ফ্রান্সের ইতিহাসে প্রথম কোনো প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জেলে! কী কী অভিযোগ?
Nicolas Sarkozy Sent to Jail: ২০২১ সালে বিচারপতি ক্রিস্টিন মী তাঁকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন এবং বলেন, সারকোজি ও তাঁর আইনজ্ঞের কর্মকাণ্ড ফ্রান্সের জনগণের কাছে বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।
ফ্রান্সের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের মুখোমুখি। দেশটির ইতিহাসে তিনিই প্রথম প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়ক যিনি কোনো অপরাধের দায় স্বীকার না করেও জেলে যেতে বাধ্য হলেন। সারকোজির জেলবন্দি হওয়া শুধু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকেই প্রভাবিত করছে না, বরং ফ্রান্সের রাজনৈতিক ইতিহাসকেও নতুন এক মোড়ে নিয়ে এসেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের সহযোগী নেতা ফিলিপ পেটেইন ১৯৪৫ সালে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে কারাগারে গিয়েছিলেন। এরপর দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে কোনো ফরাসি প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে কারাগারে পাঠানোর নজির ছিল না। এখন, সেই শূন্যস্থান ভরে গেল সারকোজির মাধ্যমে। দেশব্যাপী বিতর্ক, সমর্থক ও সমালোচকের প্রতিক্রিয়া, এবং আন্তর্জাতিক নজর— সবকিছু মিলিয়ে এই ঘটনা ফ্রান্সের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
মঙ্গলবার সারকোজি দক্ষিণ প্যারিসের লা স্যঁতে কারাগারে প্রবেশ করেন। বর্তমানে ৭০ বছর বয়সি সাবেক প্রেসিডেন্টকে কারাগারের আইসোলেশন শাখায় রাখা হয়েছে। তাঁকে প্রায় ৯ বর্গমিটার (৯৫ বর্গফুট) একটি কক্ষে থাকতে হবে। আপাতত পাঁচ বছরের জন্য এই কারাগারই তাঁর ঠিকানা।
আরও পড়ুন
ফের ফরাসি বিপ্লব? কেন পালাবদল চাইছে ফ্রান্স?
জেলে প্রবেশের সময় তিনি সাংবাদিকদের ছবি তুলতে অনুমতি দেননি। তবে জেলে যাওয়ার আগে তিনি লা ট্রিবিউন দিমাঞ্চে নামের এক সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “আমি জেলকে ভয় পাই না। জেলেও আমি মাথা উঁচু রাখব।” এছাড়া লে ফিগারো পত্রিকাকে জানিয়েছেন, কারাগারে তিনি তিনটি বই সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে একটি হলো আলেকজান্ডার ডুমারের ‘দ্য কাউন্ট অব মন্টে ক্রিস্টো’, যা এমন একজন মানুষের গল্প, যিনি অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ হন এবং যারা তাঁকে প্রতারণা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেন।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়, তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সমর্থকদের দিকে হাত নাড়েন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী, পপস্টার কার্লা ব্রুনি, এবং তাঁদের সন্তানরাও উপস্থিত ছিলেন। সারকোজির বড়ো ছেলে লুই সারকোজি আগামী বছর মেনটনের মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী। সে নির্বাচনের আগে সমর্থকদের পথে নামার আহ্বান জানান। আহ্বানের পর সমর্থকরা “সারকোজি, সারকোজি” স্লোগান দিতে শুরু করেন। পরে সারকোজি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেন, তিনি ‘নির্দোষ’ এবং এই ঘটনাকে ‘আইনের কেলেঙ্কারি’ বলে উল্লেখ করেন।
২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দায়িত্বে থাকা সারকোজি তাঁর কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। আদালত দুই মাসের মধ্যে সেই আবেদন পরীক্ষা করবে। ফ্রান্সের আদালতের নিয়ম অনুযায়ী, সাধারণত দোষীকে বাড়িতে বন্দি রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে যদি প্রমাণ নষ্ট করার আশঙ্কা থাকে, আদালত তাঁকে মুক্তি দেয় না।
সারকোজি-র বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ২০০৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তিনি লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির কাছ থেকে লাখ লাখ ইউরো অবৈধ তহবিল নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে ওই অর্থ নেওয়ার দায় থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন। এর আগে তিনি আরেকটি দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তখন বাড়িতে বসে ইলেকট্রনিক ট্যাগ পরে সাজা ভোগ করেছিলেন।
আরও পড়ুন
ফ্রান্সের এনজিওগুলির সম্ভাবনা আর সংকট
২০১৪ সালে সারকোজি-র মেয়াদ শেষ হওয়ার পর একটি আইনি তদন্তে গোপন তথ্য পাওয়ার জন্য বিচারপতির সঙ্গে গোপন ফোনে যোগাযোগ করেছিলেন। অভিযোগ ছিল, তিনি ঘুষের বিনিময়ে বিচারপতিকে উচ্চ পদে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন। ২০২১ সালে বিচারপতি ক্রিস্টিন মী তাঁকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন এবং বলেন, সারকোজি ও তাঁর আইনজ্ঞের কর্মকাণ্ড ফ্রান্সের জনগণের কাছে বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতি মামলাও রয়েছে। সারকোজি সব ধরনের দুর্নীতি বা অনৈতিক কাজের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তাঁর শাসনামলে বিশ্বব্যাপী আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে তিনি ফ্রান্সের অর্থনীতি সংস্কারের উদ্যোগ নেন এবং কড়া অভিবাসন নীতি চালু করেন। সমালোচকরা তাঁকে ‘ব্লিং-ব্লিং’ বলে ডাকে, কারণ তাঁর নেতৃত্বের স্টাইল ছিল কঠোর, তারকা প্রভাবিত এবং অত্যন্ত সক্রিয়। প্রেসিডেন্ট হবার পর তিনি মডেল ও গায়িকা কার্লা ব্রুনির সঙ্গে প্রেম করেন এবং ২০০৮ সালে বিয়ে করেন।
২০১২ সালে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সোশ্যালিস্ট প্রার্থী ফ্রঁসোয়াঁ ওঁলাদের কাছে হেরে যান। এরপর থেকে তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক তদন্ত শুরু হয়। ২০১৭ সালে রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তার মধ্য ডানপন্থী দল ‘লে রিপাবলিসিয়ঁন্স’ অন্য প্রার্থীকে নির্বাচিত করায় সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
তবে সারকোজির মামলা ও তাঁর বিরোধিতা ফ্রান্সে শাসন, ক্ষমতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে সুষমতা রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে।

Whatsapp
