‘টিয়েন্টো’ থেকে ‘আল রিহালা’, ৯২ বছরে বিশ্বকাপের ফুটবলখানাই হয়ে উঠলো ‘হাইটেক’

Fifa World cup 2022 : বিশ্বকাপের ময়দানই যেন অতিসাধারণ এক ফুটবলকে নিমেষের মধ্যে করে দিলো হাইটেক

একটা বিশাল মাঠ। তাকে ঘিরে হাজার হাজার লাইট, ক্যামেরা। সবাই অপেক্ষা করে আছে অ্যাকশনের। খোদ লাইভ শো। অগণিত দর্শক সর্বক্ষণ নজর তাক করে আছে। প্লেয়াররা সব মুখোমুখি তৈরি। পলক পড়ছে না কারোর। অবশেষে একটা চিরাচরিত বাঁশির শব্দ, ওমনি নিমেষের মধ্যে স্তব্ধতা ভেঙে শুরু খিপ্র আক্রমণ। কেউ কাউকে একটুও জায়গা ছাড়ার জো নেই। ঝড়ের গতিতে পা বদল করে এগিয়ে চলেছে একটা গোলাকার স্বপ্ন। এটাই ‘ফুটবল’। ওই গোলাকার স্বপ্নটার নামের আস্ত একটা খেলা। যা নিয়েই এতো উত্তেজনা, এতো তর্কাতর্কি, এতো উৎকণ্ঠা।

একটা গোটা বিশ্ব এখন ফুটবল জ্বরে ভুগছে। মারাত্মক ভাইরাল এ জ্বর। আমজনতা থেকে রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মচারী, পুলিশ এমনকী ডাক্তার-বদ্দি কারোর নিস্তার নেই। মাসখানের এ অসুখের এমনই অমোঘ টান। কিন্তু এই এতবড়ো আয়োজন যাকে কেন্দ্র করে সে তো ওই এক তো রত্তি। অথচ মাঠের ঠিক মাঝখানটিকে কেমন অবলীয়ায় দখল করে রেখেছে। শুধু তাই নয় টানা নব্বই মিনিট ধরে নাকে দড়ি ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে সবাইকে। মাঠ তো বটেই এমনকী দর্শক আসনের শেষ সারিতে বসা লোকটিও তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেদিকে।

শুধু ‘বল’ নয়, ‘ফুটবল’। অর্থাৎ পায়ে করে দাপিয়ে বেড়ানো একমুঠো স্বপ্ন। যে স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার স্বাদ অসীম। সামান্য ক্লাব ফুটবলের বল ঘিরেই তো আবেগের শেষ নেই মানুষের সেখানে যদি হয় বিশ্বকাপের ফুটবল, তবে সে খানা তো স্বর্ণসম। এমন একটা আবেগকে ঘিরে রয়েছে অনেক সংস্কার। অনেকেই মনে করেন ম্যাচের সবটুকু ভাগ্যই নির্ভর করে ওই বলকে ঘিরেই। তাই তার গঠন, ক্ষমতা এবং সাজ পোশাক নিয়েও যথেষ্ট নিপুণতা থাকবেই।

১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে হওয়া প্রথম বিশ্বকাপ থেকে ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ, এই লম্বা সফরে ম্যাচের বলের হয়েছে বিস্ময়কর বিবর্তন। এখনও পর্যন্ত ২২ টি আলাদা আলাদা বলে খেলা হয়েছে বিভিন্ন বছরের বিশ্বকাপ। প্রতি বদলেই বলের উপকরণ, নকশা এবং কার্যকারিতায় এসেছে নানান সব পরিবর্তন। এই বিশ্বকাপের ময়দানই যেন অতিসাধারণ এক ফুটবলকে নিমেষের মধ্যে করে দিলো হাইটেক। আসুন ফিরে দেখা যাক এই অবিশ্বাস্য সফর নামা।

আরও পড়ুন : লজেন্স বিক্রি থেকে ফুটবলের ময়দান! রাতারাতি শিরোনামে ব্রাজিলের রিচার্লিসনের লড়াই আর কেচ্ছা

১৯৩০ সাল। শুরুর বিশ্বকাপ হয়েছিল উরুগুয়েতে। যদিও শুরুতেই আলাদা করে তৈরির ভাবনা মাথাতেও আসেনি ফিফার। সেবার প্রত্যেকটি ম্যাচের প্রথমার্ধ ও দ্বিতীয়ার্ধ খেলা হয়েছিল দুটি পৃথক বলে। উক্ত ম্যাচে অংশগ্রহণকারী দুটি দলই একটি একটি করে বল দিয়েছিল। সেই বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছিল আর্জেন্টিনা এবং উরুগুয়ে। প্রথমার্ধের বল টিয়েন্টো নামের বলটি দিয়েছিল আর্জেন্টিনা। যা বানিয়েছিল স্কটল্যান্ডের একটি সংস্থা। পরের অর্ধেক খেলাটি হয় উরুগুয়ের দেওয়া দ্য টি-মডেল বলে। ইংল্যান্ডের কোম্পানি জন সল্টার অ্যান্ড সনের বানানো এই বলটিতে ছিল T আকৃতির ১২টি প্যানেল। বলটি ছিল অপেক্ষাকৃত ভারী এবং আকারেও বড়।

১৯৩৪ -এর ইতালি বিশ্বকাপের আগেই প্রথম ফিফার কর্মকর্তাদের মাথায় আসে, বিশ্বকাপের জন্য পৃথক বল বানানোর ভাবনা। সেইমতো কোম্পানি বানিয়েছিল বিশ্বকাপের প্রথম অফিসিয়াল ম্যাচ বল ফেডেরালে – ‘ওয়ান জিরো টু’। সেই বলে ছিল অভিনব কারিগরি। বলার ১৩ টি বহুভূজাকার প্যানেলই ছিল হাতে সেলাই করা। শুধু তাই নয় অভিনব সেই বলে একটি আলাদা প্যানেল রাখা হয়েছিল লেস বাঁধার জন্য।

এরপর ১৯৩৮ -এর ফ্রান্স বিশ্বকাপের জন্য প্যারিসের অ্যালেন কোম্পানি বানিয়েছিল ম্যাচ বল ‘অ্যালেন’। দেখতে হুবহু আগের বিশ্বকাপের বলটির মতোই ছিল এটি। কেবল বলের গায়ে লেখা ছিল নামের হলফ। এরপর আবার নতুন বল হয় ১৯৫০-এর ব্রাজিল বিশ্বকাপে। লুই পোল, অ্যান্তোনিও টোসিলিনি ও জুয়ান ভালবোনেসির সুপারবল কোম্পানির বানানো সেবারের বলটির নাম ছিল ডুপ্লো-টি। সেই প্রথম লেস-মুক্ত বলে খেলা হয়েছিল বিশ্বকাপ। পাশাপাশি প্রথমবারের জন্য ফুটবলে ব্যবহার করা হয়েছিল সিরিঞ্জ ভালব। বলের ভেতর ভরে দেওয়া হয়েছিল উন্নতমানের রবার দিয়ে তৈরি ব্লাডার।


এর ঠিক পরের বিশ্বকাপের আগেই বল নিয়ে নানারকম বিতর্কের সূত্রপাত হয়। বলের আকার এবং ওজন নিয়ে অভিযোগ জানাতে শুরু করে দলগুলি। তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেয় ফিফা। বলের আকার, ওজন ও ব্যাস সরকারিভাবে বেঁধে দেওয়া হয়। ঠিক হয় বলের পরিধি রাখতে হবে ৬৮-৭০ সেন্টিমিটারের মধ্যে। এবং ওজন হতে হবে ৪১০-৪৫০ গ্রামের মধ্যে। সেই নির্দেশ মেনেই সেবার বিশ্বকাপের বলটি বানায় সুইৎজারল্যান্ডের কস্ট স্পোর্টস কোম্পানি। কমলা রঙের এই বলটির নাম সুইস ওয়ার্ল্ড চাম্পিয়ন। এটিই বিশ্বকাপের ময়দানে প্রথম ১৮ প্যানেলের বল।

এরপর ১৯৫৮ সুইডেন বিশ্বকাপের বাদামি, কমলা ও সাদা রঙের ম্যাচ বল ‘টপ স্টার’ বানিয়েছিল সুইডেনের সিডলাডের কোম্পানি। ১০২ টি কোম্পানির সঙ্গে রীতিমত প্রতিযোগিতায় জিতে ২৪ টি প্যানেলের এই বলটি জায়গা পায় বিশ্বকাপের মাঠে। চিলি বিশ্বকাপের (১৯৬২) - এর ম্যাচ বল ক্র্যাক বানিয়েছিল চিলির ‘সেনর কাস্টোডিও জামোরা’ কোম্পানি। অসাধারণ চমক ছিল বলার নকশায়। যদিও ক্র্যাক বলটিতে প্রথমার্ধের খেলা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধ খেলানো হয় একটি ইউরোপিয়ান বল দিয়ে। জানা যায়, ম্যাচ বল তৈরিতে অন্তর্ঘাতের গন্ধ পেয়ে ইউরোপিয়ান দল নাকি আয়োজক দেশ চিলির তৈরি করা বলে খেলতে চায়নি। পরেরবার এসব দিকেও সতর্ক থাকে ফিফা। বিনা বিবাদেই ব্রিটিশ কোম্পানি স্ল্যাজেঞ্জারের বানানো ‘চ্যালেঞ্জ ফোর-স্টার’ নামের ম্যাচ বলে খেলা হয় ৬৬-এর ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে।

বল নিয়ে নানারকম ওঠাপড়া তো ছিলই। তার সঙ্গে ছিল নানান আবেগও। আর সেই আবেগে জায়গা করে নিতে কোম্পানি গুলির মধ্যে লড়াইও চলতে লাগলো জোরদার। এরপর ১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে ঘটে গেল এক যুগান্তকারী ঘটনা। ম্যাচ বল তৈরি করলো আজকের খুব পরিচিত এক কোম্পানি। জার্মানির অ্যাডিডাস। অ্যাডলফ ড্যাশলারের অ্যাডিডাস অবশ্য ফুটবল বানাতে শুরু করেছিল ১৯৬৩ সাল থেকেই। ১৯৬৬ সালের ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে অ্যাডিডাসের তৈরি করা ফুটবল নির্বাচিত না হলেও, মেক্সিকো বিশ্বকাপে জায়গা মিললো তাদের। বিশ্বকাপে এল ৩২ প্যানেলের সাদা কালো বল। ১২ টি কালো পঞ্চভূজ ও ২০ সাদা ষড়ভূজের প্যানেল দিয়ে তৈরি করা বলটির এই রং নজর করতে সুবিধা হল টিভির দর্শকদেরও। যেন অচিরেই মাঠ এবং ঘরের আবেগ এক করে দিল অ্যাডিডাস। বলটিতে লেখা হয়েছিল “অফিসিয়াল ওয়ার্ল্ড কাপ মেক্সিকো ১৯৭০” ও অ্যাডিডাস নামটি। বলটির নকশা করেছিলেন ডেনমার্কের জাতীয় দলের প্রাক্তন গোলকিপার এইজিল নিয়েলসেন। পরবর্তীকালে সাদা কালো প্যানেলের বলটি বিশ্বজয় করেছিল। আর অ্যাডিডাস পাকাপাকি ভাবে হয়ে গেল ফিফার ম্যাচ বল প্রস্তুতকারী সংস্থা।

আরও পড়ুন : কাতারের ময়দানে সুবোধবাবুর ত্রিশ হাজার ট্রান্সফরমার, বিশ্বকাপের মঞ্চে আলো জ্বালাচ্ছে বাংলা

এরপর একে একে ১৯৭৪ পশ্চিম জার্মানি বিশ্বকাপে ‘টেলস্টার ডুরলাস্ট’, র জন্য ফিফা বেছে নিয়েছিল এজিল নিয়েলসেনের নকশা করা ও অ্যাডিডাসের তৈরি করা ৩২ প্যানেলের জলনিরোধক বল টেলস্টার ডুরলাস্ট(Telstar Durlast)। সেই প্রথম বিশ্বকাপে ব্যবহৃত হয়েছিল চামড়ার উপর পলিইউরেথিনের প্রলেপ দেওয়া বল। প্রবল বৃষ্টিতে ভিজলেও যে বলের আকার নষ্ট হবে না। এই বিশ্বকাপে অ্যাডিডাসের বানানো চিলি ডুরলাস্ট বলেও কিছু ম্যাচ হয়েছিল। জার্মানির বিশ্বকাপের ম্যাচ বল কিন্তু বানানো হয়েছিল অ্যাডিডাসের ফ্রান্সের কারখানায়।

১৯৭৮-এর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে ‘ট্যাঙ্গো’, ৮২- এর স্পেন বিশ্বকাপে ‘ট্যাঙ্গো-এসপানা’, ১৯৮৬-এর মেক্সিকো বিশ্বকাপে ‘আজটেকা’, ১৯৯০ - এর ইতালি বিশ্বকাপে ‘ইট্রুস্কো ইউনিকো’, ১৯৯৪ -এর আমেরিকা বিশ্বকাপে ‘কোয়েস্ট্রা’, ১৯৯৮-এর ফ্রান্স বিশ্বকাপে প্রথম বহুবর্ণের বল ‘ট্রাইকলর’, ২০০২-এর জাপান বিশ্বকাপে ‘ফিভারনোভা’, ২০০৬ - এর জার্মানি বিশ্বকাপে ‘টিমগায়েস্ট’, ২০১০ -এর দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে ‘জাবুলানি’, ২০১৪- এর ব্রাজিল বিশ্বকাপে ‘ব্রাজুকা’, ২০১৮ -এর রাশিয়া বিশ্বকাপে বিবর্তিত ‘টেলস্টার ১৮’, এবং অবশেষে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের হাইটেক বল ‘আল-রিহলা’ অ্যাডিডাস যেন ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে। ‘আল-রিহলা’, আরবী ভাষায় যার অর্থ “দ্য জার্নি”। এতোটা পথ পেরিয়ে এসেও নতুন একটা জার্নি। যার যে কেবল তীব্র গতি আছে তাই নয়, পরতে পরতে রয়েছে সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ঐতিহ্য। তাই ৪২০ গ্রামের এই বলটির ওপরও চিত্রায়িত হয়েছে সেসব নিদর্শন।

বিশ্বকাপের আঙিনায় সবচেয়ে মহার্ঘ জিনিসটি হল ‘গোল’। হাজার ডিফেন্স কাটিয়ে ক্ষিপ্র বেগে ছুটে চলা একটা আগুনের গোলা এই গোল। যা এনে দেওয়ার জন্যেই ৯২ বছর ধরে এক নাগাড়ে বিবর্তিত হয়ে চলেছে বিশ্বকাপের ম্যাচ বল। গোলকিপাররা যে আবহে নিছকই অসহায়। ‘গোল’টাই দস্তুর।

More Articles