যে কোনও মুহূর্তে ইজরায়েলে হামলা! কেন নতুন করে যুদ্ধ চাইছে ইরান?

Iran-Israel Conflict: আজ-কালের মধ্যেইইজরায়েলে হামলা চালাতে পারে ইরান। তেমন সতর্কতা এসেছে আমেরিকার বিদেশমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের কাছ থেকেই।

ক্রমশ খারাপ হচ্ছে পরিস্থতি। গাজায় যুদ্ধ চলছেই। এরই মধ্যে লেবাননের জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল্লাহের সঙ্গে নতুন করে সংঘাত বেড়েছে ইজরায়েলের। এই হিজবুল্লাহকে সব দিক থেকে সাহায্য করে ইরান। শুধু হিজবুল্লাহই নয়, প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন হামাসও ইরানের মদতপুষ্ট বলে অভিযোগ। কিছুদিন আগেই হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহকে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে। এই হানিয়াহের পিছনে দীর্ঘদিন ধরে পড়েছিল ইজরায়েল। ইরানের প্যারামিলিটারি রেভলিউশনারি গার্ডের তরফেই ঘোষণা করা হয় হানিয়াহের মৃত্যু খবর। তার পর থেকেই ইজরায়েলকে প্রত্যাঘাত ফিরিয়ে দেওয়ার কথা সরাসরি ঘোষণা করেছে ইরান। আর আজ-কালের মধ্যেই সেই হামলা চালাতে পারে ইরান। তেমন সতর্কতা এসেছে আমেরিকার বিদেশমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের কাছ থেকেই। সংবাদমাধ্যম ‘অ্যাক্সিওস’ এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, জি৭ গোষ্ঠীর সমস্ত সদস্যকে এই হামলার বিষয়ে সতর্ক থাকার কথা বলা হয়েছে আমেরিকার তরফে।

গাজায় যুদ্ধের তীব্রতা বিন্দুমাত্র কমায়নি ইজরায়েল। গোটা শহরটাকে কার্যত মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে ইজরায়েল সরকার। চল্লিশ হাজারে পৌঁছে গিয়েছে সেখানকার মৃতের সংখ্যা। এরই মধ্যে নয়া যুদ্ধের আশঙ্কায় কাঁপছে বিশ্ব। সম্প্রতি ইজরায়েলে নতুন করে হামলা চালিয়েছিল লেবাননের জঙ্গিগোষ্ঠী। সেই হামলার প্রত্যাঘাত ফিরিয়ে দেবে বলে গর্জে উঠেছিল ইজরায়েল। লেবাননের জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল্লা, প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী হামাস ও ইয়েমেনের জঙ্গিগোষ্ঠী হাউথি, এরা সকলেই ইরানের মদতপুষ্ট বলে শোনা যায়। গত কয়েক দিনে লাগাতার ইজরায়েলের উপর হামলার ঝাঁঝ বাড়িয়েছে হিজবুল্লারা। কার্যত হানিয়াহকে খুনের পর থেকেই ইজরায়েলের উপর হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে সব পক্ষই। শনিবারও ইজরায়েলে মুহূর্মুহু আছড়ে পড়েছে হিজবুল্লাহের রকেট। আর তাতে ইজরায়েলে বেশ কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করা হয় হিজবুল্লাহের তরফে। এদিকে, ইজরায়েলের তরফে দাবি, তাদের অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ডোম সিস্টেম হিজবুল্লাহের ছোড়া অধিকাংশ রকেটকেই আকাশেই ধ্বংস করেছে। হিজবুল্লাহের তরফে জানানো হয়েছে, তাদের ছোড়া রকেটে ইজরায়েলের মোশাভ বেইট হিলেলে এলাকায় বেশ কয়েক জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। লেবাননের কাফার কেলা ও দেইর সিরিয়ানে ইজরায়েলের হামলার বদলা হিসেবেই লাগাতার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। একই সঙ্গে বেরুটে ইজরায়েলি হামলায় মৃত্যু হয়েছে ফুয়াদ শুকরের নামে এক সিনিয়র হিজবুল্লা নেতার। সেই সমস্ত হামলার প্রতিশোধ নিতেই ইজরায়েলের উপর চড়াও হচ্ছে ইরানপুষ্ট একের পর এক জঙ্গি দল।

আরও পড়ুন: আরও এক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা! হিজবুল্লাহের সঙ্গে সংঘাত কোথায় নিয়ে যাবে ইজরায়েলকে?

হামাসের সঙ্গে ইজরায়েলের লড়াইয়ে বরাবরই হামাসের পাশে থেকেছে হাউথি বা হিজবুল্লাহের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি। এই হিজবুল্লাহ গোষ্ঠি তৈরি হয়েছিল আশির দশকে ইরানেক সমর্থন নিয়েই। এমনকী পশ্চিম এশিয়ায় ইরানের প্রথম উল্লেখযোগ্য ‘ছদ্ম প্রতিনিধি’ ছিল এই হিজবুল্লা গোষ্ঠীই। কূটনৈতিক মহলে চর্চা, এদের অর্থবল ও অস্ত্রবল উভয়ই জোগান দেয় ইরানের সামরিক বাহিনী। শুধু হিজ়বুল্লা নয়, গাজ়া, সিরিয়া, ইয়েমেন-সহ একাধিক দেশে এমন বেশ কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে, যারা বকলমে ইরানের হয়েই কাজ চালাচ্ছে। ফলে ইরান যদি সত্যি সত্যি ইজ়রায়েলের উপর হামলা চালায়, সে ক্ষেত্রে পশ্চিম এশিয়ায় ইরানের বন্ধু রয়েছে অনেক। গাজায় যখন ভয়ঙ্কর রূপে হামলা চালাচ্ছে ইজরায়েল, তখন তাদের মনোঃসংযোগ নষ্ট করতে একের পর এক ইজরায়েলে হামলা চালিয়ে গিয়েছে হিজবুল্লাহ বা হাউথিরা। তবে বর্তমানে বদলেছে পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি। হানিয়েহর মৃত্যুর পর সেই সঙ্কট আরও বেড়েছে। আর সেই সংঘাত ক্রমশ বাড়তে চলেছে বলেই দুশ্চিন্তা ওয়াকিবহাল মহলের। যদিও হানিয়াহ-র খুনের প্রতিশোধ বলে নিজেদের এই সাম্প্রতিক হামলাকে বর্ণনা করেনি হিজবুল্লাহরা। বরং লেবাননের দুই গ্রামে ইজরায়েলের রকেট বর্ষণ এবং হিজবুল্লাহ সামরিক বাহিনীর সিনিয়র কম্যান্ডারকে হত্যার বদলা হিসেবেই ইজরায়েলে পর পর হামলা চালাচ্ছে হিজবুল্লাহরা। আর এই সংঘাত ক্রমশ ইরানের সঙ্গে ইজরায়েলের সরাসরি যুদ্ধের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মত আমেরিকারও।

যদিও আমেরিকার তরফে বারবার ইরানকে অনুরোধ করা হয়েছে, তারা যেন তেমন কোনও পদক্ষেপ না নেয়। ক'দিন আগেই রহস্যজনক বিমানদুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ইরানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসির। সেই ঘটনায় ইজরায়েলের হাত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করেছে ইরানের একটি অংশ। তার ক'দিন আগেই ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের পথে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ইরানের। তখনকার মতো রুখে দেওয়া গিয়েছিল সেই সংঘাত। তবে তার কয়েক দিন যেতে না যেতেই ফের ইরানের সঙ্গে নয়া সংঘাতের পথ প্রশস্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহের পর ইজরায়েলে বড়সড় হামলার হুমকি দিয়েছে ইরান। এদিকে ছেড়ে কথা বলার অভ্যাস নেই ইজরায়েলেরও। সেখানকার প্রথম সারির সংবাদপত্র ‘টাইমস অফ ইজ়রায়েল’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের উপর পাল্টা হামলা চালাতে পারে ইজ়রায়েল সরকার। সেই নিয়ে ইতিমধ্যেই পরিকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। ইজরায়েলের মাটিতে ইরানের হামলা ঠেকাতেই আগেভাগে ইরান হামলার ছক কষছেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। এমনটা মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। ওই প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়েছে, সম্প্রতি নেতানিয়াহু একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছেন। সেই বৈঠকে ছিলেন ইজ়রায়েলের দুই গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং শিন বেটের প্রধানেরা। এ ছাড়াও দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন সেই বৈঠকে। সেখানেই পাল্টা হামলার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে।

ইজরায়েলের বিপদে-আপদে সবসময় পাশে থেকেছে মিত্র দেশ আমেরিকা। এই সঙ্কটেও সেই পরিস্থিতি কিন্তু বদলালো না। বন্ধু-দেশ ইজরায়েলকে এই পরিস্থিতিতে সমস্ত রকম সহায়তা এগিয়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছে ব্রিটেনও। যদিও অন্দরের খবর বলছে, নেতানিয়াহুর উপর বেশ ক্ষুব্ধ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। দিন দশেক আগে আমেরিকা গিয়ে বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন নেতানিয়াহু। গত ১ অগস্ট বাইডেনের সঙ্গে ফের ফোনে কথা বলেন তিনি। তার পরেই বাইডেনের নাকি ধারণা হয়েছে যে, হামাসের হাতে বন্দি ইজ়রায়েলিদের নিয়ে আমেরিকার কাছে ভুল তথ্য তুলে ধরছেন নেতানিয়াহু। আর তার পিছনে যে ইজরায়েলের রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে বেশ কিছু, তা-ও অস্বীকার করার নয়।

এদিকে ইজরায়েল আমেরিকার অস্ত্রবাজারের বিরাট মাপের ক্রেতা। ফলে সেই জায়গা থেকে যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে এত বছর ধরে, সেই সম্পর্কেও চিড় ধরাতে চায় না আমেরিকা। এর উপর সামনেই আমেরিকায় প্রেসিডেন্সিয়াল ভোট। সেটাও একটা বড় ইস্যু। তবে বাইডেন নেতানিয়াহুর উপর যে রেগেছেন, তার আরও কারণ রয়েছে। আমেরিকা গোড়া থেকেই বিপুল অস্ত্রের পাশাপাশি অনুদান দিয়েও সাহায্য় করে আসছে ইজরায়েল। তবে ঘনিষ্ঠমহলে নাকি তা স্বীকার করছেন না নেতানিয়াহু। কোনও কোনও সূত্র বলছে, এই বিষয়টিকে নিয়ে নাকি দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে বাদানুবাদও হয়েছে। তবে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চায়নি কোনও দেশই। ব্যক্তিগত স্তরে নেতানিয়াহুর সঙ্গে বাইডেনের এই মনোমালিন্য কি প্রভাব ফেলতে পারে এই যুদ্ধের পরিস্থিতিতেও? যুদ্ধের বাজারে মিত্রদেশ আমেরিকাকে হারিয়ে ফেলার মতো পরিস্থিতি কি আসতে পারে ইজরায়েলের সামনে। যদিও এ কথাও মিথ্যে নয়, এই পরিস্থিতিতে ব্রিটেন ও আমেরিকার সঙ্গে লাগাতার যোগাযোগ রেখে চলছে ইজরায়েল। ইতিমধ্যেই আমেরিকা আরও সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আরও পড়ুন:৩ ছেলে, ৪ নাতি-নাতনির পর ইজরায়েলের হাতে খুন হামাস নেতা! কে এই ইসমাইল হানিয়াহ?

সম্প্রতি নেতানিয়াহু সরব হয়েছিলেন আব্রাহাম জোট নিয়ে। আমেরিকার কংগ্রেসে বক্তব্য রাখার সময় পশ্চিম এশিয়ায় স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য ‘আব্রাহাম জোট’-এর প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন তিনি। ইজ়রায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, বাহরিন, মরক্কো ও সুদানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে স্থিতাবস্থা আনতে এই চুক্তি হয়েছিল। চুক্তির মধ্যস্থতায় ছিল আমেরিকা। ইরান ও তার মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হামলার হুমকির মধ্যেই নেতানিয়াহু মরিয়া ইজরায়েলের বর্তমান ও ভবিষ্যতের কুটনৈতিক সঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে জোট তৈরি করতে। ইরানের দিক থেকে হামলা হলে, তার উত্তর দিতে এই জোটের সাহায্য পাবে ইজরায়েল, এই জায়গা থেকেই আব্রাহাম জোট সক্রিয় করতে চান নেতানিয়াহু। যতদূর জানা যাচ্ছে, ইজ়রায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্ট ইতিমধ্যেই আমেরিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ও ব্রিটেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জন হেলির সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

ইরানের সমর্থনে থাকা জঙ্গিগোষ্ঠীর সংখ্যা নেহাৎ কম। এই পরিস্থিতিতে কোনও ভাবে আমেরিকাকে বুঝিয়ে যদি আব্রাহাম জোট তৈরি করতে সফল হয় নেতানিয়াহু সরকার, সেক্ষেত্রে দুটি অক্ষশক্তি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা। আর তেমনটা হলে এই যুদ্ধ যে শুধু দু'দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবে ইজরায়েল-ইরান সংঘাতকে কেন্দ্র করেই উস্কে উঠছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা? কার্যত আতঙ্কের প্রহর গুনছে গোটা দেশ।

 

More Articles