গাজায় প্রতি ৫২ মিনিটে একজন শিশুর মৃত্যু! সামনে এল যে তথ্য

Gaza Crisis: নিহতদের মধ্যে ১,০২৯ জনের বয়স এক বছরের নিচে, ৫,০৩১ জনের বয়স পাঁচ বছরের কম, আর ৪২০ জন শিশু যুদ্ধের মাঝেই জন্ম নিয়ে মারা গিয়েছে। ১,১০২ জন শিশু যুদ্ধের কারণে হাত বা পা হারিয়েছে।

গাজায় যুদ্ধের আগুনে সবচেয়ে বেশি পুড়ছে শিশুরাই। একের পর এক বিমান হামলা, অবরোধ, খাবার ও চিকিৎসার সংকট— সব মিলিয়ে তারা এখন বেঁচে থাকার লড়াই লড়ছে প্রতিদিন। প্যালেস্টাইন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে উঠে এসেছে এক ভয়াবহ চিত্র, গাজায় এখনও পর্যন্ত অন্তত ২০ হাজারেরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে। প্রায় কয়েক লক্ষ শিশু আহত, গৃহহীন, অনাথ হয়ে পড়েছে।

গাজার হাসপাতালগুলোতে জায়গা নেই আহত শিশুদের জন্য। অনেকেই বাবা-মা হারিয়ে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েছে। আবার কারও শরীরের অঙ্গ চলে গেছে, কেউ কেউ স্থায়ীভাবে অক্ষমও হয়ে পড়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতিদিন শত শত শিশু আহত অবস্থায় হাসপাতালে আসছে, কিন্তু পর্যাপ্ত ওষুধ, বিদ্যুৎ না থাকায় অনেককেই বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না।

জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলির তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে গাজায় যত মানুষ মারা গিয়েছে, তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই শিশু। যুদ্ধের কারণে স্কুল, খেলার মাঠ, হাসপাতাল— সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এখনও অনেক শিশু ধ্বংসস্তূপের ভেতরেই দিন কাটাচ্ছে, খাবার বা জলের আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ১২ লক্ষেরও বেশি শিশু চরম খাদ্যাভাবের শিকার। গাজার ৯ লাখেরও বেশি শিশু এখন স্কুলে যেতে পারছে না, অর্থাৎ তারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। একই সঙ্গে ৫,৫৮০ জন শিশু গুরুতরভাবে আহত, যাদের জরুরি চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন, কিন্তু তারা এখনও সেই সুযোগের অপেক্ষায় আছে।

আরও পড়ুন

প্যালেস্টাইনের স্বীকৃতি ও ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা: আদতে রাজনৈতিক প্রহসন?

৭ অক্টোবরের প্যালেস্টাইন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গাজায় চলা এই গণহত্যায় মোট ২০,১৭৯ জন শিশু নিহত হয়েছে। অর্থাৎ, গড়ে প্রতি ৫২ মিনিটে একজন করে শিশু মারা যাচ্ছে। নিহতদের মধ্যে ১,০২৯ জনের বয়স এক বছরের নিচে, ৫,০৩১ জনের বয়স পাঁচ বছরের কম, আর ৪২০ জন শিশু যুদ্ধের মাঝেই জন্ম নিয়ে মারা গিয়েছে। ১,১০২ জন শিশু যুদ্ধে হাত বা পা হারিয়েছে।

গাজায় এখন খাবারই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। ত্রাণ দেখিয়ে প্রাণ নেওয়া চলছে। অবরোধের কারণে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানো যাচ্ছে না, ফলে মানুষ খেতে পাচ্ছে না ন্যূনতম পরিমাণও। তাদের মধ্যে অনেকেই দিনে একবেলা খাবার পায়, কেউ কেউ একদিন পর পর কিছু খেতে পায়।

অপুষ্টির কারণে শিশুদের শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে, অনেকেরই উচ্চতা ও ওজন স্বাভাবিক হারে বাড়ছে না। বিশুদ্ধ জল না থাকায় তারা জলবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ডাক্তাররা সতর্ক করেছেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম গাজার শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়বে।

হাজার হাজার শিশু এখন অনাথ আশ্রম বা অস্থায়ী শিবিরে রয়েছে। যারা পুরো পরিবারই হারিয়ে ফেলেছে, তারা অন্যদের ঘরে আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু গাজার সংকীর্ণ ও বিপর্যস্ত জীবনযাত্রায় তাদের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা নেই। অনেক শিশু মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে, ঘুমাতে পারে না, যুদ্ধের শব্দ শুনলে আতঙ্কে কেঁপে ওঠে।

আরও পড়ুন

ট্রাম্পের চাপ, হামাসের শর্ত : গাজায় শান্তি ফিরবে?

গাজার শিশুরা যেন জীবনের শুরুতেই বড় হয়ে গিয়েছে। তাদের চোখে খেলার আনন্দ নেই, আছে কেবল ভয় আর ক্ষুধা। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এই শিশুরা নিজেদের বেঁচে থাকা নিয়ে প্রতিদিন যুদ্ধ করছে। তাঁরা আরও বলছেন, গাজায় যা ঘটছে তা 'মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ'। বিশ্বের বড় বড় দেশ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতিসংঘ নানা বিবৃতি দিলেও বাস্তবে গাজার পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তনই হয়নি। খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছাতে বাধা দেওয়া হচ্ছে, অবরোধ শিথিলের দাবিও কার্যকর হচ্ছে না। শিশুরা যেন এক এমন যুদ্ধে বন্দি, যার কারণ তারা বোঝেই না।

আল-জাজিরার তথ্য অনুযায়ী, গতকাল (৮ অক্টোবর), বিকেল ২:৪৫ মিনিটে গাজা শহরে আবার প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছে। এসব বিস্ফোরণ ঘটেছে দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত বড় যন্ত্রসজ্জিত যানবাহর ব্যবহার করে, এগুলিতে টন টন বিস্ফোরক রাখা আছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ৭ অক্টোবরের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধের শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত ৬৭,১৭৩ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং ১,৬৯,৭৮০ জন আহত হয়েছে। মৃতদের মধ্যে ১০,৪২৭ জন (১৬%) নারী, ৪,৮১৩ জন (৭%) বৃদ্ধ/বৃদ্ধা, এবং ৩১,৭৫৪ জন (৪৭%) পুরুষ। এছাড়াও, ৪,৯০০ জনের অঙ্গহানি হয়েছে।

গাজার এই ট্র্যাজেডি কেবল একটি অঞ্চলের নয়— এটি গোটা মানবজাতির লজ্জা। উল্লেখ্য, সম্প্রতি ইজরায়েল ও হামাস ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে একমত হয়েছে। এই পরিকল্পনার আওতায় যুদ্ধবিরতি, বন্দি বিনিময় এবং ধীরে ধীরে সৈন্য প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা মহলের একাংশ বলছেন, যুদ্ধবিরতি কাগজে-কলমে যত সহজ, বাস্তবে তা বজায় রাখা অনেক কঠিন। চুক্তি কার্যকর করতে সব পক্ষের আন্তরিকতা ও আন্তর্জাতিক নজরদারি জরুরি। গাজার শিশুরা যেন আবার হাসতে পারে, খেলতে পারে, স্কুলে ফিরতে পারে— এই চাওয়াই এখন মানবতার সবচেয়ে বড় দাবি।

More Articles