তৃতীয় জয়ের এক বছরেই নড়বড়ে তৃণমূল? দল কি ভাঙছে আড়াআড়ি?
‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’– গেরুয়া বৈভবের গ্রাস থেকে জয় ছিনিয়ে নেওয়াই নয় শুধু, আসন বাড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) প্রত্যাবর্তনকে এমন শব্দবন্ধেই মুড়ে দিয়েছিলেন অনেকে। মানুষের মুখে মুখে শোনা গিয়েছিল, ‘শেষ ভাল যার, সব ভাল তার’। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের পর এখনও এক বছর পূর্ণ হয়নি। তার আগেই শেষটা আদৌ ভাল হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ নিজের ঘরের কোন্দল মেটাতেই এখন হিমশিম খাচ্ছে জোড়াফুল শিবির। পিছনের বেঞ্চে বসা ছেলেরা স্বভাবসিদ্ধ হুজ্জতি করছে– এমন অজুহাত দেওয়ার উপায়ও নেই তৃণমূলের (TMC)। কারণ দিদিমণির বকাঝকা উপেক্ষা করে গণ্ডগোল পাকাচ্ছেন একেবারে সামনের সারির ছাত্ররা, তা-ও আবার প্রকাশ্যে।
বিধানসভা নির্বাচনের একেবারে পরপর, ভোট-পরবর্তী হিংসার অভিযোগ নিয়ে যখন উত্তাল পরিস্থিতি, অহরহ হাই কোর্টে ধমক খেতে হচ্ছে রাজ্যকে, একের পর এক বিস্ফোরক অভিযোগ উঠে আসছে মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে, তখনও কিন্তু নৌকো টালমাটাল হয়নি একটুও। বরং হাতে হাত রেখে বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কথা বলতে দেখা গিয়েছিল ছোট-বড় সব তৃণমূল নেতাকে। কিন্তু তাল কাটার সূত্রপাত নতুন বছরের শুরুতে, পৌরসভা নির্বাচনের ঠিক আগে থেকে। সরাসরি দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Abhishek Banerjee) নিয়ে দ্বিধান্বিত অবস্থান সামনে চলে আসে। অলিখিতভাবে দলনেত্রীর উত্তরাধিকারী হলেও, তাঁর নেতৃত্ব মানেন না বলে প্রকাশ্যেই ঘোষণা করে দেন শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (Kalyan Banerjee)। পাল্টা তাঁকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে দাগিয়ে দেন ‘অভিষেকপন্থী’-রা। এছাড়াও দলে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রত্যাবর্তন নিয়েও দানা বাঁধে বিতর্ক। কল্যাণ সরাসরি আপত্তি করেন রাজীবের দলে ফেরার বিষয়ে।
শৃঙ্খলাভঙ্গের চোখরাঙানি, কড়া পদক্ষেপের হুঁশিয়ারিও সেই সময় দমিয়ে রাখতে পারেনি দু’পক্ষকে। শেষমেশ পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে আসতে হয় খোদ দলনেত্রীকে। এরপর হালকা তাপ-উত্তাপ থাকলেও, মাসদেড়েক সেভাবে আর হাটে হাঁড়ি ভাঙতে দেখা যায়নি কাউকে। আসানসোলে উপনির্বাচনের প্রচারে সম্প্রতি পাশাপাশি দেখা যায় অভিষেক এবং কল্যাণকে। সেখানে কুশল বিনিময় করতে যদিও দেখা যায়নি দু’জনের কাউকেই।
আরও পড়ুন: এমন অবিবেচক মেয়েকেই চেয়েছিল বাংলা?
এর মাঝে বারবার বোমা ফাটিয়েছেন মদন মিত্র। নানাভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছেন দলের প্রতি তাঁর ক্ষোভ। পরিস্থিতি এমন দিকে গেছে, তাঁর ফেসবুক ব্যবহারের ওপরেও নিষেধাজ্ঞা এনেছে দল। কামারহাটি পৌরসভার নির্বাচনের সময় কখনও নাম করে, কখনও নাম না করে সৌগত রায়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছেন তিনি। দলত্যাগী নেতাকে পাশে নিয়ে বেরিয়েছেন প্রচারে। তাই নিয়ে স্বয়ং মমতাও উষ্মা প্রকাশ করতে ছাড়েননি।
বিগত একমাসে কুণাল ঘোষ থেকে অনুব্রত মণ্ডল, অভিনেতা-সাংসদ দেব থেকে ফিরহাদ হাকিম— মমতার ঘনিষ্ঠবৃত্তে থাকা নেতাদের যে আচরণ সামনে এসেছে, তাতে দলের অন্দরে তাঁদের পারস্পরিক সমীকরণ নিয়েই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
সারদা-নারদা থেকে কাটমানি বিতর্ক, আগেও কম ঝড়-ঝাপটা পোহাতে হয়নি তৃণমূলকে। কিন্তু রামপুরহাটের ঘটনার পর থেকে কোথাও যেন ছন্দ মিলছে না। বগটুইয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গোটা রাজ্য যখন উত্তাল, পীড়িতদের সঙ্গে দেখা করতে ছুটেছিলেন মমতা। সেখানে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা থেকে শোকগ্রস্ত প্রৌঢ়ের শুশ্রূষায় এগিয়ে যাওয়া, পুলিশকে উর্দির গুরুত্ব বোঝানো থেকে নিজের ব্লক সভাপতিকে গ্রেফতারের নির্দেশ, পুরোটাই দক্ষ হাতে সামলাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু গোল বাঁধান বীরভূমে দলের দায়িত্বে থাকা, মমতার স্নেহধন্য ‘কেষ্ট’ ওরফে অনুব্রত মণ্ডল (Anubrata Mandal)। নেত্রীকে টপকে আগ বাড়িয়ে পুলিশকে মামলা সাজানোর পরামর্শ দিয়ে বসেন তিনি। বিতর্কিত এই অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ যে আশা করেননি, তা মমতার চাহনি এবং মুখের অভিব্যক্তিতেই তা স্পষ্ট ছিল।
আরও পড়ুন: ঝিমিয়ে পড়া বামেদের চাঙ্গা করছেন মহম্মদ সেলিম?
যদিও ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে সেই নিয়ে কথা বাড়াননি মমতা। কিন্তু অনুব্রত যে ঠিক কাজ করেননি, একদিন পরেই কলকাতায় বসে বুঝিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ (Kunal Ghosh)। ‘‘অনুব্রত মণ্ডল অনেক বড় নেতা। একটু বেশি বোঝেন। ওঁর কোনও কথার প্রেক্ষিতে মন্তব্য করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি না আমি,’’ স্পষ্ট শ্লেষ ঝরে পড়ে কুণালের কথায়। কলকাতার নেতা তাঁকে কটাক্ষ করেছেন জেনে নির্বিকার জবাব দিতে শোনা যায় অনুব্রতকেও। একলাইনে প্রতিক্রিয়া সারেন তিনি, ‘‘ওঁকে নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’’ কুণালের কথায় দলের মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে ধরে নিয়ে বিষয়টি মিটে যেতে পারত এখানেই। কিন্তু তা হয়নি, বরং সিবিআই-এর শমনপ্রাপ্ত অনুব্রতকে নিয়ে এমপি-এমএলএ আদালত কক্ষেও অনুযোগ উগরে দিয়েছেন কুণাল।
পুরনো একটি মামলায় সোমবার এমপি-এমএলএ আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন কুণাল। সেখানে জেলবন্দি থাকাকালীন নিজের দুর্দশার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে অনুব্রতকে ফের নিশানা করেন তিনি। আবেগপ্রবণ স্বরে বিচারকের সামনে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘এখন অনেক প্রভাবশালীর চিকিৎসা হচ্ছে উডবার্ন ওয়ার্ডে। কিন্তু জেলে থাকা অবস্থায় আমার দাঁতের যন্ত্রণার চিকিৎসা হয়নি। এখন এসএসকেএম-এর উডবার্ন ওয়ার্ড অসুস্থদের চিকিৎসাস্থল নয়, ওটা কয়েদিদের আশ্রয়স্থল।’’ এই মুহূর্তে এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন অনুব্রত। সিবিআই হাজিরা এড়াতেই তিনি রোগী সেজেছেন বলে লাগাতার বিঁধে চলেছেন বিরোধীরা। এমন সময় কুণালের সরাসরি অনুব্রতকে ‘কয়েদি’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার নেপথ্যেও রাজনৈতিক অভিসন্ধির গন্ধ পাচ্ছেন অনেকে।
বগটুইকাণ্ডে ধৃত আনারুল হোসেন অনুব্রতর ঘনিষ্ঠ। বালি-খাদানের বখরার টাকা নিয়ে গণ্ডগোলের জেরেই প্রথমে তৃণমূলের উপপ্রধান ভাদু শেখ খুনকে করা হয় এবং পরে অগ্নিসংযোগ করে শিশু-সহ ন’জনকে মেরে ফেলা হয় বলে প্রাথমিক রিপোর্টে ইতিমধ্যেই দাবি করেছে সিবিআই। এই ঘটনায় অনুব্রতর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বখরার ভাগ নেওয়ার পাশাপাশি অভিশপ্ত রাতে তিনি পুলিশকে কাজ করতে দেননি বলে অভিযোগও সামনে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে অনুব্রতর সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব বাড়াতেই কুণাল তাঁকে লাগাতার নিশানা করে চলেছেন অভিমত রাজ্য রাজনীতির বিভিন্ন মহলের। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ঘাটালের সাংসদ দেবের মন্তব্যও। বগটুই প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘ক্ষমতার নেশা এমন না হয়ে যায় যে, মানুষ মানুষকে চিনতে পারবে না।’’ দেব যদিও কারও নাম উল্লেখ করেননি, কিন্তু শাসকদলের সাংসদ, ক্ষমতা নিয়ে কাকে বা কাদের নিশানা করতে চেয়েছেন, দুইয়ে দুইয়ে চার করে নিতে অসুবিধা হয়নি কারও।
রাজ্যের মন্ত্রী তথা একেবারে গোড়া থেকে মমতার পাশে থাকা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও (Partha Chatterjee) রেহাই পাননি কুণালের বাক্যবাণ থেকে। এসএসসি-র গ্রুপ-ডি পর্যায়ে নবম এবং দশম শ্রেণির নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে পার্থর নাম জড়িয়েছে। তিনি শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীনই নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ। বিষয়টি আদালতেও পৌঁছে গিয়েছে। সিবিআই-এর দফতরে ডাক পড়েছে পার্থর। এমন পরিস্থিতিতে দলের বাকি নেতারা যখন কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগে সরব, সেই সময় একেবারে উল্টো পথে হেঁটেছেন কুণাল। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর এ-ব্যাপারে কোনও দায় নেই, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থকেই ব্যাখ্যা দিতে হবে বলে জানিয়ে দেন তিনি। তাতে সকলেরই মনে হয়েছে, কুণাল যেন নিয়োগ দুর্নীতির যাবতীয় দায় পার্থর ঘাড়েই ঠেলে দিলেন।
পরে যদিও কুণাল সাফাই দেন যে, তিনি শুধু কুৎসা, অপপ্রচারের সংশোধনের দায় পার্থর, একথা বলতে চেয়েছিলেন। তাঁকে দোষারোপ করেননি। কিন্তু ততক্ষণে জল অনেক দূর গড়িয়ে গিয়েছে। কুণালের মন্তব্য খণ্ডন করতে এবং পার্থর পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছেন রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম (Firhad Hakim)। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, কুণাল মন্ত্রিসভার সদস্য নন। মন্ত্রীসভায় রয়েছেন তাঁরা। তাই একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে, জবাবদিহির বিষয়টিও সকলের দায়িত্বের মধ্যে চলে আসে। পাল্টা কুণাল জানিয়ে দেন, মন্ত্রিত্ব পাওয়ার হ্যাংলামি নেই তাঁর মধ্যে। তিনি মন্ত্রী নন, একথা যেন তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া না হয়– এমন কড়া কথা বলতেও দ্বিধা করেননি কুণাল। আদালতকক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, আইকোর মডেল যাঁর, তিনিও এখন মন্ত্রী। তাঁকে জেলে ঢোকানোর দাবিও তোলেন কুণাল। এই ইঙ্গিতও পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দিকে বলেই মত অনেকের। এই নিয়ে পার্থ যদিও কুণালের বিরুদ্ধে একটি শব্দও খরচ করেননি। তাঁর হয়ে জবাব দিতে গিয়ে কুণালের সঙ্গে নিজেদের তফাত বুঝিয়ে দিয়েছেন ফিরহাদ। জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা দলের শৃঙ্খলাপরায়ণ সৈনিক। বাইরে কিছু আলোচনা করা ধাতে সয় না তাঁদের। প্রসঙ্গত, বেশ কয়েকদিন আগে মুকুল রায়কে গ্রেফতার করার দাবি জানিয়েও একটি টুইট করেন কুণাল, যদিও সেই টুইট পরে মুছে দিয়েছিলেন তিনি।
তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের এমন প্রকাশ্য কলহে সাধারণ মানুষ যেমন হতভম্ব, তেমনই বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে দলের অন্দরেও। এর আগে, অভিষেক-কল্যাণ পর্বে মমতা যখন সকলকে প্রকাশ্যে দলবিরোধী কথা বলতে নিষেধ করেছিলেন, তার পরেও প্রথম সারির নেতারা বাদানুবাদ, পরস্পরের প্রতি বাক্যবাণ কীভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন, প্রশ্ন উঠে আসছে সব মহল থেকেই। এই নিয়ে মমতা বা অভিষেক এখনও পর্যন্ত কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি যদিও। তবে দলের একজন মুখপাত্র, নিজের শিবিরের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধেই লাগাতার তোপ দেগে যাচ্ছেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সায় ছাড়া তা কী ভাবে সম্ভব, কানাঘুষোয় উঠে আসছে সেই প্রশ্নও। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা যেভাবে একের পর এক নেতাকে তলব করে চলেছেন, তাতে রক্ষণাত্মক অবস্থান থেকেই দলের মধ্যে দুই বিরোধী শিবিরের আপেক্ষিক চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস চলছে কি না, এমন ভাবনারও উদ্রেক করছেন অনেকে। এতে মমতা-অভিষেক দ্বন্দ্বের চেহারাই আরও স্পষ্ট হচ্ছে বলে দাবি করছেন অনেকে। হাঁসখালি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিতর্কিত মন্তব্যের পরপরই মহুয়া মৈত্রর সেখানে হাজির হওয়া ও ঘটনার বিরোধিতাও এই আড়াআড়ি বিভাজনের অংশ বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু রাজ্যে বিজেপি যখন সক্রিয়, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা যখন অন্য সব মামলা ছেড়ে শাসক দলের নেতাদের নাম জড়িত রয়েছে, এমন মামলাতেই বিশেষ সক্রিয়তা দেখাচ্ছেন, বিরোধী শিবির থেকে লাগাতার রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি উঠছে– সেখানে দলের নেতাদের পারস্পরিক সংঘাতের এই চিত্র, দল তথা সরকারের সামগ্রিক অবস্থানকে নড়বড়ে করে তুলবে কি না, সেই প্রশ্ন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তৃণমূলেরই নেতা-কর্মীদের।