পুরুষদের বিশ্বকাপে ম্যাচ সামলাবেন এই মহিলা, যে ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে গোটা বিশ্ব

FIFA World Cup 2022 : এবারই বিশ্বকাপে মহিলা রেফারিদের আগমন। গ্রুপ পর্যায় ম্যাচেই তৈরি হবে এক অনন্য ইতিহাস...

নানা ঘটনায়, অঘটনে জমজমাট হয়ে গিয়েছে কাতারের বিশ্বকাপ। গ্রুপ পর্যায়ের শেষ ধাপের খেলাও শুরু হয়ে গিয়েছে। আর কয়েকদিন পরেই শেষ ১৬-র লড়াই শুরু। তারই আগে আজ হাই ভোল্টেজ ম্যাচ, জার্মানি বনাম কোস্টারিকা। তার আগে গতকাল, বুধবার কোস্টারিকার কোচ লুই ফার্নান্ডো সুয়ারেজ ম্যাচের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে সেই সময়ই তিনি উল্লেখ করলেন স্টেফানি ফ্রাপার্টের কথা। নিজের টিম, বিপক্ষ জার্মানির কথা ভুলে স্টেফানির উচ্চকিত প্রশংসা করে গেলেন সুয়ারেজ। তাঁর বক্তব্য, ফুটবলের মতো ‘সেক্সিস্ট’ একটি খেলায় স্টেফানিরা ঝড়ের মতো। পুরুষতন্ত্রের বেড়াজাল ভেঙে তাঁরা নতুন ইতিহাস গর্তে চলেছেন। যার সাক্ষী থাকবে জার্মানি আর কোস্টারিকা। ম্যাচের ফলাফলের আগেও এই ইতিহাসই বিশ্বকাপের এই ম্যাচটিকে অনন্য করে তুলেছে।

ব্যাপারটা কী? জার্মানি বনাম কোস্টারিকা ম্যাচে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ামক সংস্থা ফিফা। গ্রুপ ‘ই’র এই ম্যাচে প্রধান রেফারি হিসেবে মাঠে থাকবেন ফ্রান্সের স্টেফানি ফ্রাপার্ট। শুধু তাই নয়, স্টেফানির সঙ্গে সহযোগী হিসেবে থাকবেন আরও তিনজন মহিলা রেফারি। আল বায়েত স্টেডিয়ামের মাঠে তাঁর সহকারী হিসেবে থাকবেন ব্রাজিলের নেউজা ব্যাক এবং মেক্সিকোর কারেন ডিয়াজ মেদিনা। মাঠের বাইরে রিভিউ টিমে চতুর্থ রেফারি হিসেবে থাকবেন আমেরিকার ক্যাথরিন নেসবিট। এক কথায়, মহিলারা রেফারিরাই একযোগে সামাল দেবেন বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চ। গোটা বিশ্ব এই পদক্ষেপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কেবল কোস্টারিকার কোচ সুয়ারেজ নন, এই টিমের মিডফিল্ডার সেলসো বর্গেস থেকে শুরু করে জার্মানির কোচ হানসি ফ্লিক – প্রত্যেকের মুখে স্টেফানি ফ্রাপার্টের নাম। যোগ্যতার ভিত্তিতেই তাঁরা এই সুযোগ পেয়েছেন, এবং সেজন্য ফুটবল বিশ্বের চিরাচরিত অনেক অচলায়তন ভেঙে যাবে। এ নারীশক্তিরই জয়জয়কার, এক বাক্যে স্বীকার করছেন ফুটবল মহল।

কে এই স্টেফানি ফ্রাপার্ট? ফ্রান্সের ৩৮ বছর বয়সী এই তরুণী এর আগেও কাতার বিশ্বকাপের ময়দানে নেমেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ফুটবলের মহামঞ্চে প্রধান রেফারি হয়ে নামার সুযোগ এই প্রথম। তবে বড়ো ম্যাচের ক্ষেত্রে ফিফার অন্যতম নির্ভরযোগ্য রেফারি হিসেবে ইতিমধ্যেই নিজেকে প্রমাণিত করেছেন স্টেফানি। ২০০৯ সাল থেকে তিনি ফিফার আন্তর্জাতিক রেফারিদের তালিকায় রয়েছেন। যার প্রস্তুতিটা শুরু হয়েছিল ফ্রান্সের হারব্লে-সার সেইন থেকে। এখানেই ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে জন্মেছিলেন স্টেফানি ফ্রাপার্ট। খুব ছোটো বয়স থেকেই ফুটবলকে ভালোবাসতে সেখা। বিশেষ করে ম্যাচ পরিচালনার দিকে বরাবরের উৎসাহ ছিল স্টেফানির। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৩ বছর। সবেমাত্র বয়ঃসন্ধির দরজায় পা দেওয়া। তখন থেকেই রেফারিংয়ের দুনিয়ায় পা রেখেছেন তিনি। তখন অবশ্য ছোটখাটো ইউথ গেমসগুলিতে মায়চ পরিচালনা করতেন। ১৮ বছর হতে না হতেই ফ্রান্সের জাতীয় স্তরের অনূর্ধ্ব-১৯ প্রতিযোগিতায় রেফারি হিসেবে অবতীর্ণ হন। চুপিসারে বিপ্লবের জয়ধ্বনি তখন থেকেই বাজতে শুরু করে দিয়েছিল।

আরও পড়ুন : লজেন্স বিক্রি থেকে ফুটবলের ময়দান! রাতারাতি শিরোনামে ব্রাজিলের রিচার্লিসনের লড়াই আর কেচ্ছা 

২০১১ সাল থেকে ফ্রান্সের ‘চাম্পিয়নাত ন্যাশনাল’-এ রেফারিংয়ের সুযোগ পান স্টেফানি ফ্রাপার্ট। উল্লেখ্য, এটি ফ্রান্সের তৃতীয় পর্যায়ের ফুটবল লিগ। অবশ্য নিজের দক্ষতার ওপর বরাবর ভরসা ছিল স্টেফানির। ফলে সুযোগ আসতেও দেরি হল না। তখনই বারবার তৈরি হল রেকর্ড। মাত্র তিন বছর পর, ২০১৪ সালে, স্টেফানি ফ্রাপার্ট চলে গেলেন লিগ ২-এ। ফ্রান্সের দ্বিতীয় পর্যায়ের ফুটবল লিগে তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা রেফারি। ২০১৫ এবং ২০১৯-এর মহিলাদের ফুটবল বিশ্বকাপেও ম্যাচ পরিচালনা করেন তিনি। ২০১৯-এর বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচটিও তিনিই পরিচালনা করেছিলেন।

এরপর ২০১৯-এই ঘটল পদোন্নতি। আর তৃতীয় বা দ্বিতীয় নয়, ফ্রান্সের প্রথম সারির ক্লাবভিত্তিক ফুটবল প্রতিযোগিতা ‘লিগ ওয়ান’-এ রেফারিংয়ের সুযোগ পান তিনি। এই বছরই উয়েফা সুপার কাপে লিভারপুল বনাম চেলসির হাই ভোল্টেজ ম্যাচের দায়িত্ব পান। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে পান ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের অন্যতম বড়ো মঞ্চ ‘উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ’-এ রেফারিংয়ের সুযোগ। এখানেই বলে রাখা ভালো, প্রতিটা জায়গাতেই ইতিহাস তৈরি করেন স্টেফানি ফ্রাপার্ট। প্রতিটা ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা রেফারি।

আরও পড়ুন : কাতারের ময়দানে সুবোধবাবুর ত্রিশ হাজার ট্রান্সফরমার, বিশ্বকাপের মঞ্চে আলো জ্বালাচ্ছে বাংলা

২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপে আগেই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল ফিফা। নিয়ামক সংস্থার পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল, বিশ্বকাপের মঞ্চে এবারই সর্বপ্রথম মহিলা রেফারিদের জায়গা দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে স্টেফানি ফ্রাপার্টের নাম আসাটা স্বাভাবিক, সেটা বলাই বাহুল্য। তবে কেবল তিনিই নন, নেউজা ব্যাক, কারেন ডিয়াজ মেদিনা, ক্যাথরিন নেসবিটের পাশাপাশি আছেন রোয়ান্ডার সালিমা মুকানসাঙ্গা, জাপানের ইয়োশিমি ইয়ামাশিতা। মোট ছয়জন মহিলা রেফারি এবারে বিশ্বকাপে জায়গা পেয়েছেন। ইতিমধ্যে তাঁদের সবাইকে মাঠে দেখাও গিয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই সহকারী হিসেবে। তবে প্রত্যেকেরই বক্তব্য, মহিলা-পুরুষ ভেদাভেদ নয়, কাজই হোক আসল কথা। যোগ্যতার ভিত্তিতেই তাঁরা এই পর্যায়ে এসেছেন। প্রধান রেফারি হিসেবে মাঠে নামার আগে স্টেফানি ফ্রাপার্টও বলেছেন লিঙ্গসাম্যের কথা। ঠিক যেভাবে অচলায়তন ভাঙার স্পর্ধাকে স্বাগত জানিয়েছে ফুটবল বিশ্ব।

আরও পড়ুন : থিকথিকে ভিড় থেকে গরুর ভবিষ্যৎবাণী, বাংলাদেশের ফুটবল উন্মাদনায় হতবাক বিশ্ব

এই বিশ্বকাপে বারবার বিতর্কের সামনে এসেছে কাতার। প্রধান অভিযোগই ছিল বৈষম্যের। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসেননি আমন্ত্রিত মহিলা অতিথিরা। এলজিবিটি আন্দোলনের সমর্থনে ওয়ান লাভ আর্মব্যান্ড পরাও ব্যান করে দেয় কাতার কর্তৃপক্ষ। এসবের মাঝেই উঠে আসে একের পর এক প্রতিবাদের চিত্র। পর্তুগাল বনাম উরুগুয়ের ম্যাচে মাঠে নেমে দৌড়তে থাকা যুবক হোক, বা লিঙ্গসাম্যের সমর্থনে মেসিদের ‘বেগুনি জার্সি’ পরে মাঠে নামা – বার্তা ছিল খুব স্পষ্ট। স্টেফানি ফ্রাপার্ট, নেউজা ব্যাক, কারেন ডিয়াজ, ক্যাথরিন নেসবিটরা আরও একটা নতুন ইতিহাস তৈরি করার পথে। যে বিশ্বকাপ ‘আন্ডারডগ’ শব্দটি ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে, তুলে আনতে পারে স্টেফানিদের মতো শক্তিকে। কড়াভাবে মাঠে দাপিয়ে বেড়ানো এক নিঃশব্দ প্রতিবাদ, এক বিপ্লব – যা প্রতিধ্বনিত হবে আল বায়েতের প্রতিটি কোণায়।

More Articles