বন্ধ ঘরে যোগশিক্ষার আড়ালে... ইন্দিরা-যোগগুরুর সম্পর্ক নিয়ে ফিসফাস চলে আজও
Indira Gandhi: দিল্লি তো বটেই, সমগ্র ভারতেরই রাশ নিজের আঙুলের ডগায় রেখেছিলেন যোগগুরু ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারী, ইন্দিরার সঙ্গে সম্পর্কের জোরে।
তিনি 'প্রিয়দর্শিনী'। জওহরলাল নেহরুর আদরের কন্যা। ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী। ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। এমন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জীবনে প্রেমের জোয়ার কোনও চোরাগোপ্তা পথে আসেনি। তাঁর জীবনে প্রেম এসেছে বারবার। প্রেমকে তিনি বরণ করেছেন জীবনের নানা পর্যায়ে। এমন আকর্ষণীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তিনি, যে মৃত্যুর পরও তাঁর জীবনচর্যা বারবার আলোচনায় এসেছে। সেই সঙ্গে এসেছে তাঁর প্রেমের জোয়ারে ভেসে যাওয়ার কাহিনি। রাজনীতির মতোই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও বর্ণময়। যোগগুরু ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারী সেই জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর মেয়েকে যোগ শেখাতে এসে বাঁধা পড়লেন প্রেমের আবর্তে, লেখা হলো এক গোপন প্রেমের আখ্যান। কীভাবে?
সালটা ১৯৪২। ইন্দিরা বিয়ে করলেন সাংবাদিক ফিরোজ গান্ধীকে। এর আগে ১৯৩০ সালে ফিরোজ গান্ধী আরও একবার তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ইন্দিরা তখন নাবালিকা, বয়স মাত্র ১৫। রাজি হয়নি পরিবার। সুখের হয়নি তাঁদের দাম্পত্যজীবন। কেএন রাও তাঁর 'নেহরু ডায়নাস্টি’ বইতে উল্লেখ করেছেন, বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে ইন্দিরা প্রেমে পড়েন মহম্মদ ইউনুসের। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় সেখানকার এক জার্মান শিক্ষকের প্রেমে মজেছিলেন তিনি।
তাঁর জীবনে সবচেয়ে আলোচিত প্রেমের অধ্যায়টি শুরু হয় এরপর। তিনমূর্তি ভবনে কাজের সময় এমও মাথাইয়ের প্রেমে পড়েন ইন্দিরা। এই প্রেম চলেছিল প্রায় ১২ বছর। শেষ পর্যন্ত ইন্দিরার জীবনে প্রবেশ করেন যোগগুরু। শুরু হলো এক অসম প্রেমের আখ্যান। কারণ সেই আখ্যানের প্রেমিকযুগল এক রাজনীতিক ও যোগগুরু।
আরও পড়ুন: ‘বাংলাদেশি বাবু’ ও ইন্দিরা গান্ধীর কণ্ঠস্বর! দেশের সবচেয়ে বড় রহস্য আজও অধরা
না, এই যোগগুরু কোনও আয়ুর্বেদিক পণ্যের ব্র্যান্ড খোলেননি। রাজনীতিতেও আসেননি। মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে যোগব্যায়াম শেখানোর জন্য তাঁকে নিয়োগ করেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। শোনা যায়, সেই কাজ করতে দিল্লি আসার বছরকয়েক পর, দিল্লি তো বটেই, সমগ্র ভারতেরই রাশ নিজের আঙুলের ডগায় রেখেছিলেন যোগগুরু ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারী।
ধীরেন্দ্র ছিলেন এক দীর্ঘদেহী বিহারী সুপুরুষ। শোনা যায়, তিনিই ছিলেন একমাত্র পুরুষ, যাঁকে একা ঘরে ইন্দিরার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। প্রতিদিন সকালে তাঁর সঙ্গে অন্তত একঘণ্টা চলত ইন্দিরার যোগাভ্যাস।
১৯৬০ সাল। তখন সদ্য স্বামীকে হারিয়েছেন ইন্দিরা। ফিরোজ গান্ধী মারা গেছেন। দুই পুত্র রাজীব এবং সঞ্জয় সবে কৈশোরে। ইন্দিরার বয়স ৪৩। ধীরেন্দ্রর সঙ্গে ইন্দিরার সাক্ষাৎ ওই বছরেই। যোগগুরুকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বন্ধুকে চিঠি লিখেছিলেন নেহরু-কন্যা। যুক্তরাষ্ট্রের নামজাদা ফটোগ্রাফার ডরোথি নরম্যানকে লেখা সেই চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে এক সুপুরুষ যোগীর কাছে আমার যোগশিক্ষা শুরু হলো।’ কেমন দেখতে ছিলেন সেই যোগী? ইন্দিরা বন্ধুকে লিখেছেন, ‘চমৎকার দেখতে। শারীরিক গঠনও বেশ আকর্ষক।’
ইন্দিরা নিজের কথা বলেননি। তবে তাঁর সঙ্গে যোগগুরুর সম্পর্ক নিয়ে গল্প থেমে থাকেনি। ইন্দিরার জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন মার্কিন লেখিকা ক্যাথরিন ফ্র্যাঙ্ক। নিজের বইয়ে ক্যাথরিন লিখেছিলেন, 'বন্ধ দরজার ভেতর প্রতিদিন যোগীর সঙ্গে অনেকখানি সময় কাটাতেন ইন্দিরা। সেসময় যদি কারও সঙ্গে ইন্দিরার সম্পর্ক হয়ে থাকে, তবে তিনি এই যোগগুরুই।'
গান্ধী এবং নেহরু পরিবারের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক ও লেখক ছিলেন খুশবন্ত সিং। সেই খুশবন্তও তাঁর চিরপরিচিত রাখ-ঢাকহীন ঢঙে বলেছিলেন, ‘ধীরেন্দ্র একজন লম্বা-চওড়া সুঠাম শরীরের বিহারী। বন্ধ ঘরে রোজ সকালে ইন্দিরার সঙ্গে তাঁর একঘণ্টার যোগশিক্ষা কামসূত্রের শিক্ষায় পরিণত হতেই পারে।'
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কন্যার যোগ-প্রশিক্ষক। ভারতে যোগগুরুর খ্যাতি ছড়াচ্ছিল দ্রুত। তাঁর কাছ থেকে যোগ প্রশিক্ষণ পেতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক আশ্রমও তৈরি হচ্ছিল। যোগগুরু ধীরেন্দ্র সেসব আশ্রমে যাতায়াত করতেন নিয়মিত। আর যেতেন ব্যক্তিগত বিমানে চেপে।
ব্যক্তিগত সংগ্রহে দু’টি বিমান ছিল ধীরেন্দ্রর। তার মধ্যে একটি সে-কালের ভারতে কেনা, সেই বিমানে চড়া তো দূর, চোখেই দেখেননি কেউ। তার সঙ্গে ধীরেন্দ্রর ছিল বিদেশি গাড়ির শখ। সংগ্রহও ছিল দেখার মতো। সাধারণ ভারতীয় তো দূর অস্ত, টাটা-বিড়লাদের মতো শিল্পপতিকেও সেইসব গাড়ি কিনতে ভাবতে হতো দু’বার।
না, যোগগুরু কোনও আয়ুর্বেদিক পণ্যের ব্র্যান্ড খোলেননি ঠিকই। তবে প্রতিপত্তির চূড়ায় পৌঁছে ধীরেন্দ্র একটি এয়ারলাইন্স সংস্থা খুলে ফেলেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন, ‘এয়ার অপর্ণা’। তার বিমান পরিবহণ সংস্থা এয়ার ট্যাক্সি পরিষেবা দিত। বিমান ওঠানামা করার জন্য ব্যক্তিগত তিনটি রানওয়ে ছিল ধীরেন্দ্রের। ছিল বিমান রাখার তিনটি নিজস্ব হ্যাঙ্গারও।
ইন্দিরার যোগশিক্ষকের প্রতিপত্তি যখন শিখর ছুঁয়েছে, তখন যোগাসন, বিমান, বিদেশি গাড়ির বাইরে যোগগুরু ধীরেন্দ্রের আগ্রহ ছিল বন্দুকেও! জম্মুতে বন্দুক তৈরির একটি কারখানা খুলেছিলেন ধীরেন্দ্র। নাম ‘শিবা গান ফ্যাক্টরি’। অনুমতি বা জমি কোনওটাই পেতে বিশেষ কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। এমনকী, যোগগুরুর বিরুদ্ধে যখন ওই কারখানার জন্য ৫০০ স্প্যানিশ গান ব্যারেল চোরাপথে দেশে আনার অভিযোগ ওঠে, তখন আগাম জামিন পেতেও কোনও অসুবিধা হয়নি তাঁর।
শোনা যায়, এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তাঁর পদ খোয়াতে বসেছিলেন ধীরেন্দ্রর জন্য। যোগগুরু তাঁর আশ্রমের জন্য জমি চাইলে সেই অনুরোধ খারিজ করে দিয়েছিলেন ইন্দিরার মন্ত্রিসভার আবাসন-প্রতিমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরাল। আইন দেখিয়ে গুজরাল যোগগুরুকে বলেছিলেন, তাঁকে জমি দেওয়া হলে তা হবে বেআইনি কাজ। জবাবে যোগগুরু নাকি তাঁকে বলেছিলেন, ‘যদি জমি না দাও, তবে কালই মন্ত্রিত্ব খোয়াতে হবে তোমাকে।’ অদ্ভুতভাবে এই ঘটনার পরই ইন্দিরার মন্ত্রী গুজরালের দায়িত্ব বদলে দেওয়া হয়। এরপর ইন্দিরা-বিরোধীদের অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন, মসনদে ইন্দিরা থাকলেও আসলে কেন্দ্রের ক্ষমতার রাশ জড়ানো আছে যোগগুরু ধীরেন্দ্রর হাতে।
তবে জল্পনা এর বেশি বাড়তে পারেনি। ১৯৮৪ সালে মৃত্যু হয় ইন্দিরার। তার ১০ বছর পর ১৯৯৪ সালে নিজের বিমানে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় মারা যান ধীরেন্দ্রও। বিহারের এই যোগগুরুর আখ্যান তদ্যবধি রহস্য হয়েই থেকে গেছে।
ভারতীয় রাজনীতিতে তিনি এক অনন্য নাম। আজ ভারতীয় রাজনীতিতে নেহরু-পরিবারের যে-প্রভাব ও প্রতিপত্তি, এর মূলে রয়েছে ইন্দিরার অনন্য অবদান। অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্ব সামলেছেন। তাঁর আমলে কিছু যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছে। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৭ সালের মার্চ এবং ১৯৮০ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে নিহত হওয়ার দিন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। বাবা জওহরলাল নেহরুর পরে তিনিই ভারতে দ্বিতীয় দীর্ঘতম মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতের চূড়ান্ত জয় ছিল ইন্দিরা গান্ধীর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কীর্তি। এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দুই সপ্তাহে এবং এই যুদ্ধের পরই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হয়। বলা হয়, সেই সময় বিরোধী দলনেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁকে দেবী দুর্গার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
১৯৮৩ সাল নাগাদ স্বর্ণমন্দির চত্বর জঙ্গিদের কাছে এক দুর্গে পরিণত হয়। জানা গিয়েছিল, মন্দির চত্বরে লাইট মেশিনগান ও সেমি-অটোমেটিক রাইফেলও নিয়ে আসা হয়েছিল। বেশ কয়েকবার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা ব্যর্থ হলে ১৯৮৪ সালের জুন মাসে ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় সেনাবাহিনীকে স্বর্ণমন্দিরে ঢুকে সেখান থেকে ভিন্দ্রানওয়ালে ও তাঁর অনুগামীদের সরিয়ে দেওয়ার আদেশ দেন। এই অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছিল অপারেশন ব্লু স্টার।
কিন্তু এই অপারেশন ব্লু স্টার ঘটানোর জন্য খেসারত দিতে হলো ইন্দিরা গান্ধীকে। সেই বছরই ৩১ অক্টোবর তাঁর দেহরক্ষীরাই তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। যে রাজনীতিকের জীবন এত রঙিন, এত বর্ণময়, এত রসের উপাদান রয়েছে, তাতে যে আলোকসম্পাত হবে, তা বলাই বাহুল্য। ফলে গোপন কথাটি রইল না গোপনে।