হোয়াটসঅ্যাপে হম্বিতম্বি বিধানসভায় দিশেহারা, কেন নেতৃত্বহীন বঙ্গ বিজেপি?

হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে কোনও পরিষদীয় দল চলতে পারে না। এই দিকটাও বিজেপি-র রাজ্য নেতৃত্বকে ভেবে দেখতে হবে৷

ছিল ৭৭, এখন সম্ভবত ৬৯। ভবিষ্যতে কী দাঁড়াবে, তা এখনই বলা মুশকিল৷ তবে বিধানসভায় শাসক দলকে চেপে ধরার জন্য যে কোনও বিরোধী দলের ৬৯ জন বিধায়ক থাকা যথেষ্ট-র থেকেও বেশি৷ অথচ ২০২১-এর পর থেকে তেমন কোনও ছবি নজরে আসছে কোথায়?

১৯৭৭ সালে বাংলায় ক্ষমতায় আসে বামফ্রন্ট৷ সেবার বিরোধী পক্ষে ছিল জনতা পার্টি এবং কংগ্রেস৷ বিধায়ক-সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৯ এবং ২০ জন৷ ১৯৮২-র নির্বাচনে কংগ্রেসের বিধায়ক সংখ্যা হয় ৪৯, ১৯৮৭-তে কংগ্রেস ৪০, ১৯৯১ সালে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের আসন ৩টি বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩, ১৯৯৬-তে কংগ্রেসের আসন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে বিধায়ক সংখ্যা ছিল ৮২ জন৷ ২০০১-এ তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান বিরোধী দল হিসেবে পায় ৬০টি আসন, কংগ্রেসেরও বিধায়ক ছিল ২৬ জন৷ ২০০৬ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের আসন হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৩০, ওদিকে কংগ্রেসের বিধায়ক ছিলেন ২১ জন৷ ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদল ঘটে৷ ক্ষমতায় আসে তৃণমূল৷ সে-বছর বিরোধী বামফ্রন্টের সদস্য সংখ্যা ছিল ৬২, ২০১৬ সালে কংগ্রেস এবং বামেরা বিরোধীদের জোট গড়ে ভোট লড়ে৷ দু'দলের বিধায়কের মোট সংখ্যা ছিল ৭০, পাশাপাশি বিজেপি-র ছিল ৩ বিধায়ক৷ ২০২১-এর নির্বাচনে কংগ্রেস এবং বামেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়৷ মোট ৭৭ আসন লাভ করে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে বিজেপি৷

এই এত কথা বলার কারণ আছে৷ গত ৪৫ বছরে শুধুমাত্র ১৯৯৬ সালেই রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী পক্ষে ছিল সর্বাধিক ৮২ জন বিধায়ক৷ এর পরের স্থানেই বিজেপি৷ ২০২১-এ গেরুয়াবাহিনী বিধানসভায় প্রবেশ করে ৭৭ জন বিধায়ক নিয়ে৷ অথচ সেই '৭৭ সাল থেকেই হাতে গোনা বিধায়ক নিয়ে বিধানসভায় বাম সরকারকে নাজেহাল করে দিয়েছিল তৎকালীন বিরোধী দল কংগ্রেস৷ সেসময় লোকের মুখে মুখে ঘুরত কংগ্রেস বিধায়ক সত্য বাপুলি, রজনী দলুই, সুনীতি চট্টরাজদের নাম৷ পরে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও শামিল হয়েছিলেন সেই বিরোধী-ব্রিগেডে৷ এসইউসিআইয়ের দেবপ্রসাদ সরকার একাই অধিবেশন স্তব্ধ করে দিতেন বাম সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ এনে৷ অথচ সেই সময় বিরোধী বেঞ্চে আজকের মতো এত সদস্য ছিল না৷ কিন্তু তৎকালীন বিরোধী পক্ষের বিধায়করা ওই সংখ্যাতেই দেখিয়েছিলেন, সরকার পক্ষকে কীভাবে কোণঠাসা করতে হয়, বিভিন্ন ইস্যুতে কীভাবে চেপে ধরতে হয়৷ বাম আমলের বাঘা বাঘা মন্ত্রীরা পর্যন্ত সত্য বাপুলি, রজনী দলুইদের দাপটে কার্যত গুটিয়ে থাকতেন৷ ওই সামান্য সংখ্যক বিধায়ক নিয়ে কংগ্রেস যা করতে পেরেছিল, আজ তার প্রায় দ্বিগুণ বিধায়ক থাকা সত্ত্বেও বিজেপি সেসবের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারছে না৷

আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রী জড়িয়ে, তবু বিধানসভার ভোটাভুটিতে কেন নেই তৃণমূলের বেশিরভাগ বিধায়ক? জল্পনা তুঙ্গে

বিধানসভায় বর্তমান বিরোধী বাহিনী কার্যত ব্যর্থই হচ্ছে নিজেদের ভূমিকা বা কর্তব্য পালনে৷ এর কিছু কারণ আছে৷ বর্তমান বিরোধী বিধায়কদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয় এখনও পরিষদীয় রাজনীতি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে পারেননি অথবা খুব খারাপ কথা, বিরোধী বিধায়কদের মেধার অভাব রয়েছে অথবা বিজেপি বিধায়কদের কাজ-ই করতে দেওয়া হচ্ছে না৷ হয়তো বলা হচ্ছে, যেটুকু বলা হবে, তাই-ই করবেন, বাড়তি কিছুই করতে যাবেন না৷ এমন হলে তো বিধায়করা গুটিয়ে থাকবেনই৷ এত বড় বিধায়ক-ব্রিগেডকে কাজেই লাগাতে পারছে না বিজেপি দল এবং পরিষদীয় দল৷ এই ব্যর্থতা কার ?

আসলে যা নজরে আসছে, তা হলো, সরকার বা শাসক দলের সঙ্গে নয়, ঘরের যুদ্ধেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে বঙ্গ- বিজেপি৷ ছায়ার সঙ্গে লড়তে লড়তেই কেটে গিয়েছে ১৫ মাস৷ প্রায় ৭০ জন বিধায়ক-সমৃদ্ধ বিজেপি পরিষদীয় দলকে পাত্তাই দিচ্ছে না তৃণমূল৷ পাত্তা পাওয়ার মতো কোনও দাগ এখনও পর্যন্ত কাটতে না পারায়, এমন ছন্নছাড়া পরিস্থিতিতে পড়াই স্বাভাবিক৷ বাংলার রাজনীতি এবং অবশ্যই পরিষদীয় রাজনীতিতে এই প্রথমবার বিরোধী দলের মর্যাদা পাওয়ার পর প্রতি পদক্ষেপে পদ্ম শিবিরের সামগ্রিক লড়াই হওয়ার কথা ছিল শাসকের বিরুদ্ধে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গিয়েছে সেই লড়াই জারি আছে বিচ্ছিন্নভাবে জনাকয়েক নেতার ব্যক্তিগত ভাবনাচিন্তা-কেন্দ্রিক বিবৃতিতে৷ কেউ সকালে ভ্রমণ করতে করতে কিছু বলেন, কেউ আবার শহরে বা গ্রামে সংবাদমাধ্যম দেখলেই বিপ্লবের কথা বলতে থাকেন৷ আবার কারও কণ্ঠস্বর শোনা যায় শুধুমাত্র কোনও চ্যানেলের তরফে কোনও ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়ার পর৷ প্রত্যেকেই নিজের নিজের কথা বলেন, দলের বক্তব্যের ধারেকাছেও সেসব থাকে না৷ অথচ এঁরা প্রত্যেকেই দলের কোনও না কোনও পদে আছেন৷ পদে থাকলেও দলের সার্বিক কথা এঁদের মুখ থেকে কম শোনা যায়৷ আর ওদিকে বেশ কয়েক ডজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বিধানসভার অন্দরে বা বাইরে কোনও কথা বলার সুযোগই পান না৷ এখনও পর্যন্ত বঙ্গ বিজেপি কোনও কাজেই লাগাতে পারেনি দলীয় বিধায়কদের৷

বিজেপি বিধায়কদের মাঝেমধ্যেই দেখা যায় শুধুই দল বেঁধে রাজভবন যেতে এবং বিধানসভার গেটে ধরনা-বিক্ষোভে সামিল হতে৷ ব্যস, এইটুকুই৷ রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বর কাছে দলের বিধায়করা একেবারেই ব্রাত্য৷

দলের একাধিক বিধায়ক ইদানীং ঘনিষ্ঠ মহলে আরও চাঞ্চল্যকর অভিযোগ আনতেও কুণ্ঠিত হচ্ছেন না৷ তাদের বক্তব্য, দল এখন মোটামুটি দু'টি সমান্তরাল ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে৷ একটি রাজ্য কমিটি, অপরটি পরিষদীয় দল৷ যেন দু'টি আলাদা দল৷ রাজ্যের শীর্ষ নেতারা দলের বিধায়কদের সরাসরি নির্দেশ দিতে দু'বার ভাবেন, যেন অন্য দলের বিধায়কদের কিছু বলছেন৷ এসব কথা নাকি 'প্রপার- চ্যানেল' মারফত আসতে হবে৷ অন্যদিকে বিধায়করাও বিধানসভা-সংক্রান্ত কোনও আলোচনা দলীয় নেতাদের সঙ্গে করতে পারবেন না৷ একের পর এক ইস্যুতে বাংলা উত্তাল হলেও বিধানসভায় তার ছাপ ফেলতেই পারছেন না বিজেপি-বিধায়করা৷ গেরুয়া বিধায়করা পুরোপুরি হতাশ৷ হতাশ বিধায়কদের স্পষ্ট কথা, "বিধানসভায় বিরোধী বিধায়কদের যে ভূমিকা পালন করা দরকার, তা করা যাচ্ছে না৷ এমনিতেই অধিবেশনের দিন কমে গিয়েছে৷ যে ক'দিন হচ্ছে, সেসব দিনেও কথায় কথায় ওয়াক আউট৷ সাধারণ মানুষের কথা, নিজেদের কেন্দ্রের কথাও বলতে সুযোগই মিলছে না৷ এলাকার মানুষের সামনে যেতেও কুণ্ঠিত হয়ে যাচ্ছি৷" বিজেপি বিধায়কদের অধিকাংশেরই বক্তব্য, "এখন বিজেপি-র লড়াই বিজেপি-র বিরুদ্ধেই। বিধানসভায় শক্তি বাড়াতে পারলেও তার সুযোগ নিতে পারছে না দল৷"

এদিকে জল্পনাও চলেছে নানা রকম৷ আপাতত ৭-৮ জন বিধায়ক দল ছাড়লেও বিজেপি-র আরও বেশ কয়েকজন বিধায়ক নাকি অন্য দলের পতাকা হাতে তুলে নিতে তৈরি হয়ে আছেন৷ পদ্ম-নেতৃত্ব যে এসব জানে না, তা নয়৷ একুশের ভোটের আগে দলে দলে যাঁরা গেরুয়া শিবিরে ঢুকেছিলেন, ভোটের পর তাঁদের বড় অংশ বিজেপি থেকে একশো হাত দূরে। এঁদের মধ্যে এক ঝাঁক প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়কও আছেন৷ এঁদের কেউ কেউ ইতিমধ্যেই তৃণমূলে ফেরার সুযোগ পেয়েছেন, আবার কেউ কেউ এখন ওয়েট-লিস্টে আছেন। দলের অনেক বিধায়কই এখন মনে করছেন, দিলীপ ঘোষের পর সুকান্ত মজুমদারকে রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি করার পরই যেন দলের স্বস্তির দিন ক্রমশই কমতে শুরু করেছে। পর পর বিতর্ক মাথাচাড়া দিচ্ছে৷ ঘরের লড়াই প্রকাশ্যে চলে আসছে৷ দলের অন্দরের লড়াই বেআব্রু হয়ে যাওয়ায় নিজেদের কেন্দ্রের ভোটারদের কাছে লজ্জিত হতে হচ্ছে৷ পরিষদীয় নেতা ক্রমশই জাতীয় ও রাজ্যস্তরের রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন৷ বিধানসভায় বিধায়কদের প্রতি নজর দেওয়ার সময় স্বাভাবিকভাবেই কমছে৷ হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে কোনও পরিষদীয় দল চলতে পারে না। এই দিকটাও রাজ্য নেতৃত্বকে ভেবে দেখতে হবে৷

এই মুহূর্তে বিজেপি পরিষদীয় দল যে পরিস্থিতিতে রয়েছে, তাতে পদ্ম শিবিরের আশঙ্কা, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ঢালাও ক্রস-ভোটিং হওয়া বিচিত্র কিছু নয়৷

More Articles