ফ্রান্সের এনজিওগুলির সম্ভাবনা আর সংকট

France NGO: প্রতি বছর ফ্রান্সে প্রায় ৭০ হাজারটি নতুন সংগঠন তৈরি হয়, যেখানে বন্ধ হয় প্রায় ৩৫ হাজার সংগঠন। প্রতি দশজন কর্মীর মধ্যে একজন ফ্রান্সে এমন অলাভজনক সংস্থায় কাজ করেন।

JB

ফ্রান্সের ‘চতুর্থ শক্তি’¹ হয়ে উঠেছে বিভিন্ন এনজিও। এগুলি দেশের এবং নাগরিকদের জীবনে মৌলিক ভূমিকা পালন করে। সংস্থাগুলির সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবকরা এমন বহু উদ্যোগ নেয়, যা ফরাসিদের সামগ্রিক জীবনযাত্রা উন্নত করে তোলে। তবে এসব সংগঠনের টিকে থাকা, আর্থিক সম্পত্তি এবং ফরাসি নাগরিকদের অংশগ্রহণের মনোভাব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।

প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি স্কুল খোলার² কিছুদিন পরেই ফ্রান্সের প্রতিটি শহরে ‘অ্যাসোসিয়েশন ফোরাম’ অনুষ্ঠিত হয়— এই সংস্থাগুলি এসময় থেকেই পূর্ণ উদ্যমে কাজ শুরু করে। রৌদ্রোজ্জ্বল এক রবিবারে নিজেদের কাজের বা পারিবারিক দায়িত্বের বাইরেও অন্য কার্যকলাপে যুক্ত হতে পরিবারগুলি ও প্রাপ্তবয়স্করা প্রদর্শনী কেন্দ্রে³ যান। প্রত্যেকের জন্যই সেখানে কিছু না কিছু কাজ আছে— সেটা খেলাধুলা, কোনো শিল্প, কোনো সামাজিক বা মানবিক উদ্দেশ্য, কিংবা অন্যদের সাহায্য করা হতে পারে। কারণ ফ্রান্সে এমন সংগঠন দেড় মিলিয়নেরও বেশি। প্রতি বছর প্রায় ৭০ হাজারটি নতুন সংগঠন তৈরি হয়, যেখানে বন্ধ হয় প্রায় ৩৫ হাজার সংগঠন। প্রতি দশজন কর্মীর মধ্যে একজন ফ্রান্সে এমন অলাভজনক সংস্থায় কাজ করেন। বছরে প্রতি চারজনে অন্তত একজন কোনো সংগঠনে স্বেচ্ছাসেবকমূলক কাজ করেন, এবং প্রতি তিনজনের একজন অন্তত একটি সংগঠনের সদস্য⁴।

অ্যাসোসিয়েশনগুলি এবং তাদের সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবকরা অসংখ্য সুবিধা পেয়ে থাকে— বিশেষ করে কর এবং আয় ব্যয়ের হিসেবের ক্ষেত্রে, সংগঠনের সদস্যদের যে কোনওরকম সহায়তা প্রদান করা হয়। যেমন প্রদেয় চাঁদার ৬০% করমুক্ত রাখা হয়⁵।

সংগঠনগুলির থেকেই নথি নিয়ে ফরাসি সরকার ‘স্বেচ্ছাসেবক অ্যাকাউন্ট’ তৈরি করে, যেখানে স্বেচ্ছাসেবকদের দক্ষতা তালিকাভুক্ত থাকে। এর ফলে ভবিষ্যতে চাকরি বা অন্য সংগঠনে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবকরা এটিকে প্রমাণপত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। স্বেচ্ছাসেবকদের ‘কাজের সময়’ সংগঠনের হিসাবের একটি বিশেষ অংশে লিপিবদ্ধ হয়। এক ঘন্টা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করলে এক ঘন্টা নূন্যতম মজুরির কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়⁶। এর ফলে স্থানীয় প্রশাসন সহজে বুঝতে পারে কোনো অঞ্চলে একটি সংগঠনের প্রভাব কতটা, এবং সেই অনুযায়ী সংগঠনগুলির জন্য পরবর্তী বছরের বাজেটে অনুদান বরাদ্দ করে।

আরও পড়ুন- ফের ফরাসি বিপ্লব? কেন পালাবদল চাইছে ফ্রান্স?

সংগঠনগুলি নাগরিক, সাধারণ এবং সামাজিক কার্যকারিতা অনুযায়ী রাষ্ট্রের দ্বারা স্বীকৃতি পায়— যা ‘হলি গ্রেইল’-এর সঙ্গে তুলনা করা চলে। ফ্রান্সে প্রায় ২,৪০০টি সংগঠন এই স্বীকৃতি পেয়েছে। এই সংগঠনগুলি যা অনুদান পায়, তার জন্যও কর দিতে হয় না। এমনকি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অনুদানও করমুক্ত। সাধারণত স্বেচ্ছাসেবক এবং অভিজ্ঞ পেশাদারদের একটি অভিজ্ঞ দল থাকে সংগঠনগুলির। আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলির মধ্যে প্রথমেই আসে ‘রেড ক্রস’-এর নাম। যদিও জাতীয় পর্যায়েও এমন অনেক সংগঠন আছে, যেমন ‘Restos du Cœur’ ১৯৮৫ সাল থেকে শীতকালে অসহায়, গরিব মানুষদের বিনামূল্যে গরম খাবার বিতরণ করে আসছে। তাদের প্রচেষ্টার ফলেই খুচরো বিক্রেতারা আজ মেয়াদোত্তীর্ণ হতে চলা খাবার ফেলে দিতে পারে না— সেসব সংগঠনগুলোকে এই খাবার প্রদান করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে তাদের। 

ভোক্তাদের অধিকাররক্ষাকারী সংগঠনগুলিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্দেশে অ্যাপলকে বাধ্য করা হয় নতুন ফোনে ইউএসবি-সি পোর্ট ব্যবহার করতে, যাতে গ্রাহকদের প্রতিবার চার্জার কিনতে না হয়। এই নির্দেশ কার্যকর করার পিছনেও এই সংগঠনগুলিরই অবদান রয়েছে। এছাড়া সাইকেল চালকদের অধিকাররক্ষাকারী সংগঠনগুলি নির্বাচিত কর্মকর্তাদের কাছে আবেদন করে প্যারিস, স্ট্রাসবুর্গ, লিয়ঁ, বুর্জেস-কে এমন শহর করে তুলেছে, যেখানে সাইকেল চালানো আনন্দদায়ক। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শহর সাইকেলবান্ধব, সেখানকার নাগরিকরা বেশি সুখী⁷। সাধারণভাবে বলতে গেলে, রাস্তার পাশে ব্যাডমিন্টন ক্লাব সাধারণ মানুষকে স্বাগত জানায়, খেলা সম্পর্কে তাদের পরামর্শ দেয় এবং পরোক্ষভাবে নাগরিকদের শরীরকে সুস্থ রাখে; দাবা ক্লাব মস্তিষ্ককে তীক্ষ্ম করে তোলে; কমিউনিটি সেন্টার বাচ্চাদের হোমওয়ার্ক করতে সাহায্য করে; সংক্ষেপে নাগরিকরাই নাগরিকদের সাহায্য করে। আমরা আমাদের সরকার সম্পর্কেও একই কথা বলতে চাই⁸।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, স্বেচ্ছাসেবক, সদস্য এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সদস্যরা বৃদ্ধ হচ্ছেন, এবং তাঁদের কর্মক্ষমতাও। ১৯০১ সালের আইন⁹ অনুযায়ী তৈরি সংগঠনের মডেলে এখন ক্লান্তির ছায়া দেখা যাচ্ছে। যুদ্ধ-পরবর্তী ও ১৯৬৮ পরবর্তী সময় ছিল সংগঠনগুলির ‘সোনালি যুগ’। কিন্তু বর্তমানে সংখ্যাগত দিক থেকে এগুলি সক্রিয় থাকলেও ভবিষ্যত অনিশ্চিত।

আরও পড়ুন- ২ বছরে ৫ বার প্রধানমন্ত্রী বদল, কেন ক্ষোভে ফুঁসছে ফ্রান্স?

নবীন নেতৃত্বের অভাব:
অনেকেই পদে রয়েছেন শুধুমাত্র নতুন প্রার্থীর অভাবে। তরুণদের অংশগ্রহণ কম, বিশেষত নেতৃত্বে। অন্যদিকে প্রতিকূল নীতির ফলে তহবিলের ঘাটতি বাড়ছে। সংগঠনগুলির উপযুক্ত পরিকাঠামো বা সম্পদ নেই, যে কারণে তারা লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না। এর ফলে স্থানীয় নির্বাচিত কর্মকর্তাদের কাছে নানা বিষয়ে সংগঠনগুলির প্রস্তাব রাখার ক্ষমতা ও প্রভাব— দুই-ই হ্রাস পাচ্ছে। আজকের দিনে, যখন নাগরিকরা অনেক ক্ষেত্রে সরকারি পরিষেবার অবনতি নিয়ে ক্ষুব্ধ, তখন অনেক সময় এই সংগঠনগুলিই সরকারি দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছে। সমাজের কল্যাণ ও জনস্বার্থকে কেন্দ্র করে কাজ করছে। 

বর্তমানে সংগঠনগুলিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ কমছে। একটি জরিপ অনুযায়ী, সাধারণ মানুষ কোনো সংগঠনে যোগ না দেওয়ার প্রধান কারণ হলো সময়ের অভাব। এটা কি তবে এমন এক সমাজের লক্ষণ, যা ক্রমশ ব্যক্তিকেন্দ্রিক, আত্মমগ্ন, এবং অন্যের প্রতি ভীত হয়ে উঠছে? নাকি সমাজ এত দ্রুত চলছে যে মানুষ তাল মেলাতে পারছে না? তাহলে কি নমনীয় কাজের সময় খুঁজে বের করা উচিত? কী ভাবে ফ্রান্স ও তার নাগরিকদের জীবনে সংগঠনগুলির অবদান আরও ভালো ভাবে তুলে ধরতে পারি¹⁰?

বলা হয়, ফরাসিরা রাজনীতি সচেতন। কিন্তু কম লোকই জানে, স্থানীয় উদ্যোগগুলিতেও তাঁরা সমান সক্রিয়। আসলে এটা একধরনের প্রতিবেশীর সঙ্গে মিলেমিশে থাকার প্রয়াস। যেখানে একাত্মতা, পারস্পরিক সহযোগিতা যেমন রয়েছে, তেমন কিছু অসুবিধাও রয়েছে। এখন সেই ভাবনাই সংহত হচ্ছে আইনি ও সংগঠিত সহায়তায়। তবে এই সম্প্রদায়বোধটা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে পৌঁছে দিতে হবে, না হলে সমাজ ধীরে ধীরে নিজের প্রাণশক্তি হারাবে।

তথ্যসূত্র

1. ফর দ্য ফ্রেঞ্চ রিপাবলিক, দ্য লেজিসলেটিভ পাওয়ার ইজ হেল্ড বাই পার্লামেন্ট, দ্য জুডিশিয়াল পাওয়ার বাই কোর্টস অ্যান্ড এক্সিকিউটিভ পাওয়ার বাই দ্য প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড গভর্নমেন্ট লেড বাই দ্য প্রাইম মিনিস্টার

2.ইনস্ক্রিপ্ট ডট মী

3.আই অ্যাম ডেসক্রাইব দ্য স্পেসিফিক কেস অফ দ্য সিটি অফ মালহাউস হোয়্যার আই লিভ, বাট সিমিলার ইভেন্টস এক্সিস্ট ইন মেনি আদার সিটিজ ইন ফ্রান্স

4.ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ ডট অ্যাসোসিয়েশন ডট গভ ডট এফআর

5.৬৬% অফ দ্য ফি ক্যান বি ডিডাকটেড ফ্রম দ্য ইয়ার্লি অ্যামাউন্ট অফ ট্যাক্সেস টু বি পেইড

6.১১.৮৮অ্যাজ পার অক্টোবর ২০২৫

7.হ্যাপি সিটি ইনডেক্স ডট কম

8.অ্যাট দ্য টাইম অফ রাইটিং, দ্য গভর্নমেন্ট অফ দ্য লাস্ট প্রাইম মিনিস্টার, সেবাস্তিয়েন লেকর্নু, লাস্টেড ১৪ আওয়ার বিফোর দ্য প্রাইম মিনিস্টার প্রেজেন্টেড হিজ রেজিগনেশন টু প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ

9.ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ ডট লেজিফ্রান্স ডট গভ ডট এফআর

10.ইনযেপ ডট এফআর

More Articles