কম্পিউটারের মত করে মানবদেহের কোশের প্রোগ্রামিং! যন্ত্রের দৌড় এতদূর!

মানবদেহের কোশকে কম্পিউটার প্রোগ্রামের মত করে কি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? হ্যাঁ, এইবার সেই কঠিন কাজকে সম্ভব করে দেখাল বিট.বায়ো নামের একটি সংস্থা। উদ্দ্যেশ্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে এদের ব্যবহার করা এবং এদের উপর নতুন কোনো ওষুধের ব্যবহারিক প্রয়োগ পরীক্ষা করে দেখা। কিন্তু তার জন্যে এই কোশগুলোকে কেনই বা প্রোগ্রামিং করতে হবে? কী ভাবেই বা তা করা সম্ভব? এই আলোচনায় ঢুকতে হলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে আমাদের এই ছোটো ছোটো কোশগুলোর আদতে কত ক্ষমতা রয়েছে।

বস্তুত আমাদের শরীরের যে কোনো একটি ধরণের কোশের ক্ষমতা রয়েছে, অন্য কোনো ধরণের কোশে রূপান্তরিত হওয়ার। অর্থাৎ, কিডনির কোশের ক্ষমতা আছে ব্রেন সেলে রূপান্তরিত হওয়ার। আর এই রূপান্তর কখন, কী ভাবে হবে তা সবই নিয়ন্ত্রণ করে কোশের মধ্যে অবস্থিত জিন। এদিকে দেখতে গেলে আমাদের প্রত্যেকটি যে জিন রয়েছে, তাদের গঠন একই। মানে, ব্রেন সেলে যে জিন রয়েছে, কিডনর সেলেও সেই জিন রয়েছে , এদিকে ত্বকের কোশেও সেই জিনগুলি রয়েছে।

জিন হল ডিএনএ-এর একটি অংশ আর ডিএনএ বা ডি-অক্সি-রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডে রয়েছে অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, থিয়ামিন, সাইটোসিন নামের চারটি নাইট্রোজেন বেস , যারা জেনেটিক কোড গঠন করে । যারা বিভিন্ন ক্রমে আমাদের ডিএনএ-তে সাজানো থাকে এবং দুটি ভিন্ন ব্যক্তির ডিএনএ-তে নাইট্রোজেন বেসের এই ক্রম ভিন্ন বা জেনেটিক কোড । কিন্তু একটি মানুষের শরীরের সমস্ত কোশের ডিএনএ-তে নাইট্রোজেন বেসের এই ক্রমগুলি একই। ধরা যাক, আপনার মস্তিষ্কের যে কোনো কোশে ডিএনএ-তে নাইট্রোজেনের বেসগুলি অ্যাডেনিন-গুয়ানিন-থিয়ামিন-সাইটোসিন-গুয়ানিন-থিয়ামিন-অ্যাডেনিন এই ক্রমে সাজানো আছে, আপনার ত্বক ও কিডনি বা শরীরের যে কোনো কোশে নাইট্রোজেন বেসের ক্রম তাই-ই থাকবে।

তাহলে তাদের প্রত্যেকের জিন একই হওয়ার পরও, কেনই বা মস্তিষ্কের কোশ বা ব্রেন সেলের গঠন কাজ, কিডনির কোশ বা ত্বকের কোশের গঠন এবং কাজের থেকে আলাদা। তাত্ত্বিক ভাবে তো সেগুলো এক হওয়া উচিত, যেহেতু তাদের সবার মধ্যে যে জিনগুলি রয়েছে, তারা গঠনগত ভাবে একই। এখানেই আসল মজার শুরু।

ডিএনএগুলি থেকে আরএনএ বা রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডে তৈরি হয়, আর সেই আরএনএ থেকে তৈরি হয় প্রোটিন, যা আমাদের দেহে সমস্ত জরুরি কাজকর্মের জন্যে প্রয়োজন। ডিএনএ না থাকলে, তাদের নাইট্রোজেন বেসের এই নির্দিষ্ট ক্রম না থাকলে কিন্তু সে কাজ সম্ভব হত না। ডিএনএ-ই কোশের এবং সারা দেহে ঘতে চলা সমস্ত কাজকর্মের হর্তাকর্তা।  কোশ কোন রূপ ধারন করবে, তা নির্ধারিত হয় কোন কোশে কোন জিন কখন সক্রিয় হবে এবং নিজেদের কাজ করবে। অর্থাৎ দেখা গেল যে জিন ব্রেন সেলে সক্রিয়, তা কিন্তু কিডনি বা ত্বকের  কোশে সক্রিয় নয়, এবং যে জিনগুলি ব্রেন সেলে সক্রিয় তারাই অদ্ভুত ভাবে ব্রেন সেলের গঠন ও কাজ নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কিন্তু কোন কোশে কোন জিন সক্রিয় থাকবে এবং কোন জিন নিষ্ক্রিয়, তা নির্ভর করে একাধিক ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টরের উপর। ডিএনএ থেকে আরএনএ তৈরির পদ্ধতিকে বলে ট্রান্সক্রিপশন আর এই ট্রান্সক্রিপশনকে নিয়ন্ত্রণ করে একাধিক ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর। আর কোশের জিনগুলি আবার পাল্টা নিয়ন্ত্রণ করে কোন কোশে কোন ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর তৈরি হবে।

তাহলে আমরা যদি জিনের গঠন নিজেরা বদলাতে পারি, জিনকে এডিট করে, তাদের নাইট্রোজেন বেসের ক্রমগুলি বা জেনেটিক কোডগুলি আমাদের প্রয়োজন মত অদল-বদল করে নিতে পারি যদি, এবং ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টরের কাজ পুনরায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু এখানে বাদ সাধে কোশ নিজেই। কোশ আমাদের এই কোডগুলিকে কাজ করা থেকে ব্যহত করে জিন সাইলেন্সিং-নামের একটি পদ্ধতির মাধ্যমে। ফলে কোডগুলি জিনের মধ্যে থাকলেও, তারা আর ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর তৈরি করতে পারে না।

তাহলেই তো আমরা আমাদের কোশকে প্রোগ্রামিং করে নিতে পারি। এটি কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়েরই অনুরূপ। বিট.বায়ো সেই জন্যেই কোশের জিনের মধ্যে বেশ কিছু কোড প্রবেশ করাচ্ছে, যাতে প্রয়োজনীয় অন্যান্য কোডগুলির সাইলেন্সিং বা সাময়িক নিষ্ক্রিয়তা বন্ধ করে রাখা যায়। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এ কোডিং এর মত করেই, জিনের কোডগুলি বদলে কোশকে নতুন করে প্রোগ্রামিং করেছে এই সংস্থা। আপাতত স্টেম সেল থেকে তারা মানুষের দেহে পাওয়া যায় এমন কিছু নির্দিষ্ট ব্রেন সেল এবং পেশিকোশ তৈরি করেছে। প্রতিবেদনের শুরুতেই আলোচনা করছিলাম, মানুষের শরীরের প্রতিটি কোশের ক্ষমতা আছে, অন্য প্রকারের কোনো কোশে রূপান্তরিত হওয়ার। স্টেম সেল বস্তুত তাই-ই। এর থেকে যে কোনো প্রকারের কোশই তৈরি করা যায়।

আর এই কোশগুলির ওপর বিভিন্ন ওষুধের প্রভাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন এই সংস্থার গবেষকরা। কিন্তু ওষুধের প্রভাব পরীক্ষা করতে কি ইঁদুর বা গিনিপিগের কোশই যথেষ্ঠ ছিল না? গবেষকদের মতে, না তা ছিলো না। কারণ অনেক অসুখ আছে, যা মানুষের শরীরে দেখা দিলেও (যেমন অ্যালজাইমার) , ইঁদুরের শরীরে দেখা দেয় না। ফলে ওষুধের প্রভাব পরীক্ষা একদমই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এইবারে হাতেনাতে করা যাবে সেই সব পরীক্ষা। এর পাশাপাশি দেখা গেছে বিভিন্ন ড্রাগ ইঁদুরের দেহে যে ভাবে কাজ করে, তার আশানুরূপ প্রভাব মানুষের শরীরে দেখা যায় না। ফলে সরাসরি মানুষের দেহকোশেই এইবার পরীক্ষা করা যাবে বিভিন্ন ড্রাগ।

More Articles