অসুস্থ শরীরেও দেখেছেন ২০২২ বিশ্বকাপ, হারার পর নেইমারদের সাহসও জুগিয়েছিলেন পেলে

Pele FIFA World Cup 2022 : পেলে ভেবেছিলেন, এবার নিশ্চয়ই ষষ্ঠবার বিশ্বকাপ জিতবে ব্রাজিল। ‘হেক্সা’ জয় উদযাপন করতে নিজেই কাতার পৌঁছে যাবেন।

কাতারের স্টেডিয়ামের গ্যালারির যেদিকে তাকানো যায়, কেবল হলুদ আর হলুদ। যেন বিস্তীর্ণ সর্ষে খেতের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি। মাঠে খেলছেন ব্রাজিলের ফুটবলাররা, আর গ্যালারিতে চলছে সাম্বার তালে তালে নাচ। ব্রাজিল মানেই এমন দৃশ্য, এমন সমাবেশ। তবে এবার আরও একটি ছবি দেখাগেল। গ্যালারির একটা দিকে বিশাল বড় একটা জার্সি টাঙানো। জার্সিটা ব্রাজিলেরই, কিন্তু পুরনো সময়ের। আর তার পাশেই একজনের ছবি, জার্সিটার মতোই বড়ো। সঙ্গে লেখা, ‘গেট ওয়েল সুন, পেলে’।

২৯ ডিসেম্বরের পর এই একটি দৃশ্যই বারবার ফিরে আসছে সবার মনে। বেশিদিন আগের তো কথা নয়। ১৮ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর। ২০ নভেম্বর থেকে কাতারের মাটিতে শুরু হয়েছিল বিশ্ব ফুটবলের মহারণ। লিওনেল মেসি না ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো – প্রবল দ্বন্দ্বে জিতবেন কে? নাকি বাজিমাত করে যাবেন তরুণ তুর্কি কিলিয়ান এমবাপে? এমন প্রশ্নের মধ্যেই নজর ছিল পেলের দিকে। মাত্র দু’বছর আগে চলে গিয়েছেন দিয়েগো মারাদোনা। এবার জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে রয়েছেন পেলেই।

অবশ্য বিশ্বকাপের আগে কম উৎসাহিত ছিলেন না পেলে নিজেও। ব্রাজিলের দলটি নিয়ে আশা ভরসা ছিল সবার। সেই ভরসা রেখেছিলেন পেলেও। নেইমার, রিচার্লিসন, ভিনিসিয়াস জুনিয়রের আক্রমণভাগ থেকে থিয়াগো সিলভা, কাসেমিরোর ডিফেন্স, গোলে অ্যালিসন – সব মিলিয়ে প্রত্যাশার পাহাড়। পেলে ভেবেছিলেন, এবার নিশ্চয়ই ষষ্ঠবার বিশ্বকাপ জিতবে ব্রাজিল। তিনি বারবার বলেছিলেন, ব্রাজিলের ‘হেক্সা’ জয় উদযাপন করতে তিনি নিজে কাতার পৌঁছে যাবেন। বিশ্বকাপ তুলে দেবেন নেইমারদের হাতে। আগে থেকেই সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে বসেছিলেন।

আরও পড়ুন : জীবন সংকটে, তবুও ব্রাজিলকে বাজি ধরে খেলা দেখছিলেন পেলে

কিন্তু বাধ সাধল স্বাস্থ্য। বিশ্বকাপ ফুটবল তখন শুরু হয়ে গিয়েছে। হঠাৎই মাঝপথে খবর এল, পেলেকে সাও পাওলোর অ্যালবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কেন? তড়িঘড়ি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হল কেন? কী হয়েছে ফুটবল সম্রাটের? আশঙ্কার একরাশ কালো মেঘ জড়ো হল ফুটবল বিশ্বে। কাতারের মহারণেও পড়ল সেই ছায়া। স্টেডিয়ামে পেলের ছবি, পেলের সুস্বাস্থ্যের কামনায় প্রার্থনা – সবই হল। ফিফা নিজেও পেলের সুস্থতা কামনা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে।

কিন্তু সমস্ত শঙ্কা দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন খোদ পেলে। হাসপাতাল থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও পোস্ট করেন। তিনি সুস্থ, যথেষ্ট ভালো আছেন, রুটিন কিছু চেকআপ আর ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসেছেন তিনি। তবুও প্রার্থনায় কোনও কমতি ছিল না। তার মধ্যেই ডাক্তার জবাব দিয়ে দিলেন। না, কেমোথেরাপি কোনও কাজ দিচ্ছে না। পেলের শরীরে আস্তে আস্তে নিজের জাল বিস্তার করছে ক্যানসার। আর কিচ্ছু করার নেই। প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিটে রাখলে যন্ত্রণাটা একটু কমবে। সাময়িক নিরাময় পাবেন কিংবদন্তি। বিশ্বকাপও যেন তৈরি ছিল না এই খবরের জন্য।

কিন্তু তিনি তো পেলে। ২৯ ডিসেম্বর নেইমার একটি পোস্ট দেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেখানে তিনি বলেন, আগে ১০ নম্বর জার্সির এত কদর ছিল না। স্রেফ একটি সংখ্যা ছিল। পেলে এসে সেই সংখ্যাটিকে কিংবদন্তি করে দিলেন। তাঁর হাত ধরেই তৈরি হল ১০ নম্বরের ইতিহাস। সত্যিই তো, পেলেকে ছাড়া বিশ্বকাপ ফুটবল কখনও ভাবা যায়? মারাদোনাকে অকালে হারানোর পর পেলের সঙ্গেও যেন তেমনটা নাম হয়, সেটাই প্রার্থনা করছিল বিশ্ব। কিন্তু ৮২ বছরের শরীর আর কত ঝড় সইবে! তবুও ফুটবল ছিল অক্সিজেন। বিশ্বকাপ ফুটবল হাসপাতালে শুয়েই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন পেলে।

আরও পড়ুন : ‘দিয়েগো নিশ্চয়ই এখন হাসছে’, মেসিদের বিশ্বজয়ে যে ভাবে আবেগে ভাসলেন পেলে

সেইসঙ্গে অভিভাবকের মতো আগলে রাখলেন বিশ্ব ফুটবলকে। মনে করুন কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের কথা। ব্রাজিলের মুখোমুখি ক্রোয়েশিয়া। অসম্ভব ক্ষিপ্র ও সুন্দর একটি গোল উপহার দিলেন নেইমার। ছুঁয়ে ফেললেন পেলেকে। কিন্তু তারপরই যে কী হয়ে গেল! সেই ম্যাচটি টাই ব্রেকারে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে ছিটকে যায় সেলেকাওরা। কাঁদতে কাঁদতে নেইমার সাংবাদিকদের জানান, আর হয়তো ব্রাজিলের হলুদ জার্সি তিনি গায়ে দেবেন না।

ঠিক সেই সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা বার্তা। বার্তাবাহক স্বয়ং পেলে। হাসপাতালে রোগশয্যায় শুয়ে ব্রাজিলের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। নেইমারকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, বলছেন, “তুমি আমাদের আদর্শ। তোমার জন্য অনেক চিৎকার করেছি। আরও করব।” প্রতিটা শব্দে, প্রতিটা আবেগে ব্রাজিল আর নেইমারকে সাহস জুগিয়ে গেলেন বৃদ্ধ পেলে। ঠিক যেন একান্নবর্তী পরিবারের বড় কর্তা। সমস্ত বিপদে, সংশয়ে সহায় তিনি। সমস্ত বিদ্রুপ, সমালোচনা থেকে আগলে রাখলেন সেলেকাওদের। দুনিয়া যা খুশি বলুক, আমি তো আছি। আমি জানি, তোমরা পারবে। আবার পারবে। স্বয়ং ফুটবল সম্রাট যখন এমনটা বলেন, তখন ভরসা আসে বৈকি!

কিংবা ধরুন, ১৮ ডিসেম্বরের রাত। ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতল আর্জেন্টিনা। লিওনেল মেসির স্বপ্ন, মারাদোনার স্বপ্ন যেন পূর্ণ হল। হাসপাতালে পেলের অবস্থা আরও খানিকটা খারাপ হয়েছে। কিন্তু এবারও আবেগে ভাসলেন তিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় মেসিকে স্বাগত জানালেন। “অনেকদিন এর জন্য অপেক্ষা করেছিলে তুমি। শুভেচ্ছা, মেসি।” আর তারপরই লিখলেন সেই অমোঘ কথা – “দিয়েগো নিশ্চয়ই এখন হাসছে”।

আরও পড়ুন : কলকাতায় এসে ম্যাচ ড্র! মোহনবাগানের গোলরক্ষককে তবু বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন পেলে

কেবল এখানেই থামেননি। মেসি-রোনাল্ডো যুগ প্রায় শেষের দিকে। আর মাত্র কয়েকটা বছর, তারপর দুজনেই অবসর নিয়ে নেবেন। ঠিক যেমন পেলে, তারপর মারাদোনা এসেছিলেন, তারপর সেই ঢেউ চলে এসেছে পরবর্তী প্রজন্মে। পেলে জানেন, ফুটবলের পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি হবে এমবাপের হাত ধরে। নতুন প্রতিভার জন্ম দেখে তাঁকেও শুভেচ্ছা জানান তিনি। সেইসঙ্গে আবিবাদন জানান মরক্কোকে। যে মরক্কো একটা রূপকথা তৈরি করেছে এবারের বিশ্বকাপে। বহু বছর আগে পেলে বলেছিলেন, আফ্রিকান ফুটবল শীঘ্রই বিশ্বকাপ জিতবে। মরক্কোকে সেমি ফাইনালের মঞ্চে দেখে নিশ্চয়ই খুশি হয়েছিলেন।

কিন্তু এখন অক্সিজেন শেষ। বিশ্বকাপ ফুটবল পেরিয়ে গিয়েছে অনেকদিন হল। খেয়াল করে দেখুন, পেলের অবস্থার ক্রমাবনতি তারপর থেকেই শুরু হয়েছে। নিছকই কাকতালীয়? কুসংস্কার? জানা নেই। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবলই যেন পেলের মনে একটা আশা জাগিয়ে তুলেছিল। পেলেকে ছাড়া বিশ্বকাপ এতদিন ভাবা যেত না। এবার? ২০২৬ সালের বিশ্বকাপে থাকবেন না পেলে এবং মারাদোনা। নেই ক্রুয়েফও। কেবল লেখা থাকবে ইতিহাস। লেখা থাকবে এক সম্রাটের গল্প। লেখা থাকবে বাড়ির সেই বড় কর্তা, অভিভাবকের গল্প। আর নায়ক? এডসন আরান্তেস দে নাসচিমেন্তো, ওরফে পেলে!

More Articles