শ্রীলঙ্কার পথেই এগোচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ? দেখা মিলবে গৌরী সেনের?

যখন তৃতীয় বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন তার কাছে মূল অস্ত্র ছিল একাধিক প্রকল্প। বিভিন্ন ভাতা, অনুদান সবকিছুই থাকলেও এই নির্বচনে তার প্রধান তুরুপের তাস ছিল স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প এবং লক্ষ্মীর ভান্ডার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সবসময়েই বলেন, মমতার আসল ভোটব্যাঙ্ক কিন্তু আসে বাংলার মহিলাদের কাছ থেকেই। আর সেই ভোটব্যাঙ্ককে প্রভাবিত করে ছিল তার মূল লক্ষ্য। তিনি অবশ্যই সফল। বাড়ির মহিলাদের নামে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড, বাড়ির মহিলাদের মাসে ৫০০ ও ১,০০০ টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, সবকিছুই মহিলাদের আরো বেশি করে মমতাপন্থী করে তুলেছিল একুশের ভোটে। 

স্বাস্থ্যসাথীও ধুঁকছে

প্রকল্পগুলির ব্যাপারে বলতে গেলে, লক্ষীর ভান্ডার এবং স্বাস্থ্য সাথী, দুটি প্রকল্পই ছিল খাতায়-কলমে অত্যন্ত ভালো প্রকল্প। স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পে গরিব মানুষেরা টাকা পাচ্ছিলেন চিকিৎসা করার জন্য, অন্যদিকে মহিলাদের স্বনির্ভর করার জন্য ছিল লক্ষীর ভান্ডার প্রকল্পের প্রতি মাসে টাকা। কিন্তু, এই দুটি প্রকল্প শুরু করার সময় থেকেই সরকারকে একটা ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে এই মুহূর্তে তেমন কোনো আয় নেই। তার উপর কোভিড মহামারী আরো ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিকে। কিন্তু সেই সময় ভোটের জন্য কোন রকম কোন উপদেশ কানেই তুলতে চান নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার সরাসরি ব্যাখ্যা ছিল, পশ্চিমবঙ্গ করে দেখাতে পারবে, পশ্চিমবঙ্গের কাছে সেই ক্ষমতা রয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্যেকটি প্রকল্প একে অপরের সঙ্গে যেনো প্রতিযোগিতায় নেমেছে। লক্ষীর ভান্ডার প্রকল্পের টাকা দিতে গিয়ে ধুঁকতে শুরু করেছে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প। 

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের ২০টি বেসরকারী হাসপাতাল এমন আছে যারা স্বাস্থ্য সাথীর আওতা থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে নিতে চাইছে। তাদের দাবী হল, স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পে তাদের যা বকেয়া টাকা রয়েছে, তা এখনো সরকারের তরফ থেকে মেটানো হয়নি। আর এই টাকার পরিমাণটা কিন্তু এক কোটি কিংবা দু'কোটি টাকা নয়, একসাথে ২০০ কোটি টাকা। এই টাকার অঙ্কটা একটা রাজ্য সরকারের পক্ষে খুব একটা বৃহৎ না হলেও, এই সমস্যার সমাধানও খুব একটা সহজ হবে না। শুধুমাত্র এই ২০টি বেসরকারী হাসপাতালে যে সরকার বকেয়া রেখেছে সেরকমটা না, আরো অন্যান্য হাসপাতালে সরকারের বকেয়া থাকতেই পারে। তাই যদি এই ২০টি হাসপাতালের বকেয়া মিটিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আগামী দিনে আরো ২০টি হাসপাতল এগিয়ে আসতে পারে তাদের বকেয়া সমস্যা নিয়ে। সেখানে আবারো আইসোলেটেড ঘটনার দোহাই দিয়ে তাদের বকেয়া মিটিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু এই আইসোলেটেড ঘটনায় টাকা মিটিয়ে দেওয়ার পর্ব কতদিন চলবে? এই বৃত্তটা কখনোই শেষ হবার নয়।

আরও পড়ুন-কতটা দুর্দশায় শ্রীলঙ্কার মানুষ? এর সুযোগ কি নেবে চিন?

তবে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প নিয়ে সমস্যা প্রথম নয়, এর আগেও যখন স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প চালু করার ভাবনা নেওয়া হয়েছিল সরকারের তরফ থেকে, তখন থেকেই অনেকে বলেছিলেন স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পে সমস্যা রয়েছে, কিন্তু রাজ্য সরকার সেই সময় কোন কথা শুনতে চায়নি, বরং যে সমস্ত হাসপাতাল এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন তাদেরকে কার্যত জোর করে এই প্রকল্প গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল রাজ্য সরকারের তরফ থেকে। যথারীতি তারপরেই শুরু হয়েছে স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প নিয়ে একের পর এক সমস্যা। চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবছরের রাজ্য বাজেট পেশ করার সময় ঘোষণা করলেন স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের জন্য রাজ্য সরকারের তরফ থেকে ৫৩০ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু, প্রতিদিন দুয়ারে সরকারের ক্যাম্পে যে হারে মানুষ স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের জন্য আবেদন জানাতে আসছেন, তাতে কি ৫৩০ কোটি টাকা যথেষ্ট হবে? এই নিয়ে কিন্তু থেকে যাচ্ছে প্রশ্ন। 

কল্যাণ প্রকল্পে বাড়তি খরচ

কিছুদিন আগেই রাজ্য সরকারের আয় এবং ব্যয়ের একটি পরিসংখ্যান সামনে এসেছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্যসাথী এবং অন্যান্য বিভিন্ন করলেন প্রকল্পে এই অর্থবর্ষে ২১ হাজার কোটি টাকা বাড়তি খরচ করে ফেলেছে রাজ্য সরকার! এই খরচটা করার কোন প্রয়োজনই ছিল না। মূলত স্বাস্থ্য এবং করলেন প্রকল্পের খাতেই বাড়তি ব্যয় হয়েছে বলে জানাচ্ছে সরকারি তথ্য। যদিও অর্থ মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের দাবি, করোনাভাইরাস এর সময় একাধিক সমস্যা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য অতিরিক্ত খরচ করার কারণেই রাজ্য সরকারের এই অতিরিক্ত খরচ করতে হয়েছে। এজন্য বাজার থেকে যে পরিমাণ রাজ্য সরকারকে ধার করতে হয়েছে, তার জন্যই এখন শুধু বাবদ অতিরিক্ত ৪৫৬৬ কোটি টাকা গুনতে হবে রাজ্য সরকারকে। পাশাপাশি অন্যান্য কিছু ধার বাবদ অতিরিক্ত সুদের পরিমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৯ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে, গত আর্থিক বছরে বাজেটবহির্ভূত ২০,৭৫২ কোটি টাকা খরচ করেছে রাজ্য সরকার, যার হিসাব দিতে সরকার অপারগ। 

আরও পড়ুন-তৃতীয় জয়ের এক বছরেই নড়বড়ে তৃণমূল? দল কি ভাঙছে আড়াআড়ি?

তার উপরেই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো সরকারের মাথায় ঝুলছে স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের বকেয়া টাকা। এই মুহূর্তে, আর এই সম্পূর্ণ ঘটনাটাকে আইসোলেটেড ঘটনা বলা যায়না। সরকার যখন এই প্রকল্প গুলি শুরু করেছিল তখন তাদের কোনো ধারনাই ছিল না, কোন প্রকল্পে কত টাকা খরচ করতে হবে এবং কোন প্রকল্পে কত টাকা দেওয়া উচিত। লক্ষীর ভান্ডার প্রকল্পের জন্য প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করছে রাজ্য সরকার। কিন্তু এই মুহূর্তে যখন রাজ্য সরকারের ভাঁড়ার খালি, সেই সময় এই প্রকল্পের প্রয়োজন ছিল বলে মনে করছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। চিকিৎসক সমাজ স্বাস্থ্যসাথী নিয়ে আড়াআড়ি ভাবে বিভক্ত। তাদের একাংশ মনে করে, এই মুহূর্তে রাজ্য সরকারের উচিত ছিল পরিকাঠামোর দিকে উন্নয়ন করা। পরিকাঠামো আরো ভালো করে সাধারণ মানুষকে আরো ভালো চিকিৎসাব্যবস্থা উপহার দেওয়ার দরকার ছিল রাজ্য সরকারের, কিন্তু তা না করে রাজ্য সরকার সরাসরি নেমে পড়েছে অনুদানের খেলায়, যা পরবর্তীতে সমস্যায় ফেলেছে রাজ্য সরকারকেই।

স্বাস্থ্যসাথীতেও নাকি 'স্ক্যাম' 

একদিকে যেমন এই সমস্ত প্রকল্পের টাকা দিতে গিয়ে সরকারের বেহাল দশা, তিনি এই সমস্ত প্রকল্পের যেরকম অপব্যবহার চলছে, তা রুখতেও সরকার অপারগ। যেমন কিছুদিন আগেই একটি ঘটনা সামনে এসেছিল, যেখানে গ্রামের মানুষদের দাবি ছিল, তাদের কাছে কিছু মানুষ এসেছিলেন যারা নিজেদেরকে স্বাস্থ্যসাথী এজেন্ট বলে দাবি করেছিলেন। তারা ঐ গ্রামবাসীদের জানিয়েছিলেন স্বাস্থ্য সাথী কার্ড নিয়ে যদি তারা বেসরকারি হাসপাতালে যান তাহলে তাদেরকে বিনিময়ে ১০,০০০ টাকা করে দেওয়া হবে। গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, তাদের বিনামূল্যে চেকআপ করানোর নাম করে ওই এজেন্টরা তাদেরকে স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তাদের আঙ্গুলের ছাপও নেওয়া হয়। এবার তাদের নামে ভুয়ো চিকিৎসার বিল জেনারেট করা হয় এবং স্বাস্থ্য সাথী কার্ড এর নাম করে সেই বেসরকারি হাসপাতাল যে পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করে তার সিংহভাগ নিয়ে নেয় ওই এজেন্টরা। 

কোন কোন জায়গায় আবার এজেন্টরা সে গ্রামবাসীদের হাতে ১০,০০০ টাকা করে তুলে দেন, কিন্তু আবার অনেক জায়গায় এই টাকা দেওয়া হয়নি। সুতরাং স্বাস্থ্যসাথীর যে চরম অপব্যবহার চলছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

সরকারি কর্মীদের মাইনে নিয়ে টানাটানি

২০১৭ সাল থেকে পণ্য এবং পরিষেবা কর চালু হওয়ার পর থেকে রাজ্যগুলিকে জিএসটি ক্ষতিপূরণ দিতে শুরু করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। আগামী পাঁচ বছরের জন্য এই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি বছরের জুন মাসে বন্ধ হয়ে যাবে এই জিএসটি ক্ষতিপূরণ দেওয়া। ওই অর্থ বন্ধ হলে সরাসরি সংকটে পড়বে সমস্ত রাজ্যের সরকার। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারকে এই জিএসটি ক্ষতিপূরণ আরো পাঁচ বছর বৃদ্ধি করার জন্য অনুরোধ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। 

মমতা সবসময়ই দাবি করে আসছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে পশ্চিমবঙ্গকে তাদের জিএসটি ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্য টাকা দেওয়া হচ্ছে না। সেই টাকা যদি রাজ্য সরকারের হাতে চলে আসে তাহলে আর কোন সমস্যা থাকবে না। 

কিন্তু সত্যিটা কি সেরকম? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে দাবি করছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হাতে যদি এই জিএসটি কম্পেন্সেশন বাবদ টাকা চলে আসে তাহলে তাদের সমস্ত প্রকল্প একেবারে ভালো ভাবে এগোতে শুরু করবে, সেরকম কি আদৌ হবে? এই মমতাই কিন্তু আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, আগামী দিনে বিভিন্ন রাজ্য হয়তো সরকারি কর্মচারীদের বেতন পর্যন্ত দিতে পারবে না। প্রকারান্তরে নিজের রাজ্যের কথাই বললেন না তো মমতা? মোদি সরকারকে নিশানা করে মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, 'শ্রীলঙ্কায় আগুন জ্বলছে। আগামী দিনে সব রাজ্য সরকার বেতন দিতে পারবে কিনা সন্দেহ। কেন্দ্র প্রাপ্য জিএসটির ভাগ দিচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গের এখনো বকেয়া রয়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় সরকার জিএসটির পুরো টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। করের একটা অংশ রাজ্য সরকার পায়, কিন্তু সব কিছুতেই সেস চাপিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই ট্যাক্সের পুরো টাকাটাই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে যায়।' 

যদি আমরা ধরেও নিই, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমস্ত দাবি সত্যিই এবং কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে সমস্ত বকেয়া মিটিয়ে দেওয়া হবে, তাহলেও কিন্তু চলতি জুন মাস পর্যন্ত যে টাকা রাজ্য সরকার পাবে তা কেন্দ্রীয় সরকার একবারে দেবে অথবা বহু বছর ধরে অল্প অল্প করে সেই টাকা মেটাবে। যদি এরকম হয়, তাহলে রাজ্য সরকারি কর্মীদের বেতন নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না তো?

এমনিতেই রাজ্য সরকারি কর্মীদের ডিএ মাত্র ৩ শতাংশ। যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের ডিএ ৩৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই মুহুর্তে রাজ্য সরকারি কর্মীরা এই মহার্ঘ ভাতা নিয়ে সমস্যায়। রাজ্য সরকারের তরফ থেকে তাদের মহার্ঘ ভাতা বৃদ্ধি করাই হচ্ছে না, কিন্তু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি চলছেই। এই অবস্থায় আর কত দিন বন্ধ থাকবে মহার্ঘ ভাতা? শেষমেষ বেতন দেওয়ার জন্য টানাটানিতে পড়তে হবে না তো সরকারকে?

ওষুধটাই তো মহার্ঘ্য

শুধুমাত্র ভারতে পেট্রল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি নয়, পশ্চিমবঙ্গেও ওষুধ এবং নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক লাফে জীবনটাকে ওষুধের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকটাই। তারপর শুরু হয়েছে হাসপাতালগুলির রোগী ফেরানোর পালা। বেসরকারি হাসপাতালগুলিও স্বাস্থ্য সাথী কার্ড গ্রহণ করতে চাইছে না। ফলে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে রেফারের ঘটনা তাই প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে, এই মুহূর্তে খরচ বাঁচানোর জন্য বহু বেসরকারি সংস্থা কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে। এর ফলে, সমস্যা হচ্ছে সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষের। কর্মসংস্থান একেবারে তলানিতে। এই অবস্থাতেও কি বলা যায় বাংলায় সবকিছু ঠিকঠাক চলছে?

ভারত না বাংলা, কে হবে পরের শ্রীলঙ্কা?

যথেচ্ছ দান-খয়রাতি যদি বন্ধ না হয়, তাহলে খুব শীঘ্রই শ্রীলংকার মত অর্থ ব্যবস্থার অবনতি হবে পশ্চিমবঙ্গে। যদি শুধু পশ্চিমবঙ্গ একা নয়, প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে কেন্দ্রীয় সচিবদের একাংশ একাধিক অবিজেপি শাসিত রাজ্য নিও এই একই রকম উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। বিজেপির শাসনের বিষয়টি বাদ দিলেও, পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক অবস্থা যে খুব একটা ভালো সে কথাটা বলা যায়না। ভোটের আগে যেভাবে সরকারি প্রকল্পের যথেচ্ছ অপব্যবহার হয়েছে, যেভাবে বিনামূল্যে প্রকল্প চালু হয়েছে, তাতে রাজ্যের কোষাগারের ওপরে প্রভূত চাপ বাড়ছে। বাংলা কার্যত ঋণের বোঝায় ডুবে রয়েছে। অবিলম্বে এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে এসে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। 

কিন্তু সেখানেই আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তোপ দেগে দিয়েছেন শ্রীলংকার মত অবস্থা হবে গোটা ভারতের। তার দাবি, ভারতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি একটা বড়ো ইস্যু হয়ে দাড়িয়েছে। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে তোপ দেগে দিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের জন্যই নাকি এই অবস্থা ভারতের অর্থনীতির। তাঁর দাবি, একদিকে যেমন অর্থনৈতিক বৃদ্ধি একেবারে স্তব্ধ। অন্যদিকে আবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণে একেবারে ব্যর্থ কেন্দ্রীয় সরকার। পেট্রোল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি পুরো ভারতের অর্থনীতিকে সমস্যায় ফেলে দিচ্ছে বলেই অভিমত মমতার। কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থ নীতির দিকে আঙুল তুলে মমতার দাবি, শ্রীলংকার থেকেও খারাপ অবস্থায় আছে ভারতের অর্থনীতি। 

গৌরী সেনের কি দেখা মিলবে? 

পশ্চিমবঙ্গ বারবার এখন একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে চলেছে, পশ্চিমবঙ্গের গৌরী সেন কোথায়? সম্প্রতি চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য যে রাজ্য বাজেট পেশ করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, রাজ্য সরকারের আয়, ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম। লক্ষীর ভান্ডার কিংবা স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পে পশ্চিমবঙ্গের তরফ থেকে ব্যয় বরাদ্দ অনেক বেশি বাড়ানো হয়েছে। তবে, যেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের আসল আয়, অর্থাৎ শিল্প ও পূর্ত এইসব দপ্তরে কিন্তু ব্যয়বরাদ্দ খুব একটা বেশি নয়। সঙ্গেই খাদ্য এবং সরবরাহ দপ্তরের ভান্ডারে টান পড়েছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে, চলতি আর্থিক বছরে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করতে হবে রাজ্য সরকারকে। মানুষের কল্যাণ প্রকল্পে, অথবা অর্থব্যবস্থার স্বার্থে, রাজ্য সরকার ঋণ নিয়ে খরচ করতে পারে। কিন্তু, অর্থ উপার্জনের পন্থা হিসেবে যদি কোন রাজ্য সরকারের ঋণ গ্রহণের বিষয়টিকে ধরে ফেলে তাহলে সমস্যার। 

যদিও পশ্চিমবঙ্গের এই সমস্যা বহু পুরনো। এর আগে বাম আমলেও এই একই রকম ঋণের বোঝা ছিল পশ্চিমবঙ্গের মাথায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে ঋণের বোঝা কিছু পরিমাণ লাঘব হলেও লাভের লাভ তেমন কিছুই হয়নি। বরং অর্থনীতিবিদদের ধারণা, এবছর এই সমস্যাটা আরো জটিল হতে চলেছে। এই বছর জিএসটি ক্ষতিপূরণের মেয়াদ শেষ হবে। পরিসংখ্যান বলছে, অতিমারি এবং লকডাউন এর কারণে অর্থব্যবস্থা ধাক্কা খাওয়ার পরে পশ্চিমবঙ্গ সহ একাধিক রাজ্য এই জিএসটি ক্ষতিপূরণের উপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছে। আর পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই জিএসটি ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আরো বড় করে সামনে এসেছে। যদি এই ক্ষতিপূরণ চলতি বছরেই বন্ধ হয়ে যায় তবে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সংস্থান এর উপর চাপ পড়বে। 

তাই এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের সাহায্য করতে না আসবে কোনো ঋণ, না কোনো কেন্দ্রীয় ক্ষতি পূরণ, প্রয়োজন শুধুমাত্র রাজস্বের অধিকতর নির্ভরযোগ্য এবং সুস্থায়ী উৎস সন্ধান। আর তার জন্য শুধুমাত্র একটি পথ রয়েছে এবং সেটা হল রাজ্যের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিমাণ বৃদ্ধি। প্রয়োজন আরো শিল্পায়নের, প্রয়োজন আরো কর্মক্ষেত্রের, প্রয়োজন আরো রাজস্বের। জনকল্যাণের সঙ্গে শিল্পোন্নতির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে, এবং এই মুহূর্তে রাজ্যের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা বিষয়টি স্বীকার করেন। তাই এই দিকে সবার আগে জোর দেওয়ার প্রয়োজন। বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা কিংবা মহিলাদের ন্যূনতম বুনিয়াদি আয়, রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিন্তু এরকম পদক্ষেপের গুরুত্ব খুব একটা নেই। তাই, শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের অসহযোগিতার কথা বলে দায় এড়িয়ে যাওয়া চলে না, বরং যেটা প্রয়োজন সেটা আগে করতে হবে রাজ্য সরকারকে।

More Articles