জাতীয় নেত্রীর ভূমিকায় ট্রায়াল, প্রথম বারে কতটা সফল মমতা?

অলৌকিক কিছু ঘটনা না ঘটলে বিরোধী প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা যে ক্ষীণ, তৃণমূল নেত্রী যে তা জানেন না, এমন হতেই পারে না। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, হারা ম্যাচ খেলতে কেন এতখানি সক্রিয় হয়ে উঠলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?

 

 

 

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী শিবির সহমতের ভিত্তিতে প্রার্থী দাঁড় করাতে সফল হলেও ওই নির্বাচনের ফল কী হতে পারে, তা মোটামুটি সকলেরই জানা। ভোটে জিততে যে সামান্য ভোটমূল্যের ঘাটতি বিজেপির রয়েছে, তা সম্ভবত 'ম্যানেজ' করে ফেলেছে এনডিএ তথা বিজেপি। ওড়িশার শাসক দল বিজেডি এবং অন্ধ্রপ্রদেশের শাসক দল ওয়াইএসআর কংগ্রেস এ-ব্যাপারে বিজেপির 'বন্ধু' হতে চলেছে বলেই জানা যাচ্ছে। ফলে এবারও যে বিজেপি-মনোনীত প্রার্থীই রাইসিনা পাহাড়ে চড়বেন, তা মোটামুটি নিশ্চিত।

অলৌকিক কিছু ঘটনা না ঘটলে বিরোধী প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা যে ক্ষীণ, তৃণমূল নেত্রী যে তা জানেন না, এমন হতেই পারে না। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, হারা ম্যাচ খেলতে কেন এতখানি সক্রিয় হয়ে উঠলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? কেন নিজে উদ্যোগ নিয়ে ১৭টি দলকে এক টেবিলে বসিয়ে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে চাইছেন তৃণমূলনেত্রী? আসলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই বা ওই ভোটে জয়ের চেষ্টার থেকেও অনেক বড় কাজ বুধবার দিল্লিতে সেরে ফেলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে এতদিন বিচ্ছিন্নভাবে রাজ্যভিত্তিক আওয়াজ উঠত বিরোধীদের। সেই আওয়াজ ধর্তব্যের মধ্যেই আনত না কেন্দ্র বা বিজেপি। সেইসব কথাই এবার দেশের প্রধান বিরোধী দলগুলির নেতানেত্রীদের উপস্থিতিতে এক সূত্রে গেঁথে দিলেন তৃণমূলনেত্রী। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে এই প্রথম পদ্ধতিগতভাবেই সরব হল বিরোধী শিবির। এবং তা সম্ভব হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকটাই ঝুঁকি নেওয়ার কারণে।

আর ঠিক এখানেই ভয় পাচ্ছে বিজেপি। ক্ষমতায় বসার পর থেকে নরেন্দ্র মোদিকে কখনওই বিরোধীদের সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে পড়তে হয়নি। রাজ্যে রাজ্যে বিরোধিতা হয়েছে বটে, তবে কখনওই তার ছাপ গোটা দেশে পড়েনি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী পক্ষের এই একজোট হওয়া যে ভোট মিটে গেলেই অন্তর্হিত হবে, এমন কোনও লক্ষণও খুঁজে পায়নি পদ্ম-শিবির।

আরও পড়ুন: হোয়াটসঅ্যাপে হম্বিতম্বি বিধানসভায় দিশেহারা, কেন নেতৃত্বহীন বঙ্গ বিজেপি?

২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন 'টিম মোদি-শাহ'-র কাছে নানা কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। '২৪-এর নির্বাচনের সময় মোদির বয়স হবে ৭৪ বছর। বিজেপির সংশোধিত দলীয় অনুশাসন অনুযায়ী বয়সের কারণে মোদির এখনই 'মার্গদর্শক' হওয়ার কথা। কিন্তু বিজেপিতে মোদি-পরবর্তী কোনও মুখ না থাকার কারণে দল তাঁকে বয়সজনিত বাধা থেকে ছাড় দিয়েছে। তবে এটাও ঠিক, আগামী লোকসভা ভোটে বিজেপি জিতুক বা হারুক, এটাই মোদির শেষ নির্বাচন। ২০২৯-এ পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের সময় মোদি ছুঁয়ে ফেলবেন ৮০ বছর। মোদি-মহল জানে, চব্বিশের ভোটের ফল যাই-ই হোক, ঊনত্রিশের ভোটে মোদিকে আর প্রার্থী করা না-ও হতে পারে। ফলে নরেন্দ্র মোদি ধরেই নিয়েছেন ২০২৪-এর ভোটেই তিনি রাজনৈতিক জীবনের শেষ নির্বাচনে লড়বেন। তাই এই ভোটে জিততেই হবে। মোদি জানেন, 'ঘর ঘর মোদি' স্লোগান শুনলেই মানুষ এখন পালিয়ে যাচ্ছেন, মোদি বোঝেন, 'সবকা বিকাশ'-এর প্রকৃত অর্থ যে বাছাই করা কিছু শিল্পপতির বিকশিত হওয়া, দেশবাসী তা ধরে ফেলেছেন এবং নরেন্দ্র মোদি শঙ্কিত, কথার 'জাগলারি'-তে মানুষকে মোহাবিষ্ট করে রাখার চালাকি পাবলিক আর নিচ্ছে না। দেশবাসী ধরে ফেলেছে, থমকে গিয়েছে মোদির রথ, পিন ফুটেছে তাঁর জনপ্রিয়তার বেলুনে। আর এর পাশাপাশি সমান্তরালভাবে দৌড়চ্ছে মোদি-জমানার অভূতপূর্ব এবং নজিরবিহীন কুশাসন। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে যেসব অঘটন ঘটেনি, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এক এক করে সবই ঘটিয়ে ফেলেছেন নরেন্দ্র মোদি। ফলে চব্বিশের ভোটে জিতে ফিরে আসা আদৌ সহজ কাজ নয়। ভরসা একটাই, বিরোধী শিবিরের অনৈক্য। মোদির একমাত্র আশা, দেশজুড়ে বিরোধী পক্ষ যত নিজেদের মধ্যে লাঠালাঠি করবে, ততই তিনি এগিয়ে যাবেন তাঁর সাধের সেন্ট্রাল ভিস্তার দিকে।

এইখানেই মোদির বিপদ ডেকে এনেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবারের বৈঠকে তাঁর বক্তব্য একবারের জন্যও শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতি ভোটকেন্দ্রিক ছিল না। মমতা বার্তা দিয়েছেন সামগ্রিক বিরোধী জোটের, যে জোট ২০২৪-এর নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে মোদির দিকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেসব কথা বলেছেন, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। প্রার্থী বাছাইয়ের গোলটেবিলকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় সরকারকে দফায় দফায় কাঠগড়ায় তুলেছেন তৃণমূল নেত্রী। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন রাজ্যে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যে আওয়াজ উঠেছে, তার একত্রীকরণ করেছেন তিনি‌। কী বলেছেন তৃণমূল নেত্রী?

১) দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করে পরিকল্পিতভাবে অ-বিজেপি রাজ্যগুলির প্রতি মাত্রাছাড়া বঞ্চনা চালিয়ে যাচ্ছে মোদি সরকার‍। বিষয়টি এমন জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে, যেন কেন্দ্র দয়া করে রাজ্যগুলিকে সাহায্য করছে৷ অথচ সংবিধান অনুসারে রাজ্যগুলির পাশে দাঁড়াতে কেন্দ্র বাধ্য। মোদি সরকারের আমলে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক তলানিতে চলে গিয়েছে। আইন বা সংবিধানের তোয়াক্কা করছে না কেন্দ্র। ধারাবাহিকভাবে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত হেনে রাজ্য সরকারের ক্ষমতাকে ছেঁটে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে মোদি সরকার।

২) কেন্দ্রীয় সরকারের খেয়ালখুশিতে এই প্রথমবার দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জম্মু-কাশ্মীরের বিধায়করা অংশ নিতে পারলেন না। ওই রাজ্যের মানুষদের নির্বাচিত সরকার গঠনের সুযোগ না দিয়ে তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে রাখা হয়েছে রাষ্ট্রপতি শাসন। সেখানকার পণ্ডিতদের এক অসহায়, অসহনীয় পরিস্থিতিতে দিন কাটাতে বাধ্য করা হচ্ছে। মোদি সরকারের কাশ্মীর নীতি সমালোচনাযোগ্য‌।

৩) অ-বিজেপি রাজ্যর রাজ্যপালরা নিজেদের সংবিধান-বর্ণিত ভূমিকা অতিক্রম করছেন দিল্লির মদতে। রাজভবনের রাজ্যপালের দপ্তরকে রাজ্যের বিরুদ্ধে চূড়ান্তভাবে অপব্যবহার করা হচ্ছে। আইন বা সাংবিধানিক পথে নয়, বিজেপির রাজ্যনেতাদের পরামর্শে বা নির্দেশে রাজ্যপাল চলছেন। রাজ্য সরকারের কাজের গতি বারবার থমকে দেওয়া হচ্ছে। এসবের পিছনেই রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের উসকানি।

৪) কেন্দ্রীয় সরকার ছক কষে দেশের বিরোধী নেতানেত্রীদের এবং তাঁদের পরিবারের বিরুদ্ধে মাঠে নামিয়েছে একাধিক কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে৷ বিজেপি যেসব রাজ্যে থাবা বসাতে পারছে না সাংগঠনিক দুর্বলতা, অদক্ষতার জন্য, সেইসব রাজ্যে রাজনৈতিক লক্ষ্যে সক্রিয় করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে। কেন্দ্রবিরোধী রাজনীতির কণ্ঠ স্তব্ধ করতে চাইছে‌। মোদি সরকার চাইছে, ‘বিরোধীমুক্ত ভারত’ গঠন করতে।

৫) কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতিতেই নুপুর শর্মার মতো বিজেপির নেতা-নেত্রীরা মাঠে-ময়দানে, সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ধারাবাহিকভাবে ঘৃণার সংলাপ বা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য চালিয়ে যাচ্ছেন৷ শুধুই ভোটরাজনীতির লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকার নীরব৷ আর এর ফলে দেশবাসীর একাংশ চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন৷ শুধুই পশ্চিম এশিয়ার সামনে নয়, আজ গোটা বিশ্বের সামনে ভারতকে মাথা নোয়াতে হচ্ছে। দেশের ভাবমূর্তি ধ্বংস করছে বিজেপি সরকার।

আরও অনেক কথাই বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কোনও কথাই শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ-কেন্দ্রিক নয়৷ দেশের যথার্থ বিরোধী নেত্রীর দায়িত্ববোধ এবং ভূমিকা যেমন হওয়া প্রয়োজন, তাঁর বার্তা যতখানি প্রাসঙ্গিক হওয়া দরকার, ঠিক সেই দায়িত্বই নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন তৃণমূল নেত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখে মুগ্ধ দেশের শীর্ষ বিরোধী নেতা-নেত্রীরা। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের গোলটেবিলে বসে কার্যত ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের ডংকা বাজিয়ে দিয়েছেন তিনি। আগামী নির্বাচনে ঠিক কোন সুরে বিরোধীরা গর্জে উঠলে বিজেপির অন্দরে থরহরিকম্প শুরু হবে, তারই দিকনির্দেশ করেছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী।

আর ঠিক এইখানেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে বিজেপি। ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। তাই নিশ্চিতভাবেই ধরে নেওয়া যায়, বাংলায় এবার কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির দাপাদাপি শতগুণে বৃদ্ধি পাবে, রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রীয় বঞ্চনাও সীমাহীন হবে। তবে একজন সফল জাতীয় নেত্রীকে এসব অস্ত্রে ঘায়েল করা আদৌ সম্ভব হবে কি?

More Articles