি বোঝার আগেই ফের আরও একপাটি উড়ে এল পার্থবাবুকে লক্ষ্য করে। নিরাপত্তারক্ষীরা প্রায় ঠেলে পার্থবাবুকে গাড়িতে তুলে দেন। ইডি আধিকারিকরা তাঁকে নিয়ে রওনা দেন। কিন্তু কে এই ঘটনা ঘটাল?

আরও পড়ুন: পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের উত্থান ও পতন

এক মধ্যবয়সি মহিলা পা থেকে চটি খুলে পার্থকে নিশানা করে মারেন। তাঁর নাম শুভ্রা ঘরুই, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার আমতলার বাসিন্দা তিনি। হাসপাতালে এসেছিলেন নিয়মমাফিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে। সাংবাদিকরা ছোটেন তাঁর দিকে। তখনও তিনি উত্তেজিত। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, কী করলে খুশি হতো সংবাদমাধ্যম? পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গলায় মালা পরিয়ে স্বাগত জানালে? যেভাবে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি, ফ্ল্যাটের পর ফ্ল্যাটের বিনিময়ে রাজ্যের বেকারত্ব বেড়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। এও জানান, তাঁর এক আত্মীয় হাসপাতালে ভর্তি, সেখানে পার্থবাবুকে ভিআইপি বন্দোবস্ত করে নিয়ে আসায় সাধারণ রোগীরা অসুবিধেয় পড়েন। বোঝাই যায়, একের পর এক কারণে ক্ষোভ জমে তাঁর ভেতর। শুভ্রা এও বলেন, "চটিটা পার্থবাবুর টাকে লাগলে" তিনি খুশি হতেন।

আমেদাবাদে মনমোহনকে জুতো
২০০৯ সালের ২৬ এপ্রিল। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর আমেদাবাদে এক নির্বাচনী সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। তখন তাঁকে লক্ষ্য করে জুতো নিক্ষেপ করে এক ক্ষুব্ধ ছাত্র। সরকারের গত পাঁচ বছরের সাফল্য নিয়ে মনমোহন বক্তৃতা শুরু করার পর তাঁর দিকে জুতো ছুড়ে মারেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র হিতেশ চৌহান। পরে এক পুলিস কর্তা সংবাদমাধ্যকে জানান, রাজনীতিবিদরা মিথ্যা কথা বলেন- এই বলে চিৎকার করছিলেন হিতেশ। এই সময় দলীয় সমর্থরা তাঁকে থামিয়ে দেন। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রীর দিকে জুতো ছুড়ে মারেন। তাঁকে আটক করে পুলিশ।

চিদাম্বরমকে সাংবাদিকের জুতো
দিল্লিতে ২০০৯ সালে একটি সাংবাদিক বৈঠকে পি চিদাম্বরমকে লক্ষ্য করে জুতো ছোড়েন এক সাংবাদিক। তখন তিনি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। চিদাম্বরম অবশ্য তাঁকে ক্ষমা করে দেন। নিন্দুকরা অবশ্য বলেছিলেন, সেসময় দেশে লোকসভা ভাটের দামামা বেজে গিয়েছিল, তাই ক্ষমাশীলতা দেখিয়ে জন-আবেগ নিজের দিকে টানতে চেয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা। সেই বছরেই কলকাতায় মামলা লড়তে এসে এক মহিলা আইনজীবীর তাড়া খেয়েছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি চিদাম্বরম।

আদবানিকে বিজেপি কর্মীর 'খড়ম’
জুতো ধেয়ে এসেছিল লালকৃষ্ণ আদবানির দিকেও।২০০৯ সালে লালকৃষ্ণ আদবানিকে বিজেপির এক কর্মী খড়ম ছুঁড়ে মারেন। ওই বছর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি বিজেপি কর্মী পাওয়াস অগ্রবাল। তিনি বলেছিলেন, আদবানি আসলে 'ঝুটা লৌহমানব’। এই ক্ষোভ থেকেই জুতো ছোড়েন তিনি।

ওমর আবদুল্লাকে জুতো
২০১০ সালে ১৫ আগস্ট। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা। তাঁকে লক্ষ্য করে জুতো ছোড়েন এক ব‍্যক্তি। ওমর আবদুল্লাকে জুতো ছুড়েছিলেন যিনি, তিনি জম্মু-কাশ্মীরের গোয়েন্দা বিভাগের সাসপেন্ড হওয়া এক পুলিশকর্মী। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ''পাথর না ছুড়ে যদি কেউ জুতো ছোড়ে, সেটা বরং মেনে নেওয়া যায়।"

কৃষিমন্ত্রীর গালে চড়
ভারতে এক যুবকের হাতে ২০১১ সালে শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও তৎকালীন ক্যাবিনেট মন্ত্রী শরদ পাওয়ারের চড় খাওয়ার ঘটনা দেশে আলোড়ন তৈরি করে। লোকসভা অধিবেশনেও এই নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়। হরবিন্দর সিং নামে ওই ব্যক্তি আটক হওয়ার পর পুলিশকে বলেন, "দুর্নীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদেই তিনি কৃষিমন্ত্রীকে চড় মেরেছেন।" হরবিন্দর পেশায় টেম্পো চালক।

দূষণের জেরে কেজরিওয়ালকে জুতো
২০১৬ সালের ৯ এপ্রিল। দিল্লিতে দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য জোড়-বিজোড় প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তাঁকে লক্ষ্য করে জুতো ছোড়েন বেদ প্রকাশ শর্মা। তিনি ছিলেন কেজরি-র দল আম আদমি পার্টির প্রাক্তন কর্মী। অভিযোগ করেন, এই প্রকল্প ঘোষণার পিছনে রয়েছে সিএনজি দুর্নীতি।

নবীন পট্টনায়ককে জুতো
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে উপনির্বাচনের প্রচার করছিলেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক। বরগাড় জেলার এক গ্রামে তিনি প্রচার করছিলেন। তখন তাঁকে লক্ষ্য করে জুতো ছোড়েন কার্তিক মেহর নামে এক ব্যক্তি। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে আটক করে পুলিশ।

শুধু দেশের রাজনীতিবিদরা নন, বিদেশের হেভিওয়েটরাও হেনস্থার শিকার হয়েছেন।

বাগদাদে বুশকে জুতো
২০০৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাগদাদে গিয়েছিলেন জর্জ বুশ। তার ৩৭ দিন পরেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর মেয়াদ শেষ। বুশকে লক্ষ্য করে নিজের ২টি জুতো ছোড়েন এক ইরাকি সাংবাদিক। বিদায় সম্ভাষণ করে বলেন, 'কুকুর’। বুশ অবশ্য দক্ষ প্রশাসকের মতো সামলেছিলেন অতর্কিত আক্রমণ। বলেছিলেন, "একটাই তথ্য দিতে পারব। জুতোর সাইজ ১০।" ইরাকের যুদ্ধের জন্য সে-দেশের বাসিন্দারা ক্ষুব্ধ ছিলেন বুশের প্রতি। ওই যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ।

বারবার দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ক্ষোভের আগুনে ফুটেছে বিদেশও। তাই কখনও সাংবাদিক, কিংবা টেম্পো চালক- পরিচয় যাই-ই হোক, নিজের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে নেতা-মন্ত্রীদের হেনস্থা করেছেন। এভাবেই সাহসের আড়ালে দুঃসাহসের নামাবলি গায়ে খেপে ওঠে দেশ ও বিদেশ!

More Articles