গোলকিপার নয়, 'মেক্সিকান দেওয়াল' ওচোয়ার স্বপ্ন ছিল স্ট্রাইকার হওয়ার

FIFA World Cup 2022: তিনকাঠির নিচে তিনি ভরসার হাত। মেক্সিকোর 'ত্রাতা' ওচোয়া নীরবে থাকা এক কিংবদন্তি...

১ ডিসেম্বর, ভারতীয় সময় রাত সাড়ে ১২টা। বিশ্বের সমস্ত প্রান্তের আর্জেন্টিনীয় ফ্যানদের চোখ ছিল টিভির পর্দায়। পোল্যান্ডকে হারাতে পারলেই বিশ্বকাপের শেষ ১৬-এ জায়গা পাকা। অন্যদিকে কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে একই সময় মুখোমুখি হয়েছিল ফুটবল বিশ্বকাপের গ্রুপ সি-র আরও দু’টি দল। মেক্সিকো এবং সৌদি আরব। দু’দিকেই ধুন্ধুমার লড়াই। লাতিন আমেরিকার দু’টি টিমই দুই গোলে এগিয়ে গেল। এক সময় আর্জেন্টিনা জয় দিয়ে নিজেদের জায়গা পাকা করল। অন্যদিকে সৌদি ও মেক্সিকোর মধ্যে অতিরিক্ত সময়ের লড়াই। হঠাৎই দুর্দান্ত ওয়ান-টু-ওয়ানে মেক্সিকোর জালে বল জড়ালেন আল দাওসারি। মুখ থুবড়ে পড়ল মেক্সিকোর বিশ্বকাপ স্বপ্ন। এদিকে গোলের নিচে দাঁড়িয়ে রইলেন ছ’ফুট এক ইঞ্চির ঝাঁকরা চুলের ছেলেটা। ৩৭ বছর হয়ে গেল ছেলেটার। চার বছর পর আর হয়তো গ্লাভস হাতে দেশের হয়ে খেলতে নামবেন না তিনি। মেক্সিকোর গুইলেরমো ওচোয়ার চোখ তখন শূন্য। খেয়াল করলেন না, পৃথিবীর আপামর ফুটবল ভক্তরা উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে সাধুবাদ জানাচ্ছে। মেসি, রোনাল্ডোদের আড়ালে বসে থাকা এক কিংবদন্তি, দ্য মেক্সিকান ওয়াল, যাকে পেরোতে দু’বার ভাবতে হয় বিশ্বের তাবড় ফুটবল খেলোয়াড়দের…

এক মাথা ঝাঁকরা চুল, কপালে হেয়ারব্যান্ড। লম্বা দোহারা চেহারা। বিগত কয়েকটি বিশ্বকাপে এই বর্ণনা এলেই বুঝে যেতে হবে, ওচোয়ার কথা আলোচনা হচ্ছে। এই বিশ্বকাপের কথাই ধরা যাক। প্রথম ম্যাচে পোল্যান্ডের মুখোমুখি মেক্সিকো। পোলিশদের নেতৃত্বে গোলমেশিন রবার্ট লেওয়ানডস্কি। সুযোগ বুঝে জালে বল জড়িয়ে দিতে যার জুড়ি মেলা ভার। সেই লেওয়ানডস্কির আক্রমণ কার্যত ভোঁতা হয়ে গেল গুইলেরমো ওচোয়ার সামনে। কেবল পেনাল্টি বাঁচানো নয়, একের পর এক দুর্ধর্ষ সেভ তাঁকে অপ্রতিরোধ্য করে দিয়েছিল। পরের আর্জেন্টিনা ম্যাচেও বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, গোলের নিচে ওচোয়া ছিলেন বলেই ‘মাত্র’ দু’গোল খেয়েছে মেক্সিকো। না হলে এই ব্যবধান আরও বাড়ত।

আরও পড়ুন : ‘টিয়েন্টো’ থেকে ‘আল রিহালা’, ৯২ বছরে বিশ্বকাপের ফুটবলখানাই হয়ে উঠলো ‘হাইটেক’

ফুটবল জগতে গুইলেরমো ওচোয়ার ডাকনাম ‘মেমো’। মেক্সিকোর ক্যাপ্টেন হিসেবে বরাবরের প্রথম চয়েস। তিনকাঠির নিচে দুর্ভেদ্য। অথচ কেরিয়ার শুরুতে ওচোয়া একেবারেই গোলকিপার হতে চাননি। দু’হাতে দু’টো গ্লাভস পরে, গোলের নিচে দাঁড়িয়ে খালি বল ধরো – এই কাজ মেমোর না পসন্দ। আরও অনেক বন্ধুর মতোই প্রথমে তাঁর পছন্দ ছিল স্ট্রাইকারের পজিশন। কাটিয়ে কাটিয়ে, এক দৌড় দিয়ে গোল করা, এতেই বেশি আনন্দ পেতেন। কিন্তু কোচেদের ভাবনা ছিল অন্যরকম। তাঁরা দেখলেন, যতই স্ট্রাইকারের জায়গা পছন্দ হোক না কেন, তেকাঠির নিচে দাঁড়ালে ছোট্ট মেমো অন্যরকম হয়ে যায়। জাদু দেখায় তখন। সেই কোচেরাই বারবার গোলকিপার হওয়ার কথা বলতেন ওচোয়াকে। শেষ পর্যন্ত সেখানেই নিজের কেরিয়ার থিতু করালেন। ভাগ্যিস বাধ্য ছেলের মতো শুনলেন কথাগুলি। মেক্সিকোর সেই কোচেরাও হীরে চিনতে ভুল করেননি এতটুকুও।

কাসিয়াস থেকে বুঁফো, কিংবা পের চেক, নিউয়ার, কুর্তোয়া – বিশ্বের খ্যাতমান গোলকিপাররা বারবার নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন বিখ্যাত ক্লাবে। ওচোয়ার আদর্শ পিটার স্মিশেল নিজে ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেডের গোলকিপার ছিলেন। অন্যদিকে, ইউরোপের বড় বড় ফুটবল দলে কখনই ওচোয়াকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশ্বকাপ ছাড়া তাঁকে দেখতেও পাওয়া যায় না। সত্যিই কি তাই? আসলে ওচোয়ার যাতায়াত আমেরিকা ও লাতিন ফুটবল ক্লাবগুলির অন্দরে। ২০০৪ সালে মেক্সিকান লিগে তাঁর আত্মপ্রকাশ হয়। ক্লাব আমেরিকার হয়ে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি খেলেন। তারপরই একটু ভোলবদল হয়। ওই বছরই ফ্রান্সের আজাচ্চিও ক্লাবটির সঙ্গে তাঁর চুক্তি সম্পন্ন হয়। ২০১৪ সাল পর্যন্ত সেখানেই তিনি খেলেন। এরপর তিনি যান স্পেনের লা লিগায়। মালাগা ও গ্রানাডায় তিনি খেলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, সেখানে ওচোয়ার ঝলক দেখা যায়নি। শেষমেশ ২০১৯ সালে ফের চলে আসেন ক্লাব আমেরিকায়। এখনও সেখানেই খেলছেন তিনি।

অবশ্য ২০১৯-এর আগেই ফুটবল বিশ্ব দেখে নিয়েছে তাঁর প্রতিভা। ২০০৬ সাল। প্রথমবার দেশের জার্সি পরে বিশ্বকাপের মঞ্চে নামলেন ওচোয়া। কিন্তু তখনও এই নামটির সঙ্গে পরিচয় করে উঠতে পারেননি ফুটবল বোদ্ধারা। ২০০৯ সালের কনকাকাফ গোল্ড কাপে তিনি মেক্সিকোর হয়ে প্রতিটি ম্যাচে খেলেন। এই খেলাটার উল্লেখ করা একটি বিশেষ কারণে। এই টুর্নামেন্টের সেমি ফাইনালে কোস্টারিকার মুখোমুখি হয় মেক্সিকো। মূল ম্যাচ ১-১ ড্র হওয়ায় পেনাল্টি শ্যুটআউটে যায় খেলা। সেখানেই নিজের কামাল দেখান ওচোয়া। কোস্টারিকার শট রুখে সেখানে দলকে জিতিয়ে ফাইনালে তোলেন। সেমি ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচও হন। তারপর ফাইনালে ইউএসএ-কে ৫-০ গোলে হারিয়ে কাপ ঘরে তোলেন। অথচ এমন পারফর্মেন্সের পর, ২০১০ ফুটবল বিশ্বকাপে জায়গা পাওয়ার পরও মাঠে নামা হয়নি ওচোয়ার।

এরপরই জীবনে নেমে আসে কালো ঝড়। ২০১১ সালের কনকাকাফ গোল্ড কাপের সময় ওচোয়ার বিরুদ্ধে ডোপিংয়ের অভিযোগ ওঠে। তাঁর সঙ্গে মেক্সিকোর আরও চার খেলোয়াড় অভিযুক্ত হন। মেক্সিকোর ফুটবল ফেডারেশন বারবার বলে, এটা অনিচ্ছাকৃত ব্যাপার। মাংসের মধ্যে কোনওভাবে ওই নিষিদ্ধ ওষুধ মেশানো হয়েছিল। তারপরও নেমে আসে ব্যানের খাঁড়া। অবশ্য ওই বছরই অক্টোবরে ওয়াডা ওচোয়াদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেয়।

আরও পড়ুন : পুরুষদের বিশ্বকাপে ম্যাচ সামলাবেন এই মহিলা, যে ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে গোটা বিশ্ব

২০১৪ বিশ্বকাপেই গোটা বিশ্ব পরিচিত হয় গুইলেরমো ওচোয়ার সঙ্গে। গ্রুপ পর্যায়ে আয়োজক দেশ ব্রাজিলকে কার্যত একা হাতে থামিয়ে রাখেন তিনি। নেইমার অ্যান্ড কোং দিশেহারা হয়ে যায় ওচোয়ার সামনে। শেষমেশ সেই ম্যাচে একবারও জালে বল জড়াতে পারেনি ব্রাজিল। ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন ‘মেমো’, স্বয়ং ব্রাজিল কোচ স্কোলারিও তাঁর প্রশংসা করেন। নক আউট পর্যায়ে নেদারল্যান্ডের সঙ্গে হেরে গেলেও ম্যান অব দ্য ম্যাচের শিরোপা জিতে নেন ওচোয়া। তাঁর অবিশ্বাস্য পারফর্মেন্স, গোলের নিচে সঠিক সময় সঠিক জায়গায় চলে আসার অনুমান অবাক করে বিশ্বকে। এরপর ২০১৮ এবং ২০২২ – দু’টো বিশ্বকাপেও নিজের জাত চেনান ঝাঁকরা চুলের ছেলেটি।

এবছর মেক্সিকোকে ফিরে যেতে হচ্ছে গ্রুপ পর্যায় থেকেই। ফিরে যেতে হচ্ছে ওচোয়াকে। কিন্তু যাওয়ার আগে অন্যতম সেরার জায়গায় নিজের নামটি তুলে রেখে গেছেন। বিশ্বকাপ মানেই যার কাছে ফিনিক্স হয়ে ওঠার মঞ্চ। বিশ্বকাপ আর মেক্সিকো মানেই ছিল ওচোয়া। আর গ্লাভস জোড়া পরে বিশ্বকাপের মঞ্চে দেখা যাবে কিনা, জানে না কেউ। হয়তো আর নামবেন না তিনি। কিন্তু ফুটবল ইতিহাস মেক্সিকান ওয়ালকে ভুলবে না। মেক্সিকোর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গোলকিপার বললেও অত্যুক্তি হবে কি?

More Articles