কলকাতায় এসে ম্যাচ ড্র! মোহনবাগানের গোলরক্ষককে তবু বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন পেলে

Pele in Kolkata: মোহনবাগানের গোলরক্ষক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়কে জড়িয়ে ধরে পেলে বলেছিলেন, "পুরো গর্ডন ব্যাংকসের মতো সেভ করেছ!"

প্রয়াত ফুটবল সম্রাট পেলে। তাঁর মৃত্যুর খবরে মন খারাপ গোটা ফুটবল বিশ্বের। একই সঙ্গে মন খারাপ কলকাতা ময়দানেরও। এক একজন মানুষ থাকেন যাঁরা নিজেদের জীবদ্দশাতেই হয়ে ওঠেন অপরিহার্য। সেরকমই একজন ছিলেন এডসন আরন্তেস দি নাসিমেন্তো, যাঁকে সারা বিশ্ব চেনে পেলে নামে। ১৯৭০ এর শেষ বিশ্বকাপ খেলেই নিজের বুট জোড়া তুলে রেখেছিলেন পেলে। সেই থেকে এতদিন পর্যন্ত মারাদোনাকে জনপ্রিয়তায় টক্কর দিয়ে যাওয়া মুখের কথা ছিল না। ১৯৮৬ সালে দিয়েগোর আগমন গোটা বিশ্বের মতো ভারতেও পেলেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দিয়েছিল। এটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, মারাদোনাও ছিলেন তাঁরই মতো বিশ্বমানের ফুটবলার। কিন্তু, আগের প্রজন্মের কাছে সেই পেলেই ঈশ্বর। তাঁদের কথায়, ৪০ ছুঁই ছুঁই পেলেকে তাঁরা যে মেজাজে দেখেছেন, তার সামনে মারাদোনাও কিছু নন। সবই আবেগের কথা হলেও, মোহনবাগান ভক্তদের কাছে এই আবেগকেও সরিয়ে রাখা যায় না।

সেদিন মোহনবাগানের বিরুদ্ধে পেলের খেলায় সকলের মন ভরেনি। মাঠে কাদা থাকায়, কালো হিরে তেমন একটা চমকাননি। কিন্তু হিরের গায়ে কাদা লাগলেও, সেই ঝলকানির রেশ আজও লেগে রয়েছে দর্শকদের চোখে। পেলের সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে কলকাতারও। ফেলে আসা অতীত তাই জেগে উঠছে অনেকের চোখের সামনে। কেমন ছিল সেই দিনটা? আসলে ভারতবর্ষের মাটিতে কোনও ফুটবল তারকাকে ঘিরে এতটা ভিড় খুব কমই দেখা গিয়েছে। এয়ারপোর্ট লাগোয়া ভিআইপি রোড দিয়ে সেদিন পাগলের মতো ছুটে ছিলেন লোক। এয়ারপোর্টে সবকিছু ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল সেদিন। শেষমেষ পিছন দিয়ে তাকেঁ বের করা হয়।

১৯৭৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর, কলকাতার ইডেন গার্ডেনে মোহনবাগানের একটি প্রদর্শনী ম্যাচে খেলতে এসেছিলেন ফুটবলের সম্রাট। নিজের পেশাদারি কেরিয়ারের একেবারে শেষ লগ্নে কসমস ক্লাবের এশিয়া সফরের অঙ্গ হিসেবে কলকাতায় এসেছিলেন পেলে। বিমানবন্দর, হোটেল থেকে শুরু করে ইডেন গার্ডেন্স- লোকে লোকারণ্য ছিল সেদিন। সকলেই চেয়েছিলেন পেলের 'লাইভ পারফরমেন্স' দেখতে। তবে ইডেন গার্ডেনসে পুরো ম্যাচটা খেলতে পারেননি পেলে। মাত্র ৩০ মিনিট খেলেছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন- তিন তিনবার বিশ্বকাপ জয়! ফিরে দেখা ‘হ্যাট্রিকের রাজা’ পেলের জীবনের সেরা ম্যাচগুলি

আসলে বৃষ্টির কারণে খেলার পক্ষে কার্যত অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল মাঠ। কেরিয়ারের শেষ লগ্নে এসে কাদা মাঠে পেলের থেকে আগের মতো স্কিল দেখা যাচ্ছিল না আর। তবে সেদিন এসবের কোনও পরোয়া করেনি কলকাতা। ১৯৭৭ সালের মরসুমে একেবারেই ভালো খেলছিলেন না গৌতম সরকার, সুব্রত ভট্টাচার্য, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়রা। তবুও, সেই ম্যাচে ২-২ গলে ড্র করেছিল কসমস এবং মোহনবাগান।

বছর ৩৭-এর পেলে সেই কাদা ভরা মাঠে ছুটতে না পারলেও, শৈল্পিক ছোঁয়ার হীরক দ্যুতি খুব একটা কম ছিল না। আর সেটুকুই প্রাণ ভরে দেখেছিলেন মাঠে হাজির দর্শকরা। বহু মানুষ অনেক চেষ্টা করেও সেই ম্যাচে মাঠে যাবার ছাড়পত্রটি জোগাড় করতে পারেননি। আর যারা যেতে পেরেছিলেন, তারা সারা জীবনের মতো সঞ্চয় করে রেখেছিলেন সেই টিকিটটি।

ম্যাচ পরবর্তী পার্টিতে মোহনবাগানের গোলরক্ষক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়কে জড়িয়ে ধরে পেলে বলেছিলেন, "পুরো গর্ডন ব্যাংকসের মতো সেভ করেছ!" পেলে হয়তো সেদিন ভাবতে পারেননি মোহনবাগানের কাছে ২-২ গলে আটকে যাবে তাঁর দল। কিন্তু তা সত্ত্বেও যেভাবে তিনি স্নেহমিশ্রিত সম্মানে ভরিয়ে দিয়েছিলেন শ্যাম থাপা, সুভাষ ভৌমিক, গৌতম সরকার, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়দের তা প্রমাণ করে শুধুমাত্র ভালো ফুটবল খেললেই হয় না। ফুটবলের সম্রাট হতে গেলে হৃদয়কেও সম্রাটের মতো করতে হয়।

সেদিন ফুটবলের সম্রাটের সামনে মাথা উঁচু করে লড়েছিলেন বাংলার ফুটবলাররা। দেখিয়ে দিয়েছিলেন ফুটবল মাঠে মোহনবাগানও কম যায় না। পায়ে বল নিয়ে দৌড়, ট্যাকেল, পাস, সবকিছুই একেবারে ছকে বাধা। ছক কষেছিলেন পিকে। কলকাতা ময়দানের সেই জাদুকরের কাছে আটকে গিয়েছিলেন ফুটবলের জাদুকরও। তাঁর হেড এবং ফ্রি কিক গর্ডন ব্যাংকসের মতো সেভ করেছেন বলে জড়িয়ে ধরেছিলেন শিবাজীকে।

আরও পড়ুন- স্তব্ধ হল শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের জীবন! যে কারণে পেলে আসলে অমর…

দীর্ঘ ৪৫ বছর আগে এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে ইতিহাস সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল ইডেন গার্ডেনের ময়দানে। সক্রিয় ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি চলে গিয়েছিলেন নর্থ আমেরিকার সকার অ্যাসোসিয়েশন লিগে খেলার জন্য। সঙ্গে ব্রাজিল থেকে এক ঝাঁক তারকা ফুটবলার যায় তাঁর সঙ্গে। এর মধ্যেই একজন ছিলেন কার্লোস আলবার্তো, যিনি ১৯৭০ বিশ্বকাপে দেখিয়েছিলেন চমক। সবাই কসমস দলে যোগ দিয়েছিলেন। মোহনবাগান ক্লাবের উদ্যোগেই তাঁরা আসেন কলকাতায় ফুটবল খেলতে। একটি মাকালু বিমানে এসেছিলেন কিংবদন্তি। টার্ম্যাকে ছিল একেবারে উপচে পড়া ভিড়। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যেও গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে হাজার হাজার লোক ভিড় করে দেখেছিলেন পেলেকে। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল পৌঁছতে সময় লেগে গিয়েছিল ৫ ঘন্টা। ফুটবল সম্রাট মোহনবাগানের সঙ্গে তাঁর দলের সেই ম্যাচের কথা মনে করে স্পষ্টতই স্মৃতিমেদুর বাঙালি।

দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকলেও ভক্তরা মনে মনে বিশ্বাস করেছিলেন যে এবারও ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবেন পেলে। ফুটবল বিশ্বকাপের সময় যখন পেলে অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তখন তাঁর সুস্থতা কামনা করেছিলেন ফুটবল তারকা, সমর্থকরা। তারই মধ্যে নজর কেড়েছিল কাতারের লুসেল স্টেডিয়ামে ব্রাজিলের সমর্থকদের আনা ফুটবল সম্রাটের একটি ব্যানার। ওই ব্যানারে দেখা গিয়েছিল গালের পাশে একটি ফুটবল ধরে রয়েছেন পেলে। মুখে রয়েছে পরিশ্রান্তির হাসি। ব্যানারের ঠিক সামনে বিশ্বকাপ ট্রফির একটি রেপ্লিকা ধরেছেন একজন ব্রাজিলিয়ান। ওই ছবিটাই একলপ্তে পেলের সাম্রাজ্য। সেই সাম্রাজ্যের সম্রাট তিনি নিজেই। অন্য কারও পক্ষে সেই জায়গায় যাওয়া অসম্ভব। আজ পার্থিব শরীরে তিনি হয়তো আর নেই, কিন্তু অমর হয়েই থাকবেন তিনি। আর তাঁর সঙ্গেই অমর হয়ে রইবে মোহনবাগান-কসমসের সেই ম্যাচ।

 

More Articles