ফুটবলের ছন্দ নষ্ট করছে অফসাইড! প্রযুক্তির জাঁতাকলে কতটা ক্ষতি হচ্ছে খেলার
World Cup 2022: ভার তাই আলোচিত, চর্চিত, বিস্ময়কর, আবার বিতর্কিতও বটে।
বিশ্বকাপের প্রথম গোলখানাই বাতিল। গোল বলা ভুল, বরং যা গোল হয়েও হইল না শেষ, সৌজন্যে ফুটবল দুনিয়ার নতুন মসিহা ভার, সেই মনখারাপি গোল নিয়ে কত হইচই! বাতিল হলো, কারণ গোলের মুভমেন্টে ইনভলভ থাকা এক খেলোয়াড় নাকি অফসাইডে থেকে মুভমেন্টে অংশ নিয়েছেন। বোঝো কাণ্ড! ছেলেবেলা একটু গোবেচারা মানুষের সান্ত্বনার মন্ত্র ছিল- ‘আগে গেলে বাঘে খায়’; আর এখন আগে গেলেই রেফারির বাঁশি! পিইইইপ! অফসাইড!
অফসাইড নিয়ে হইচই তো নতুন না। কত গোল হলো, কতই বা হলো না; সমীক্ষা চালানো না হলেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ফিফা অফসাইড রুলের কাগুজে নিয়মের সঙ্গে রেফারির চোখ সবসময় কি আর সমান্তরাল হয়? ফলে, নিয়ম ও বেনিয়মের মাঝে হিউম্যান এররের সূক্ষ্ম ভুলচুক নিয়েই বেশ চলছিল এতকাল। বাধ সাধল বিজ্ঞান। ঘ্যাচাং ফু! দাও সব অনিশ্চয়তার ঘাস ছেঁটে। ভিডিও আসিস্ট্যান্ট রেফারি একেবারে দাগ কেটে, কৈশোরের জ্যামিতি বাক্সের মতো লোভনীয় একখানা রহস্যময়ী ডিজিটাল স্ক্রিনে দেখে বলে দিচ্ছেন, বা বলা যায় একপ্রকার রায় ঘোষণা করছেন। তবু, ভার-এর ভার নিয়মিত ফুটবল দর্শক বয়ে চলছিল, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ থেকে লা-লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সর্বত্রই এই টেকনোলজি প্রবর্তিত হয়ে আছে কয়েক বছর ধরে; কিন্তু কাতার বিশ্বকাপে আরও শক্তিমান হয়ে এল সে। ভার এবার একা নয়, অফসাইড কি অফসাইড না, তা বিচার করবে রোবট। ফিফা নাম দিল সেমিঅটোমেটেড অফসাইড টেকনোলজি, বারোটি ক্যামেরা মাঠের বিভিন্ন কোণ থেকে ক্রমাগত তদারকি করবে প্রতিটি গোলমুখী মুভকে, যখনই সামান্য অফসাইডে থাকবে কোনও খেলোয়াড়, সঙ্গে সঙ্গে ভিএআর রুমে থাকা ভিডিও ম্যাচ অফিশিয়ালদের কাছে যাবে সিগন্যাল। ব্যবহার করা হবে থ্রিডি অ্যানিমেশন টেকনোলজি, যা দিয়ে মাঠের মধ্যে আঁকা কাল্পনিক অফসাইড লাইনের পাশে প্লেয়ারের মুভমেন্ট পরিস্কারভাবে বোঝানো থাকবে। এতে খেলোয়ারের শরীরের সামান্য অংশও যদি অফসাইড লাইন ক্রস করে,মুহূর্তে ধরা পড়ে যাবে।
শুধু কি গোলস্কোরার? না! বরং যে আক্রমণ থেকে গোল হলো তার সঙ্গে যুক্ত সব খেলোয়াড়রাই থাকবেন আতসকাচের তলায়। ফিফার বিভিন পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পরই বিশ্বকাপে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন কর্তারা।
তবে যন্ত্রের যন্ত্রণা যে পোহাতে হবে, তা বোঝা গিয়েছিল আগেই। 'বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ'-এর মতো কৈশোরের রচনা ফিরে ফিরে আসছে বিশ্বকাপে। এদিকে ফিফা কিন্তু গ্রুপ স্টেজে ভার-এর পারফরম্যান্সকে দরাজ সার্টিফিকেট দিচ্ছে। যদিও বিশ্বের কোনও নিয়ামক সংস্থাই কোটি টাকা খরচ করে গড়া টেকনোলজিকে খারাপ সার্টিফিকেট দেবে না। এতে তাদের দূরদর্শিতা প্রশ্নের মুখে পড়বে। ফিফা-র অফিশিয়াল রেফারিং কমিটির স্টেটমেন্ট অনুযায়ী, প্রতিটি অফসাইড ডিসিশনই ১০০ শতাংশ নির্ভুল হচ্ছে। অথচ জনমানসের ভার নিয়ে অস্বস্তি কিন্তু গোড়া থেকেই। প্রথমত্ একজন খেলোয়াড় যখন সামনের দিকে দৌড়চ্ছেন তখন ফিজিক্সের জাড্যের সূত্র মেনে তার শরীর সামনের দিকে ঝুঁকে থাকবে। এ-প্রসঙ্গে সবচেয়ে জোরালো উদাহরণ স্পেন-জার্মানি ম্য্যাচে অ্যান্টনি রুডিগারের বাতিল হওয়া গোলটি।
ভার বলছে, বলের রিলিজ মোমেন্টে রুডিগারের কাঁধের সামান্য অংশ অফসাইড লাইন পেরিয়ে গিয়েছিল। এখন, ব্যকরণগতভাবে একথা নির্ভুল, কিন্তু বাস্তবে যাঁরা সামান্য ময়দানে দৌড়োদৌড়ি করেছেন, তাঁরা জানেন যে, স্প্রিন্ট নেওয়ার সময় রানারের শরীর সামনে ঝুঁকে থাকাই দস্তুর, একইভাবে বাতিল হয়েছিল আরব-আর্জেন্টিনা ম্যাচে লাউটারো মার্টিনেজের গোলটি। অফসাইড ও অনসাইড নিধারণের ক্ষেত্রে ‘ডেলিবারেট প্লে’-র ধারণা প্রকট হয়ে এসেছে বরাবর। ডেলিবারেট প্লে কী? ডেলিবারেট প্লে-এর অর্থ হলো একজন খেলোয়াড়ের যখন খেলার বা বলের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে, সেই ডেলিবারেট ও নন-ডেলিবারেট প্লে-এর ওপর ভিত্তি করে অফসাইড সিদ্ধান্ত দিচ্ছে ভার- কিন্তু যন্ত্রের পক্ষে এই নির্ধারণ কি আদৌ সম্ভব? যেমন লিওনেল মেসির মুখে পোল্যান্ডের কিপারের হাত লাগার ঘটনাটির কথা ধরা যাক। বল ছাড়ার পর বক্সের ভেতর কাউকে টাচ করলে ফাউল- এবং পেনাল্টি! এই নিয়ম সকলেরই জানা। এমনকী, যন্ত্রও জানে সেকথা। ঠিক যে কারণে বলে হেড করার পর কিপারের হাত মুখে লাগায় ভার পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দিল। অথচ একথা সকলেই জানেন যে, একজন খেলোয়াড় যখন বলের জন্য জাম্প করেন, তখন শরীরের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে থাকে না, পোল্যান্ডের কিপারের জাম্পটি ছিল বল লক্ষ্য করে, বল বেরিয়ে যাওয়ার পর ওই ভাসমান অবস্থায় তাঁর পক্ষে শরীরকে নিচে নামানো সম্ভব না, তাই মেসির মুখে আঘাত কখনও ইনটেনশনাল নয়। ঠিক যেমন টিউনিশিয়া ম্যাচে শেষ মুহূর্তে আঁটোইয়া গ্রিজম্যানের করা গোলটি ডেলিবারেট প্লে-এর অজুহাতে বাতিল করল ভার, অথচ সত্যিই কি বাস্তবে এর ভিন্ন কিছু করা সম্ভব? যন্ত্র অঙ্ক বোঝে, নিয়ম বোঝে, নীতির খসড়া বোঝে কিন্তু মানুষের ভাষা তো সে বোঝে না। বিখ্যাত রেফারি কিথ হ্যাকেট যেমন প্রকাশ্যে স্টেটমেন্ট দিয়ে জানাচ্ছেন, ভার ইজ রুইনিং দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ!
একথা সত্যি, এবং স্বীকৃত যে, গোল-টেকনোলজি কিংবা অফসাইডে ভার ব্যবহারের ফলে বহু ক্ষেত্রেই সুবিধা হচ্ছে অফসাইড বুঝতে, কিন্তু অতিরিক্ত যন্ত্র নির্ভরতা যযে সমস্যা ডেকে আনবে তা ও পরিস্কার হয়ে গেল বিশ্বকাপ শুরুর পর। এক্ষেত্রে উপায় হলো যন্ত্র ও মানুষের মেলবন্ধ। ভার আসিস্ট্যান্টের ভূমিকা তাই আরও গুরুত্ব্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
থেমে থাক! এ যেন এক আচমকা নেমে আসা সাবধানবানী। ভূতের রাজার বরে বলীয়ান গুপি-বাঘার মতোই বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান মানুষ সাবলীল ময়দানে এনে ফেলেছে ভুবনের ভার। ভার তাই আলোচিত, চর্চিত, বিস্ময়কর, আবার বিতর্কিতও বটে, তবে এর স্থায়িত্ব কতদিন, কত বছর বা কত যুগ- তা নির্ধারণ করবে মানুষই, আর তার এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মুনশিয়ানা।