মানুষের চামড়া দিয়ে তৈরি রোবট! বিশ্বজুড়ে আলোড়ন নতুন এই আবিষ্কারে

বিজ্ঞানীদের মতে, সামগ্রিকভাবে দেখলে এটি একটি দৃষ্টান্তমূলক গবেষণা, যেখানে সজীব এবং জড় পদার্থ, দুইয়ের সুবিধা পাওয়া যাবে একটি রোবটে।

ইউনিভার্সিটি অফ টোকিও-র (University of Tokyo) বিজ্ঞানীরা এবার মানুষের চামড়ার মতো বস্তু বা স্কিন-ইক্যুইভ্যালেন্ট (Skin-Equivalent) দিয়ে বানালেন রোবটের কিছু অংশ। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে রোবট বানানোর জন্য ব্যবহৃত তথাকথিত যন্ত্রাংশের ওপরে চামড়া বসিয়ে মানুষের মতো দেখতে আঙুল বানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

গঠনগত এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তো বটেই, চোখে দেখলে বা হাত দিয়ে স্পর্শ করলে একেবারেই মনে হবে, যেন সত্যিই মানুষের আঙুল স্পর্শ করা হল। এখানেই শেষ নয়, চামড়ায় আঘাত লাগলে সেই আঘাত সেরেও উঠবে (Wound-healing Property), ঠিক মানুষের চামড়ার মতোই। তবে স্কিন-ইক্যুইভ্যালেন্টটির মানুষের আঙুলের সঙ্গে তফাৎ এখানেই, এখানে মানুষের আঙুলের গাঁটে যেমন সুস্পষ্ট দাগ দেখা যায়, তা দেখা যাবে না।

খুব সম্প্রতি এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে সেল প্রেস ম্যাটার (Cell Press Matter) নামের বৈজ্ঞানিক জার্নালে। এই গবেষণাপত্রেই বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই প্রথম রোবট বানানোর উদ্দেশ্যে একটি জৈব-সংকর পন্থা বা বায়োহাইব্রিড অ্যাপ্রোচ (Bio-hybrid Approach) ব্যবহার করা হল, যেখানে রোবটিকসের (Robotics) প্রযুক্তিতে প্রচলিতভাবে ব্যবহার করা যন্ত্রাংশ বা কৃত্রিম উপাদানের পাশাপাশি সজীব উপাদানও ব্যবহার করা হয়েছে স্কিন-ইক্যুইভ্যালেন্ট পদার্থটি বানাতে।

আরও পড়ুন: চাঁদে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ? যে অসম্ভবকে সম্ভব করছে চিন

আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে মানুষের মতো শরীরের অংশ দিয়ে যে রোবট তৈরি করা হয়, তাকে 'হিউম‍্যানয়েড' বলে। সেক্ষেত্রে, এই গবেষণাতেও গবেষকরা একটি হিউম‍্যানয়েড বানিয়েছেন। হিউম্যানয়েডকে অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা, সেবা-শুশ্রুষায় ব্যবহার করা হয়। এবং এর পাশাপাশি একাধিক পরিষেবা ক্ষেত্রে হিউম‍্যানয়েডের ব্যবহার রয়েছে।

গবেষকদের মতে, রোবট যদি মানুষের মতো দেখতে হয়, তাহলে মানুষের পক্ষে বেশি সহজ হয় রোবটের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা। পাশাপাশি রোবটগুলির গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ে মানুষের কাছে।

যদিও হিউম্যানয়েড বানানোর জন্য চিরাচরিতভাবে সিলিকন রাবার (Silicon Rubber) ব্যবহার করা হয় এবং তার ফলে মানুষের মতোই দেখতে হয় রোবটগুলি, কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষের চামড়ার মতো বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না। দেখা বা স্পর্শে যেমন তারা মানুষের চামড়ার মতো হয় না, মানুষের চামড়ার মতো ক্ষত সারিয়ে ওঠার ক্ষমতাও এদের থাকে না।

কীভাবে একদম মানুষের মতো দেখতে সজীব চামড়া বানালেন গবেষকরা, এবার আসা যাক সেই প্রসঙ্গে। মানুষের চামড়ার অন্যতম উপাদান ফাইব্রোব্লাস্ট (Fibroblast), কোলাজেন (Collagen), কেরাটিনোসাইট (Keratinocyte) প্রভৃতি। গবেষণাগারের কৃত্রিম পরিবেশে সেই ফাইব্রোব্লাস্ট, কোলাজেন, কেরাটিনোসাইটের মতো উপাদান ব্যবহার করেই, টিস‍্যু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে বানানো হলো সেই চামড়া।

কোলাজেনকে ব্যবহার করা হয়েছে এক্সট্রা-সেলুলার মেট্রিক্স (Extra-cellular Matrix) হিসেবে। এক্ষেত্রে ফাইব্রোব্লাস্ট ও কেরাটিনোসাইট কোশকে আবদ্ধ থাকতে সাহায্য করবে কোলাজেন। মানুষের শরীরে অবস্থিত এই এক্সট্রা-সেলুলার মেট্রিক্স ত্বক বা যে কোনও কলায় (Tissue) অবস্থিত অগুনতি কোশকে একসঙ্গে আবদ্ধ রাখে। এটি না থাকলে কোশগুলি হয়তো বিচ্ছিন্ন অবস্থাতেই থেকে যেত। সংঘবদ্ধ হয়ে কলা বা টিস‍্যু গঠন করা, এবং সেই টিস্যু থেকে অঙ্গ (Organ) তৈরি হওয়া আর হতো না; তৈরি হতো না একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ দেহ, সেখানে নানা জৈবিক কাজকর্ম সম্পন্ন হয় প্রতি মুহূর্তে।

সেসব মাথায় রেখেই, ফাইব্রোব্লাস্ট, কোলাজেন, কেরাটিনোসাইট প্রভৃতি ব্যবহার করে কাঁচের মত দেখতে একটি পাত্র বা পেট্রিডিশে (Petri-dish) রোবটের আঙুলে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ রেখে, তার চারপাশে গড়ে তোলা হল সেই চামড়ার মতো বস্তু বা স্কিন-ইক্যুইভ্যালেন্ট ।

চামড়া তো তৈরি হলো, কিন্তু আঘাত লাগলে সেই চামড়া সেরে উঠবে কীভাবে? সেই সমস্যার সমাধান করতে ব্যবহার করা হলো কোলাজেনের পাতলা আবরণ (Collagen Sheet)। এর আগে একাধিক গবেষণায় কোলাজেনের এই পাতলা আবরণ ব্যবহার করা হয়েছে মানুষের শরীরের পোড়া অংশে নতুন চামড়া গজানোর জন্য। সেই পুরনো গবেষণাগুলি থেকেই কোলাজেনের আবরণ ব্যবহার করার কথা বিজ্ঞানীদের মাথায় আসে।

পুরনো গবেষণায় এটাও দেখা গেছে, মানুষের চামড়ার সংস্পর্শে এলে কোলাজেন নতুন কোশ তৈরি হতে সাহায্য করে। পুরনো চামড়ায় একাধিক জৈব-রাসায়নিক বস্তু তৈরি হয়, যা আবার নতুন কোলাজেন, কেরাটিনোসাইট তৈরি করতে পুরনো কোশকে প্রণোদিত করে।

মানুষের চামড়ায় উপরিতল কুঞ্চিত ও অসম থাকে স্বাভাবিক অবস্থায়। হিউম‍্যানয়েড বানানোর জন্যে এরকম স্বাভাবিক দেখতে ত্রি-মাত্রিক (3-Diamentional) চামড়া বানানো এ-যাবৎ বেশ চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল গবেষকদের কাছে। কারণ এতদিন চামড়ার সদৃশ যে-সমস্ত পদার্থ তৈরি করা হয়েছে, সেগুলি দ্বি-মাত্রিক (2-Dimentional) ছিল। চামড়ার মতো এই দ্বি-মাত্রিক পদার্থগুলির সমস্যা হলো, ল্যাবরেটরিতে এদের তৈরি করার সময়ই এরা সংকুচিত হয়ে যেত। যার ফলে হঠাৎ করেই চামড়ার গঠন বদলে যেত। এবং রোবটের যন্ত্রাংশের গায়ে বসানোর সময়ে অসামঞ্জস্য দেখা যেত। শুধু তাই নয়, রোবটের হাতের অ্যাঙ্করে বসানোর সময়েও এগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত হাত থেকে।

কিন্তু সেল প্রেস ম্যাটার জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রে ইউনিভার্সটি অফ টোকিও-র বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, “মানুষের চামড়ার মতো বৈশিষ্ট্যযুক্ত যে সজীব পদার্থটি আমরা তৈরি করেছি, তা দিয়ে রোবটের আঙুলের পুরোটাই সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ঢেকে ফেলতে পেরেছি আমরা।" মানুষের আঙুলের মতো, রোবটের আঙুলেও তিনটি গাঁট বা জয়েন্ট আছে।

বিজ্ঞানীরা আরও জানাচ্ছেন, "রোবটের আঙুলকে আবৃত করে রাখা, মানুষের এই চামড়ার মতো গঠনবিশিষ্ট পদার্থরও যে ক্ষত সারিয়ে তোলা যায়, আমরা এই গবেষণায় তা প্রমাণ করতে পেরেছি।"

বিজ্ঞানীদের মতে, সামগ্রিকভাবে দেখলে এটি একটি দৃষ্টান্তমূলক গবেষণা, যেখানে সজীব এবং জড় পদার্থ, দুইয়ের সুবিধা পাওয়া যাবে একটি রোবটে। আশা করা হচ্ছে, এতে মানুষের কাছে হিউম‍্যানয়েডের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে।

 

More Articles