"উঠে পড়ুন, প্রধানমন্ত্রী হতে হবে", রাত দুটোয় যেভাবে দেশ সামলানোর ভার পেয়েছিলেন ইন্দ্র গুজরাল

Inder Kumar Gujral: ইন্দ্র কুমার গুজরাল তখন চন্দ্রবাবুর জন্য বরাদ্দ ঘরে গিয়ে ঘুমোচ্ছেন। রাত দু’টোর সময় তেলেগু দেশম পার্টির এক সাংসদ গিয়ে ঘুম থেকে তুললেন।

জুন, ১৯৭৫। দিল্লির প্রধানমন্ত্রী আবাসে এক বয়োজ্যেষ্ঠ মন্ত্রীকে যা নয় তাই বলে তিরস্কার করছেন ইন্দিরা গান্ধীর কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয় গান্ধী। এবার আর মাথা ঠিক রাখতে পারলেন না বর্ষীয়ান মন্ত্রী। তিনি চেঁচিয়ে সঞ্জয় গান্ধীকে বলেই ফেললেন, “ভদ্রভাবে কথা বলো সঞ্জয়! আমি তোমার মায়ের আন্ডারে কাজ করি, তোমার আন্ডারে নয়।” চেঁচামেচি শুনে উপর থেকে নেমে এসেছেন ইন্দিরা গান্ধীও। বাদানুবাদ শুনে ইন্দিরা গান্ধী বুঝতে পারেন, ছেলের দৌলতে এত বছরের পুরনো বিশ্বস্ত সৈনিককে তিনি খুইয়েছেন।

কাট টু এপ্রিল, ১৯৯৭। ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্ত সেই মন্ত্রী এখন রাজনৈতিক সন্ন্যাসের পথে যাওয়ার সংকল্প করে নিয়েছেন। কিন্তু পরিস্থিতি যা, তাতে মনে হয় না এক্ষুণি হবে। দিল্লির অন্ধ্রভবনে সকাল থেকে মিটিংয়ের পর মিটিং হয়ে যাচ্ছে দেশের পরের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য। এই ৭৮ বছর বয়সে আর শরীর দেয় না। উপস্থিত অন্যান্যদের সঙ্গে কথা বলে একটু বিশ্রাম নিতে গেলেন বৃদ্ধ। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত দুটো। ঘুমটা সবে গাঢ় হয়ে এসেছে, ধড়ফড় করে তাঁকে তুলে দেওয়া হলো ঘুম থেকে। কী হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই বৃদ্ধকে বলা হল, “উঠে পড়ুন, আপনাকে প্রধানমন্ত্রী পদের শপথ নিতে হবে।” কথা হচ্ছে দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্র কুমার গুজরালের। তাঁর পরিচয় এই হতে পারে যে, তিনি জনপ্রিয় কবি ফইজ আহমেদ ফইজের অন্যতম প্রিয় ছাত্র ছিলেন, আবার এভাবেও হতে পারে যে তিনি দেশের অন্যতম সেরা কূটনীতিবিদ ছিলেন। তাঁর পরিচয় হতে পারে যে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর নয়নের মণি ছিলেন, আবার এভাবেও হতে পারে যে তিনি ইন্দিরার পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর চক্ষুশূল ছিলেন। গুজরাল ছিলেন এক রাজনায়ক, যিনি সারা জীবন সংবিধান এবং নীতিবোধের দোহাই দিয়ে এসেছেন। তিনি আবার এমন এক প্রধানমন্ত্রীও, যিনি সত্তার চোরাবালি থেকে নিজের কুর্সি বাঁচাতে নীতিবোধকেও জলাঞ্জলি দিতে পিছপা হননি। ইন্দ্র কুমার গুজরাল, এমন কয়েকজন মানুষের মধ্যে পরিগণিত হন যিনি একই জীবনে হাজারটা জীবন যাপন করেন।

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ইন্দ্র কুমার গুজরাল

১৯১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ঝিলম শহরে জন্ম হয় ইন্দ্র কুমার গুজরালের। সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। লাহোরের ডিএভি কলেজে পড়ার সময় ফইজ আহমেদ ফইজের সান্নিধ্যে আসেন। ফইজ নিজের এক কবিতায় লিখেছিলেন, “রোশন কহি বহার কে, ইমকান হুয়ে তো হ্যায়।” চল্লিশের দশকে যখন ভারত স্বাধীনতার মুখে দাঁড়িয়ে, সেই সময় লেখা হয় কবিতাটি। এই উক্তিটি এক নতুন যুগের সূচনাকাল নির্দেশ করে। ১৯৯৭ সালে ২১ এপ্রিল, ইন্দ্র কুমার গুজরাল যখন দেশের প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিচ্ছেন, তখন তাঁর নিশ্চয়ই সেই চল্লিশের দশকে কলেজে পড়া এই লাইনটি মনে পড়ে গিয়েছিল। নরসিংহ  রাওয়ের কার্যকাল শেষের পর ১৯৯৬ সালে ফের দেশে লোকসভা নির্বাচন হয়। সবচেয়ে বড় পার্টি হওয়ায় বিজেপি সরকার গঠন করে, অটল বিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় ১৩ দিন পর সরকার পড়ে যায়। কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়ে ইউনাইটেড ফ্রন্ট এবং এরপরেই দেশে শুরু হয় আড়াই বছর ব্যাপী এক রাজনৈতিক ডামাডোল। এই ডামাডোলের প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পান এইচডি দেবেগৌড়া এবং দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হন ইন্দ্র কুমার গুজরাল।

আরও পড়ুন- জেলে কেরানির কাজ করবেন সিধু, লালু থেকে চিদম্বরম – কেমন ছিল জেলকুঠুরির জীবন

ছোট থেকেই পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন গুজরাল। পার্টিশনের সময় সপরিবারে ভারতে চলে আসেন তিনি। এখানে এসে দিল্লিতে প্রশাসনিক কর্তা রূপে কাজে যোগ দেন। তবে রাজনীতিতে হাতে খড়ি হয় ১৯৫৮ সালে। ১৯৫৮ সালে দিল্লি মিউনিসিপাল কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন গুজরাল। সেই বছরই কংগ্রেসে যোগ দেন তিনি। ১৯৬৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশেই রাজ্যসভায় পাঠানো হয় গুজরালকে। ১৯৬৬-৬৭ সালে যখন কংগ্রেস পার্টিতে ভাঙন ধরছে তখন ইন্দিরার পাশে ছিলেন গুজরাল। পুরস্কার মিলল হাতে নাতে। দেশের বিদেশ মন্ত্রী হলেন তিনি। তারপর এল সেই এমার্জেন্সির কুখ্যাত সময়। এই সময় দেশের সূচনা এবং সম্প্রচার মন্ত্রী ছিলেন ইন্দ্র কুমার গুজরাল। এমার্জেন্সি ঘোষণা হওয়ার পরদিন সকালে গুজরালকে ডেকে পাঠান সঞ্জয় গান্ধী। এমার্জেন্সি রেডিওতে যখন ঘোষণা করা হয়েছিল তা দেশের বেশ কয়েকটি প্রান্তে শোনা যায়নি। এই নিয়েই গুজরালকে বেশ কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দেন সঞ্জয়। এই ঘটনার কথা আপনাদের শুরুতেই বলেছি। পার্টির ভেতর সঞ্জয় এবং ইন্দ্র কুমার গুজরালের সংঘাত এতটাই তীব্র হয়ে গেল যে ইন্দিরা গান্ধী বাধ্য হয়ে গুজরালকে রাশিয়ায় দেশের অ্যাম্বাসেডর করে পাঠালেন। পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার পড়ে গেলেও মোরারজি দেশাই এবং চরণ সিং, দু'জনেই গুজরালকে রাশিয়ায় রেখেছিলেন রাজদূত হিসেবে।

জনতা দলের চার প্রধানমন্ত্রী- এইচডি দেবেগৌড়া, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, চন্দ্রশেখর এবং ইন্দ্র কুমার গুজরাল (২০০২)

১৯৮০ সালে ভারতে ফিরে আসেন গুজরাল। ১৯৮৭ সালে ভারতীয় রাজনীতিতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল বোফোর্স। নতুন রাজনৈতিক সুযোগের সন্ধানে ভি পি সিংয়ের হাত ধরে কংগ্রেস ছেড়ে জনতা দলে চলে গেলেন গুজরাল। ১৯৮৯ সালে ভি পি সিং প্রধানমন্ত্রী হলে দ্বিতীয়বার বিদেশ মন্ত্রীর দপ্তর পান গুজরাল। এই সময় প্রথমবার জলন্ধর থেকে ভোটে জিতে লোকসভা পৌঁছন তিনি। দ্বিতীয় বার বিদেশ মন্ত্রী হতে না হতেই এক বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় গুজরালকে। তৎকালীন দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সৈয়দের মেয়ে রুবিয়া সৈয়দকে আটক করে জম্মু-কাশ্মীরের কয়েকজন জঙ্গি। তাঁকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়ে গুজরালের কাঁধে। ১০ জন জঙ্গিকে ছেড়ে দিয়ে রুবিয়া সৈয়দকে ফিরিয়ে আনেন ইন্দ্র কুমার গুজরাল। তবে বছর দু’য়েকের মধ্যেই পড়ে যায় জনতা সরকার। ১৯৯১ সালে পুনরায় লোকসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন গুজরাল। জলন্ধর নয়, এবার কেন্দ্র পাটনা। সঙ্গে লালুপ্রসাদ যাদবের সমর্থন থাকায় বিপুল ভোটে জেতেন গুজরাল। কিন্তু রিগিংয়ের অভিযোগে পাটনার ওই নির্বাচন বাতিল করে দেয় নির্বাচন কমিশন। ফলে দ্বিতীয় বার লোকসভা যাওয়া হয়না গুজরালের। এরপর ইন্দ্র কুমার গুজরাল একপ্রকার মানসিকভাবে স্থির করেই নিয়েছিলেন তিনি আর রাজনীতি করবেন না। কিন্তু ১৯৯২ সালে ভি পি সিংয়ের অনুরোধে, গুজরালকে বিহার থেকে রাজ্যসভায় পাঠালেন লালু প্রসাদ যাদব।

লালুর সাহায্যেই রাজনৈতিক পুনর্বাসন হয় ইন্দ্র কুমার গুজরালের

এরপর আমরা সোজা চলে যাব ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে। সেই সময় কংগ্রেসে রাওয়ের যুগ শেষ হয়ে সীতারাম কেশরীর যুগ শুরু হয়েছে। সীতারাম কেশরীর মনোবাঞ্ছা ছিল প্রধানমন্ত্রী হওয়ার। দেবেগৌড়ার বাড়িতে সেই সময় পুরনো কয়েকটি মামলার জেরে সিবিআই হানা পড়েছিল। সেই ঘটনার দোহাই দিয়ে কংগ্রেসের সমর্থন ফিরিয়ে নেওয়ার চিঠি রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেন চাচা কেশরী। ফলত রাজনৈতিক ডামাডোল শুরু হয় দিল্লিতে। শরদ পাওয়ার, রাজেশ পাইলট, অস্কার ফার্নান্ডেজ, প্রণব মুখোপাধ্যায়-সহ যাবতীয় নেতাদের দিল্লি ডেকে নিলেন কেশরী। যাতে জনতা দল, পদের লোভ দেখিয়ে কংগ্রেস থেকে নেতাদের ভাঙিয়ে না নিয়ে যেতে পারে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। অপরপক্ষে দিল্লিতে জড়ো হতে থাকলেন লালু প্রসাদ যাদব, মুলায়ম সিং যাদব, চন্দ্রবাবু নাইডু, ফারুক আব্দুল্লাহ, জে এস প্যাটেল, এস আর বোম্মাই, দেবেগৌড়া, জি কে মুপনার-সহ যুক্তফ্রন্টের নেতারা। একইসঙ্গে এলেন জ্যোতি বসু, হরকিষণ সিং সুরজিত, সীতারাম ইয়েচুরিদের মতো যুক্তফ্রন্টের সহযোগী বাম নেতারাও। যুক্তফ্রন্ট এবং বামেদের পক্ষ থেকে কংগ্রেসকে স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় কোনওভাবেই কংগ্রেসকে সমর্থন করা হবে না কেননা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। সীতারাম কেশরী ভেবেছিলেন, তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার ঘোষণা করলে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলি তাঁর সমর্থনে চলে আসবে। কিন্তু যথারীতি সেই প্ল্যান মাঠে মারা যায়। এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ১২ এপ্রিল পদত্যাগ করে দেন দেবেগৌড়া। রাষ্ট্রপতি শংকর দয়াল শর্মা তাঁকে নির্দেশ দেন পরবর্তী ব্যবস্থা হওয়া পর্যন্ত তিনি যেন প্রধানমন্ত্রীর পদ সামলান।

এই ‘পরবর্তী ব্যবস্থা’ ছিল আসলে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করা। কংগ্রেস, যুক্তফ্রন্ট বা বামফ্রন্ট কেউই চায়নি লোকসভা ভঙ্গ করে নতুন করে নির্বাচন করাতে। একপ্রকার বুকে পাথর রেখেই যুক্তফ্রন্টের নির্দেশ মেনে নিলেন সীতারাম কেশরী। এবার যুক্তফ্রন্টের ভেতর শুরু হল ‘গেম অব থ্রোনস’। যে রাজনৈতিক চরিত্ররা সারা জীবনে কখনও দিল্লির পাওয়ার করিডোরে আসেননি, তাঁরাও এক এক করে সত্তার মঞ্চে আবির্ভূত হতে শুরু করলেন। দেবেগৌড়া ইস্তফা দিতেই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবি ঠুকে দেন জি কে মুপনার। নিজের দল তামিল মানিলা কংগ্রেস এবং ডিএমকের মোট ৩৭ জন সাংসদ তাঁর পক্ষে ছিলেন। মুপনারের পাল্টা প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য দাবি করে বসেন তৎকালীন রক্ষামন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব। তবে মুলায়ামের সেই দাবির সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেন আরেক যাদব নেতা লালু প্রসাদ যাদব। অপর পক্ষে দেশের প্রথম দলিত প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য নিজের দাবি পেশ করেন রাম বিলাস পাসোয়ান। তাঁকে পিছন থেকে সমর্থন জোগাচ্ছিলেন শরদ যাদব, নীতিশ কুমার, জর্জ ফার্নান্ডেজরা। এবার কাজে এল চন্দ্রবাবু নাইডুর দুর্দান্ত পলিটিক্যাল ম্যানেজমেন্ট। তিনি বুঝতে পারলেন সরকার তৈরি হওয়ার আগেই ভেঙে যাবে এমন অন্তরবিরোধ চলতে থাকলে।

বিহার সামলাচ্ছিলেন চন্দ্রবাবু, তারমধ্যেই কর্ণাটক থেকে আবার উঠে আসে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবি। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য এবার দাবি করেন কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এস আর বোম্মাই। বোম্মাইকে সমর্থন করছিলেন কর্নাটকের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জে এস প্যাটেল। তবে এক দক্ষিণ ভারতের নেতার দাবির বিরোধিতায় সরব হয়ে যান আরও দুই দক্ষিণ ভারতীয় নেতা। এস আর বোম্মাইয়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন খোদ চন্দ্রবাবু নাইডু এবং তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধি। দু’জনেই অত্যন্ত শালীনভাবে বোম্মাইকে জানিয়ে দেন, তিনি টিডিপি এবং ডিএমকের সমর্থন পাবেন না। এইসব ডামাডোলের মধ্যে হল এক ঐতিহাসিক লাঞ্চ। ২০ এপ্রিল দুপুরবেলা, ৯ আকবর রোড অর্থাৎ শরদ যাদবের বাসস্থানে উপস্থিত হলেন যুক্তফ্রন্ট এবং বামফ্রন্টের সব নেতারা। মুলায়ম সিং যাদব এখনও নিজের দাবিতে অনড় ছিলেন। এবার লালু তাঁকে খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ করলেন ভোটাভুটিতে আসার জন্য। ভোটাভুটির প্রস্তাবে সসম্মানে নিজের নাম ফেরত নিয়ে নিলেন মুলায়ম। লাঞ্চ টেবিলে যে আলোচনা শুরু হয়েছিল তা গড়াল ডিনার টেবিল পর্যন্ত। রাত্রিবেলা লালু প্রসাদ যাদব নিজের হাতের সবচেয়ে সেরা তাসটি খেললেন। তিনি প্রস্তাব করলেন ইন্দ্র কুমার গুজরালের নাম। বাম দলের সবাই রাজি। সঙ্গে সঙ্গে ফোন গেল হরকিষণ সিং সুরজিতের কাছে। ওদিকে যুক্তফ্রন্টে সেরকম বিরোধ হয়নি গুজরালের নামে। কংগ্রেসও জানিয়ে দেয় তারা ইন্দ্র কুমার গুজরালকে সমর্থন দেবে। ইন্দ্র কুমার গুজরাল তখন চন্দ্রবাবুর জন্য বরাদ্দ ঘরে গিয়ে ঘুমোচ্ছেন। রাত দু’টোর সময় তেলেগু দেশম পার্টির এক সাংসদ গিয়ে ঘুম থেকে তুললেন ইন্দ্র কুমার গুজরালকে। গুজরাল ঘুম থেকে উঠতেই তাকে বলা হলো, “উঠে পড়ুন, আপনাকে প্রধানমন্ত্রী পদের শপথ নিতে হবে।”

জনতা দলের প্রথম সারির নেতারা

আরও পড়ুন- বন্ধ ঘরে যোগশিক্ষার আড়ালে… ইন্দিরা-যোগগুরুর সম্পর্ক নিয়ে ফিসফাস চলে আজও

তবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর কার্যকাল মোটেই সুখকর ছিল না। এই সময় সিবিআইয়ের চার্জশিটে পশু খাদ্য মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন লালু প্রসাদ যাদব। যুক্তফ্রন্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য লালুকে বাঁচাতে সিবিআই ডিরেক্টরকে ট্রান্সফার করে দেন গুজরাল। তাঁর এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হন শরদ যাদব, রামবিলাস পাসোয়ানরা। প্রকাশ্যে নিজেদের ক্ষোভ জাহির করে বাম দলগুলিও। ফলত ১৯৯৭ সালের জনতা দল থেকে আলাদা হয়ে নিজের আলাদা পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল তৈরি করেন লালু প্রসাদ যাদব এবং মুখ্যমন্ত্রী বানিয়ে দেন তার স্ত্রী রাবড়ি দেবীকে। ওই একই বছর, মুলায়ম সিং যাদবের অনুরোধে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির নির্বাচিত সরকার ফেলে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির চেষ্টা করেন ইন্দ্র কুমার গুজরাল। বহুজন সমাজ পার্টি, বিজেপির থেকে সমর্থন টেনে নেওয়ায় তাদের গরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে বলা হয় উত্তর প্রদেশ বিধানসভায়। বিজেপি নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখে কংগ্রেস এবং বহুজন সমাজ পার্টি থেকে বিধায়ক ভাঙিয়ে এনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করে দেয়। কিন্তু সেই গরিষ্ঠতাকে স্বীকার করতে অস্বীকার করেন উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল রোমেশ ভাণ্ডারি। উত্তরপ্রদেশে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে চেয়ে রাষ্ট্রপতিকে নিজের প্রস্তাবপত্র পেশ করেন গুজরাল। রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন সেই প্রস্তাব ফেরত পাঠিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে বলেন। ভদ্রতার খাতিরে আর দ্বিতীয়বার সেই প্রস্তাব পাঠাননি ইন্দ্র কুমার গুজরাল। ওই বছরই নভেম্বর মাসে একটি ঘটনা ঘটে যা গুজরালের প্রস্থান মোটামুটি নিশ্চিত করে দেয়।

রাজীব গান্ধীর হত্যা মামলায় জৈন তদন্ত কমিটি নিজেদের বিস্তারিত রিপোর্ট জমা দেয় কেন্দ্রীয় সরকারকে। অগাস্ট মাসে সেই রিপোর্টটি সরকারের হাতে আসে এবং নভেম্বর মাসে কোনও কারণবশত সেটি লিক হয়ে যায়। এই রিপোর্টে যুক্তফ্রন্টের অন্যতম সহযোগী দল ডিএমকে-কে রাজীব গান্ধীর হত্যার জন্য দায়ী করা হয়। রিপোর্টে সাফ বলা হয় ডিএমকের কারণেই তামিলনাড়ুতে বাড়বাড়ন্ত হয়েছে এলটিটিইর। কংগ্রেস এবার যুক্তফ্রন্টের উপর চাপ দেয় ডিএমকে-কে ফ্রন্ট থেকে নিষ্কাশিত করতে। যুক্তফ্রন্ট ভাঙতে অস্বীকার করে, ফলত সমর্থন ফিরিয়ে নেয় কংগ্রেস। ফলত সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় যুক্তফ্রন্টের সরকার পড়ে যায়।

এরপর ১৯৯৮ সালে দেশে ফের লোকসভা নির্বাচন হয়। মাত্র ৬টি আসন পেয়ে গুটিয়ে যায় জনতা দল। যদিও গুজরাল নির্বাচনে জয়ী হন জলন্ধর থেকে। কিন্তু দলের অমন বিশ্রি হারের পর রাজনীতি থেকে চিরকালীন অবসর নেন ইন্দ্র কুমার গুজরাল। জনতা দলও ততদিনে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। ২০১১ সালে কিডনির সমস্যার জন্য ডায়ালিসিস নিতে মেদান্ত হাসপাতালে ভর্তি হন ইন্দ্র কুমার গুজরাল। ৯০-এর উপর বয়স হয়েছিল, ফলত শরীর আর ধকল নিতে পারেনি। ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর প্রয়াত হন দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্র কুমার গুজরাল।

More Articles