৩ ছেলে, ৪ নাতি-নাতনির পর ইজরায়েলের হাতে খুন হামাস নেতা! কে এই ইসমাইল হানিয়াহ?
Hamas Ismail Haniyeh: গত ১০ এপ্রিল ইজরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হয় হানিয়াহর তিন ছেলেই। হামাস জানিয়েছে, হামলায় হানিয়াহ তিন নাতনি এবং এক নাতিও মারা গিয়েছে।
ইরানের তেহরানে খুন হয়ে গেলেন হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহ। ইরানের প্যারামিলিটারি রেভলিউশনারি গার্ড বুধবার এই বিষয়টি জানালেও কেউই এই হত্যার দায় স্বীকার করেনি। তবে সন্দেহের তির অবধারিতভাবে যায় ইজরায়েলের দিকেই। গতবছর ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামলা চালিয়েছিল হামাস। তারপরে ইজরায়েল নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে যে তারা হানিয়াহ এবং হামাসের অন্যান্য নেতাদের নিকেশ করবেই, যে কোনও মূল্যে। ইজরায়েলের উপর হামাসের ওই হামলাতে ১,২০০ জনের প্রাণ যায় এবং প্রায় ২৫০ জন অপহৃত হয়।
ইরানেই 'প্রতিরোধ অক্ষশক্তি'-র অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে ছিলেন হানিয়াহ। এই অক্ষশক্তিতে প্রধানত গাজার হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হাউথিরা অন্তর্ভুক্ত। মঙ্গলবার ইরানের রাষ্ট্রপতি মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে হামাস, হিজবুল্লাহ এবং সহযোগী গোষ্ঠীর অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগ দিতে তেহরানে গেছিলেন হানিয়াহ। হানিয়েহের হত্যাকাণ্ডের আগে বেইরুটে ইজরায়েলি হামলায় হিজবুল্লাহর উচ্চ পদস্থ সামরিক কমান্ডার ফুয়াদ শুকুরকেও হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
কেন তেহরানেই হত্যা করা হলো হানিয়াহকে? হামাস নেতা হানিয়াহ ইদানীং কাতারে থাকতেন। কাতারের সঙ্গে ইজরায়েলের এক অদ্ভুত বোঝাপড়া আছে। ইজরায়েল কাতারের সীমার থাকা হামাস নেতাদের খুন করেনি। ইরানে হানিয়াহকে হত্যা করে ইরানের 'প্রতিরোধ অক্ষশক্তি’-কে বার্তা দিতে চেয়েছে ইজরায়েল। এই অক্ষশক্তি ইজরায়েল, আমেরিকা এবং এদের মিত্রশক্তিদের জন্য বড় হুমকি।
আরও পড়ুন- লেবাননে ড্রোন হামলার নিহত হামাসের ডেপুটি নেতা! জানেন কে এই সালেহ আল-আরৌরি?
হামাসের পলিটিক্যাল ব্যুরোর চেয়ারপার্সন ছিলেন ইসমাইল হানিয়াহ। কাতারে বসবাসকারী হানিয়াহকে হামাসের প্রধান নেতা হিসাবেই দেখা হয়েছিল। যদিও গাজায় হামাসের উপর তাঁর কতটা কর্তৃত্ব রয়েছে তা মোটেও স্পষ্ট নয়। হানিয়াহ ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে হামাসের র্যাডিক্যাল অপারেশনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং ইজরায়েল আগেও বেশ কয়েকবার গ্রেফতার করেছিল তাঁকে। গাজার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কর্মী ছিলেন হানিয়াহ। ১৯৮৭ সালে প্রথম ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা শুরু হলে তিনি হামাসে যোগ দেন। তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং অল্প সময়ের জন্য নির্বাসিতও করা হয়।
১৯৯২ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ইজরায়েল অন্যান্য হামাস নেতাদের সঙ্গে হানিয়াহকেও দক্ষিণ লেবাননের এক মানব-বর্জিত দ্বীপে নির্বাসিত করে। এক বছর পর তিনি গাজায় ফিরে আসেন। ১৯৯৭ সালে আন্দোলনের আধ্যাত্মিক নেতা শেখ ইয়াসিনের কার্যালয়ের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন হানিয়াহ। তারপর থেকেই হামাসের মধ্যে তাঁর দ্রুত উত্থান ঘটতে থাকে।
২০০৬ সালে যখন প্যালেস্তাইন ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজায় সংসদীয় নির্বাচন করে তখন হানিয়াহ ছিলেন হামাসের সংসদীয় নেতা। ইসলামপন্থী গোষ্ঠী হামাস নির্বাচনে জেতে এবং হানিয়াহ প্যালেস্তাইনের প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের দল ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হতে থাকে। আব্বাস ২০০৭ সালে হামাস সরকার ভেঙে দেন। হানিয়াহ এই জবরদস্তি মেনে নেননি এবং গাজাতে থেকেই শাসন চালিয়ে যান। আর ফাতাহ শাসন করতে থাকে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক।
২০১৭ সালে গাজায় হামাসের নেতা হিসাবে পদত্যাগ করেন হানিয়াহ। ওই একই বছরে, খালেদ মেশালের পরবর্তী হিসেবে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন হানিয়াহ। এই সময়ে হামাসের নেতা হিসেবে উত্থান ঘটতে থাকে ইয়াহিয়া সিনওয়ার।
গাজাতে ইজরায়েলের হামলায় এ পর্যন্ত ৩৫,০০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রথম সারির মুখ হয়ে ওঠেন হানিয়াহ। গত ১০ এপ্রিল ইজরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হয় হানিয়াহর তিন ছেলেই। হানিয়াহের তিন ছেলে, হাজেম, আমির এবং মহম্মদ যে গাড়িটিতে ছিল তাতে আঘাত হানে ইজরায়েল। হামাস জানিয়েছে, হামলায় হানিয়াহ তিন নাতনি এবং এক নাতিও মারা গিয়েছে।
তবে গাজায় ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীর বাকি নেতারা যেমন কট্টরপন্থী, সেই তুলনায় অনেকতাই মধ্যপন্থী ছিলেন হানিয়াহ। জনসমক্ষে কঠোরভাষী হানিয়াহ গাজার রাজনীতিতে তুলনামূলকভাবে বাস্তববাদী ছিলেন। হানিয়াহ এবং তাঁর পূর্বসূরি হামাস নেতা খালেদ মেশাল ইজরায়েলের সঙ্গে কাতারের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়ে আলোচনায় ঠিক করেন বন্দি বিনিময়ের বিষয়টি। ইজরায়েলি কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনিদের মুক্তির পাশাপাশি গাজার জন্য আরও বেশি ত্রাণ সাহায্যের আলোচনার মূলেও ছিলেন হানিয়াহ।
তবে হানিয়াহ ৭ অক্টোবরের হামলার বিষয়ে আগে থেকে কতটা জানতেন তা স্পষ্ট নয়। গাজায় হামাসের সামরিক বিভাগ এই হামলার পরিকল্পনা করে এবং সেই পরিকল্পনাটি এতটাই গোপনীয় ছিল যে হামাসের কিছু নেতাও এর সময় এবং হিংসার মাত্রা দেখে অবাক হয়ে যান। তবে হামাসের শক্তি বৃদ্ধিতে হানিয়াহর বড় হাত ছিল। ২০১৭ সালে যখন হানিয়াহ গাজা ছেড়ে চলে যান, তখন হানিয়াহর জায়গা নেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ইয়াহিয়া একজন কট্টরপন্থী, ইজরায়েলের জেলে বছর ২০ বন্দি ছিলেন তিনি। ২০১১ সালে বন্দি বিনিময়ের পরে গাজায় ফিরে আসেন ইয়াহিয়া।
আরও পড়ুন- আরও এক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা! হিজবুল্লাহের সঙ্গে সংঘাত কোথায় নিয়ে যাবে ইজরায়েলকে?
হানিয়াহ এবং মেশাল মিশরের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। যুদ্ধবিরতি আলোচনায় মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছিল মিশর। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেইনির সঙ্গে দেখা করতে নভেম্বরের শুরুতে হানিয়েহ তেহরানে যান। খোমেইনি সেই বৈঠকে হামাস নেতা হানিয়াহকে বলেছিলেন, ইরান এ সম্পর্কে আগে থেকে না জানিয়ে যুদ্ধে প্রবেশ করবে না।
'প্রতিরোধ অক্ষশক্তি' বছরের পর বছর ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ১৯৯০-এর দশকের শেষ এবং ২০০০-এর শুরুর দিকে কাসেম সুলেইমানির নেতৃত্বে এই শক্তির উল্লেখযোগ্য প্রসার ঘটে। লেবাননের হিজবুল্লাহর কাছে ১৫০,০০০ রকেটের অস্ত্রাগার রয়েছে, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী বজায় রয়েছে। এই অক্ষ সমন্বিত আক্রমণ চালালে মার্কিন দেশ সহ ইজরায়েলের সমুহ বিপদ। ইরান এই গোষ্ঠীগুলোকে অর্থ দেয়, প্রশিক্ষণ দেয় এবং অস্ত্র সরবরাহ করে।
হানিয়াহের মৃত্যু 'প্রতিরোধ অক্ষশক্তি'-র হিসেব গুলিয়ে দিতে পারে। স্বায়ত্তশাসিত গোষ্ঠীগুলির সমন্বয়ে তৈরি এই অক্ষশক্তি এখনও সামরিক প্রশিক্ষণ, অর্থ এবং কৌশলগত দিকনির্দেশনার জন্য ইরানের সমর্থনের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। এখন ইরান কীভাবে এই ঘটনায় অবস্থান নেয়, হামাসের নেতৃত্বে কতখানি ক্ষতি হচ্ছে তাই ঠিক করবে ইজরায়েল-হামাস-ইরানের সমীকরণ।