১৬ বছরেই ভেঙেছেন রেকর্ড! কিলিয়ান এমবাপেই তবে আগামীর মেসি?

Kylian Mbappé France: ২০১৮-এর মার্চে বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বের ম্যাচে খেলেন এমবাপে। বিপক্ষের নেদারল্যান্ডসকে প্রথম অভিষেক ম্যাচেই নাস্তানাবুদ করেন এমবাপে।

বালির দেশে ফুটবল উৎসব। আর এই উৎসবকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে একাধিক কথকতা। প্রত্যেক মুহূর্তেই উঠে আসছে নতুন কিছু। অন্যন্য, অভিনবত্ব ঘিরে রেখেছে বিশ্বকাপের আসর। এর সঙ্গেই মুখ বাড়িয়েছে বিতর্ক। নিয়মের বেড়াজাল থেকে আচরণ নিয়ন্ত্রণ, কাতারের সংকীর্ণতায় প্রশ্ন উঠেছে বারবার। তবুও ব্যতিক্রমী হয়েছে ২০২২ এর ফুটবল বিশ্বকাপ (Qatar Football World Cup)। যে আয়োজনে উঠে এসেছেন একাধিক রত্ন। যাঁরা নিজস্ব আঙ্গিক আর প্রতিভার বশে নজর কেড়েছেন বিশ্বের। এর মধ্যেই মাথাচাড়া দিয়েছে ফ্রান্স। বিশ্বজয়ী এই ফুটবল দলের সদস্যদের খেলা মুগ্ধ করেছে বিশ্বকে। আর সেই মুগ্ধতার রেশের প্রথম সারিতে বারবার উঠে আসছেন কিলিয়ান এমবাপে (Kylian Mbappe France)। যাঁর পায়ের জাদু আলোচনায় ঝড় তুলেছে প্রত্যেক মুহূর্তে। কিন্তু কে এই ফুটবলার? মাত্র ২৩ বছরেই কেন এত আলোর তলায় তিনি? কেন বিতর্কের কেন্দ্রেও উঠে আসে এমবাপের নাম!

শুরুর দিনে এমবাপে

১৯৯৮ সালের ২০ ডিসেম্বর। প্যারিসের অ্যারডিসিমেন্ট পুর এলাকার বন্ডি অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন এমবাপে। বাবা উইলফ্রেড আদতে ছিলেন ক্যামেরুনের বাসিন্দা। মা ফাইজা লামারি ছিলেন আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত। এমবাপের পরিবারের সকল সদস্যই ছিলেন খেলার সঙ্গে জড়িত। এক ভাই ইথান ফুটবল খেলার সঙ্গেই রয়েছেন, বর্তমানে পিএসজি-র (PSG) সঙ্গে যুক্ত। আর এক দত্তক ভাই কেম্বো ইকোকোও খেলার সঙ্গেই যুক্ত। এমবাপের মা ছিলেন হ্যান্ডবল খেলোয়াড়। বাবাও যুক্ত ফুটবলের সঙ্গেই। তাই জ্ঞান হতেই এমবাপের ঝোঁক গিয়ে পৌঁছয় খেলার দিকেই।

ক্লাব-ফুটবলে প্রবেশ

জন্মের শহরের ক্লাব 'এএস বন্ডি' দিয়েই খুব কম বয়সে তাঁর খেলার শুরু। বাবাকে কোচ হিসেবে পাওয়া সেখানে। বাবার প্রশিক্ষণে ক্রমশ পায়ের কেরামতি বাড়াতে থাকেন এই ফুটবলার। এরপর অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ওই শিশুর ডাক পড়ে 'ক্লেইরফন্টটেইন আকাডেমি'-তে। সেখান থেকে মাত্র ১১ বছর বয়সেই এমবাপের প্রশিক্ষণে আগ্রহ প্রকাশ করে রিয়াল মাদ্রিদ। তারপর লন্ডন। মাত্র ১৪ বছরেই চেলসি। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ১৬ বছর বয়সেই পাকাপাকি জায়গা করে নেন মোনাকো ক্লাবে।

আরও পড়ুন- সংকীর্ণ কাতারে মর্যাদা পাবে ভালোবাসা? এমবাপে-জিরোডের ঘনিষ্ঠ ছবি তুলে দিচ্ছে যে প্রশ্ন

২০১৫ থেকে ২০১৬। এই একবছর চুটিয়ে ফুটবল খেলেন এমবাপে। থিয়েরি হেনরির রেকর্ড ভাঙেন ১৬ বছরেই। এর পরের বছর থেকে এমবাপে প্রবেশ করেন লিগ খেলার জন্য। রেনেস, মেটজের মতো একাধিক দলের সঙ্গে খেলতে থাকেন তিনি। ক্রমশ নাম ছড়িয়ে পড়ে তাঁর। এদিকে জাতীয় দলেও ডাক পান এই ফুটবলার। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের একাধিক ম্যাচে চুটিয়ে খেলতে শুরু করেন এমবাপে।

'প্যারিস সেন্ট জার্মেইনে' প্রবেশ

২০১৭-২০১৮। বিশ্বের অন্যতম ফুটবল ক্লাব পিএসজিতে পা দেন এমবাপে। ততদিনে বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, করিম বেঞ্জেমাদের সঙ্গে তখন টক্কর দিচ্ছেন এমবাপে। প্রত্যেক মুহূর্তেই জায়গা পাকা করছেন নিজের। ঠিক এই অবস্থাতেই মেটজ-র বিপক্ষে বিপুল জয়ের নায়ক থেকে শুরু করে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচে 'লে প্যারিসিয়া'র বিরুদ্ধে জয়ের কারিগর হিসেবে বারবার উঠে আসে তাঁর নাম।

২০১৮-এর জুলাইয়ে পিএসজি-র ৭ নম্বর জার্সি জোটে এমবাপের। এই বছরেই লিগ একের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন তিনি।

২০১৯-এর ১৯ জানুয়ারির একটি ম্যাচে গোলের হ্যাট্রিক করেও রেকর্ড গড়েন এই ফুটবলার। ২০২০ পর্যন্ত ক্লাব ফুটবল এবং লিগের ক্ষেত্রেই সেরা খেলোয়াড়, সর্বোচ্চ গোলের মালিক হিসেবেই রেকর্ড করতে থাকেন তিনি।

২০২১ সাল নাগাদ আবার সেরা খেলোয়াড়ের তকমা জোটে এই ফুটবলারের। ফের পিএসজির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন।

জাতীয় দলে এমবাপে-রাজ

২০১৬ সাল থেকে ফ্রান্সের জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে পাকাপাকি খেলতে শুরু করেন এমবাপে। একদিকে ক্লাব ফুটবল, অন্যদিকে দেশের হয়ে খেলা। দুই দিকেই নজির স্থাপন করতে থাকেন এমবাপ্পে। যদিও এর আগেই ২০১৬ নাগাদ উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ফ্রান্সের হয়ে খেলেন। পর্তুগালের বিরুদ্ধে জয় পান সেমিফাইনালে। ২০১৭ সালে তিনি ডাক পান প্রধান দলের হয়ে খেলার। কিন্তু অবশেষে ২০১৮-এর মার্চে বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বের ম্যাচে খেলেন এমবাপে। বিপক্ষের নেদারল্যান্ডসকে প্রথম অভিষেক ম্যাচেই নাস্তানাবুদ করেন এমবাপে। ওই সময়েই রাশিয়ার বিরুদ্ধে বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচেও ভালো খেলেন এই ফুটবলার।

২০১৪ সালে অনূর্ধ্ব ১৭, ২০১৬ সালে অনূর্ধ্ব ১৯ ফ্রান্স দলের হয়ে খেলেছেন একাধিক ম্যাচ। ২০১৭ থেকে জাতীয় দলের হয়ে প্রায় ৬৩ ম্যাচে ৩৩ গোলের মালিক হিসেবে খোদাই হয়েছে এমবাপের নাম। অন্যদিকে ২০১৮ থেকে পিএসজি ক্লাবের হয়ে ১২৯ ম্যাচে প্রায় ১১৮ গোল করে ফেলেছেন এমবাপে। তার আগের বছর ২৭ ম্যাচে ১৩ গোল করেন এই ফুটবলার। ২০২১-এর উয়েফা ন্যাশনাল লিগ, উয়েফা ইউরোপিয়ান অনূর্ধ্ব ১৯ চ্যাম্পিয়শিপেও জয়ী হয় তাঁর দল। একের পর এক রেকর্ড গড়েন এমবাপে।

বিশ্বকাপে এমবাপে জাদু

২০১৮, ১৭ মে। বিশ্বকাপের অভিষেক ম্যাচেই পেরুর বিরুদ্ধে জয়সূচক গোল করেন এমবাপে। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই ফ্রান্সের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়, যিনি বিশ্বকাপে গোল করেছেন, এই রেকর্ড অর্জন করেন এমবাপে। ৩০ জুন, আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে বিপুল জয়ের নায়ক হয়ে ওঠেন এই কীর্তিমান। হন ম্যাচের সেরা। ১৫ জুলাই, বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচেও জাদু ছড়ান এমবাপে, গড়েন রেকর্ড। হয়ে ওঠেন পেলের পরে কোনও কনিষ্ঠ ফুটবলার, যিনি বিশ্বকাপ ফাইনালেও গোল করেছেন। শুভেচ্ছা পান ব্রাজিলের তারকা ফুটবলার পেলের তরফেও।

২০২২ এর কাতার বিশ্বকাপেও তার অন্যথা হয়নি। একের পর এক ম্যাচে দেখিয়ে দিচ্ছেন তাঁর ক্যারিশ্মা, হয়ে উঠছেন সেরার সেরা।

২০২০ সাল জুড়ে 'ইউরো কাপে' দাপিয়ে বেড়ান এই ফুটবলার। ফ্রান্সের তারকার খ্যাতি ছড়িয়ে যায় ২০২১-এর একাধিক টুর্নামেন্টেও। ২০২২-এর বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন ম্যাচেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এমবাপে।

বিজ্ঞাপনে এমবাপে

২০১৭ সালেই মাত্র ১৯ বছর বয়সে 'নাইকি'র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন তারকা এমবাপে। খেলার পোশাক থেকে নিজস্ব জুতো, সব ক্ষেত্রেই ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। ২০১৮ নাগাদ সুইজারল্যান্ডের ঘড়ির কোম্পানি 'হাবলটে'র সঙ্গেই বিজ্ঞাপনের কাজ শুরু করেন তিনি। ফিফার ভিডিও গেম সিরিজের একাধিক পর্বের বাণিজ্যিক ভিডিওয় বারবার দেখা গিয়েছে তাঁকে।

আরও পড়ুন- ফুটবলের ছন্দ নষ্ট করছে অফসাইড! প্রযুক্তির জাঁতাকলে কতটা ক্ষতি হচ্ছে খেলার

প্রেমিক এমবাপে

মাত্র ১৮ বছর বয়স থেকেই এমবাপে জড়িয়েছেন একাধিক সম্পর্কে। মহিলা থেকে পুরুষ- প্রেমের পড়েছেন একাধিকবার। প্রশ্ন উঠেছে তাঁর যৌন ইচ্ছা নিয়েও। সমকামী হিসেবেও নাম উঠে এসেছে এমবাপের।

২০১৮-তে এমবাপের সঙ্গে নাম জড়ায় রূপান্তরিত মডেল ইনেস রাউরের সঙ্গে। শোনা যায়, এই রূপান্তরের পিছনেও নাকি হাত ছিল এমবাপ্পের। যদিও এ নিয়ে মুখ খোলেননি ফুটবলার। শুধু মডেল ইনেস নন, এমবাপের নাম জড়ায় ফ্রান্সের পরিচিত এক অভিনেত্রীর সঙ্গে। শোনা যায়, এমা স্মেতের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে তাঁর। এমবাপে কি সমকামী? তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে কয়েকবছর আগে। সতীর্থ ফুটবলার আশরাফ হাকিমির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে তাঁর, এ নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়। এমবাপে কিছু না বললেও আশরাফ জানান, শুধুই বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়িয়েছেন তাঁরা।

এদিকে ক্রিশ্চিয়ানো থেকে শুরু করে ফ্রান্সের জিরোড, একাধিক সতীর্থ ফুটবলারের সঙ্গে সম্পর্কের গুঞ্জনও ছড়ায় এমবাপের।

ক্লাব ফুটবল থেকে জাতীয় স্তর, বারবার দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁর প্রতিভা। মাত্র ২৩ বছরের এমবাপে-বিচ্ছুরণ কাঁপিয়ে দিয়েছে প্রতিপক্ষকে। আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে শুরু ঘরোয়া টুর্নামেন্ট, প্রতিপক্ষকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়েননি এই ফুটবলার। নিজস্ব লড়াই আর প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রকে প্রাধান্য দিয়েই এগিয়ে গিয়েছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন অনবদ্য, অনন্য মৌলিক এবং ফুটবল বিশ্বের আলোচনার অন্যতম উপজীব্য।

More Articles