কতটা দুর্দশায় শ্রীলঙ্কার মানুষ? এর সুযোগ কি নেবে চিন?

শ্রীলঙ্কাজুড়ে হাহাকার। খাদ্যসংকট চরমে। ভরাডুবি ঘটে গিয়েছে দ্বীপ-রাষ্ট্রের অর্থনীতির। কিছু মাস আগেই নেট–দুনিয়ায় ভাইরাল হওয়া ‘মানিকে মাগে হিতে’–খ্যাত গায়িকা ইয়ানি নেটমাধ্যমে অর্থসাহায্য চেয়েছেন। টুইট করে তিনি লিখেছেন, “আমার দেশের অবস্থা খুব খারাপ। এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে ও দেশের মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। আপনারা আপনাদের সামর্থমতো শ্রীলঙ্কাকে অর্থসাহায্য করুন।”

কিন্তু কীভাবে এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হল শ্রীলঙ্কা? বাজারে আগুন, রাজকোষ শূন্য। নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসের দামেই নাভিশ্বাস উঠবে মানুষের। বর্তমান শ্রীলঙ্কার বাজারে চাল প্রতি কেজি ৫০০ টাকা, চা প্রতি কাপ ১০০ টাকা। সামান্য এক প্যাকেট পাউরুটির দাম ১৪০০ টাকা, দুধের দামও প্রায় কাছাকাছি। সোনার লঙ্কায় সত্যিই আগুন লেগেছে।

দিনের অধিকাংশ সময় অন্ধকারে শ্রীলঙ্কা। দেশে পেট্রল–ডিজেলের ভাঁড়ার প্রায় শূন্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হচ্ছে। তাও যে সকলের হাতেই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জোগান পৌঁছচ্ছে- তার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কেউই। রান্নার গ্যাস নেই। চরমে পৌঁছেছে মুদ্রাস্ফীতি। আন্তর্জাতিক বাজারে এতদিন চড়া সুদে ঋণ নিয়ে গিয়েছে শ্রীলঙ্কা। বর্তমানে তা শোধ দেওয়ার সামর্থও নেই শ্রীলঙ্কা সরকারের। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার তলানিতে এসে ঠেকেছে। কিছু বছর আগেও মানব উন্নয়ন সূচকে ওপরের সারিতে ছিল শ্রীলঙ্কা। সেখান থেকে কীভাবে এই দেউলিয়া দশা হল দেশের ? কীভাবে এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শুরু?

সন্দেহ নেই যে, করোনা পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কার পর্যটননির্ভর অর্থনীতি বেশ খানিকটা ধাক্কা খেয়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে শ্রীলঙ্কার বর্তমান শাসকদের বিবেচনাহীন নীতি। মাহিন্দা রাজাপক্ষ শ্রীলঙ্কায় ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সমস্ত নাগরিকের কর মকুব করা হবে। ক্ষমতায় আসার পর রাজাপক্ষ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণও করেছিলেন। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে গিয়েই দেশের অর্থনীতিকে এক গভীর সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছেন তিনি। এর পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় রোখার জন্য বিদেশি শক্তির কাছ থেকে দু’হাতে ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। চড়া সুদে স্বল্পমেয়াদি বানিজ্যিক ঋণ নিয়ে নিয়ে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে শাসকের দুর্নীতি। শ্রীলঙ্কার ‘দণ্ডমুণ্ডের কর্তা’ রাজাপক্ষ পরিবার ও তাদের মদতপুষ্ট তাঁবেদারদের অ–পরিণামদর্শিতার ফল ভুগছে আজ দ্বীপ-রাষ্ট্রের মানুষ। 

শ্রীলঙ্কার সরকারের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তই আজকের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন অনেকে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে সার কিনতে হয়, তার সঙ্গে আছে ক্রেতাদের ভর্তুকি। এই খরচ বাঁচানোর জন্য শ্রীলঙ্কা রাতারাতি বিদেশি সার নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। জোর দেওয়া হয়েছিল অর্গানিক সার ব্যবহারের ওপর। তাতে লাভ তো হয়ইনি, উল্টে ধানে ফলন কমেছে ২০ শতাংশ। বর্তমানে ধানের জোগান বজায় রাখতে চাল আমদানি করতে হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। শিল্পের অবস্থাও তলানিতে এসে ঠেকেছে। উৎপাদন বাড়েনি। বর্তমান শ্রীলঙ্কায় রাজকোষ ঘাটতির হার জিডিপির প্রায় ১৫ শতাংশ।

এছাড়াও শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক নয়। দীর্ঘদিন ধরে সিংহলি-তামিল গৃহযুদ্ধে এমনিই দেশের অবস্থা খারাপ ছিল। এই পরিস্থিতিতে একাধিক বৈদেশিক শক্তি শ্রীলঙ্কায় বানিজ্যিক লগ্নি করতে ভয় পেয়েছে। দেশে গণতন্ত্র ফেরানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমি দেশগুলির হস্তক্ষেপকেও ভাল চোখে দেখেনি রাজাপক্ষ-র সরকার। এই সুযোগ পরিপূর্ণভাবে নিয়েছে চিন। শ্রীলঙ্কাজুড়ে পরিকাঠামো উন্নয়নে বিপুল লগ্নি করেছে চিন। আসলে তা পরোক্ষে শ্রীলঙ্কার মতো দেশকে ঋণের জালে জড়িয়ে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অছিলামাত্র। এর পরিণামেই আজ শ্রীলঙ্কায় নাগরিকরা নেমে এসেছেন পথে। কোন পথে এই সমস্যার সমাধান? সদুত্তর খুঁজছে শ্রীলঙ্কা।

More Articles