মঙ্গলে পার্সিভেরেন্স রোভারের এক বছর - কী লাভ হল শেষমেশ?

গত এক বছরে মঙ্গলের বুকে হেঁটে ১.৮ মাইলের বেশি হেঁটে  পৃথিবীর বুকে ৫০ গিগাবাইটের বেশি ডেটা পাঠিয়েছে সে; সাথে লাল গ্রহের এক লাখের বেশি ছবি, আবার দুটি নিজস্বীও। মঙ্গলের বুকে এ যাবৎ হেঁটে বেড়ানো সব থেকে দ্রুত যান সে। এরই মধ্যে মঙ্গলের আকাশে প্রথম পাঠানো হেলিকপ্টারের উড়ান সে রেকর্ড করেছে।  ঠিক এক বছর আগে ১৮ই ফেব্রুয়ারি সে প্রথম পা রেখেছিলো মঙ্গলের জেজে়রো খাদে, যা কিনা মঙ্গলের নিরক্ষরেখার একটু দক্ষিণে। সেই পার্সিভেরেন্স রোভারের মঙ্গলের বুকে এক বছর পূর্ণ হল, দেখতে দেখতেই।

মাঝে পৃথিবীর সাথে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিলো সাময়িক, সবার আদরের "পার্সি" তখন ছুটি কাটাচ্ছে মঙ্গলের বুকে। ভালো কাজের শেষে একটু ছুটি তো আমাদের সকলেরই লাগে, পার্সি আর কী দোষ করলো! সে ছুটি কাটাবে না কেন? তার কিছুদিন আগে, অর্থাৎ ৬ই সেপ্টেম্বর তো সে ইতিহাস রচনা করে ফেলেছে মঙ্গলের বুক থেকে সর্বপ্রথম পাথরের নমুনা সংগ্রহ করে। এর আগে  সে কাজ কেউ করেনি।

মঙ্গলের বুকে একটি দিন  অর্থাৎ একটি মার্শিয়ান ডে-তে এ যাবৎ সবচেয়ে বেশী দৈর্ঘ্য অতিক্রম করতে পেরেছে সে-ই। এবং গত একটি বছরে সে মোট ছটি পাথরের নমুনা জোগাড় করতে পেরেছে মঙ্গলের বুক থেকে।

বেশ কিছু পাথরের নমুনা ভেঙেও গেছে সংগ্রহের পর। নাসার জেট প্রোপালশান ল্যাবোরেটরিটি অবস্থিত দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায়। সেই ল্যাবের গবেষকরা প্রথমে এই ঘটনায় মুষড়ে পড়লেও আদতে দেখা যাচ্ছে, আদতে এই ঘটনা গবেষকদের তাদের লক্ষ্যের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে।

কী লক্ষ্য গবেষকদের? হ্যাঁ মঙ্গলের ভৌগোলিক গঠন সম্পর্কে জানা এই পাথরের নমুনা থেকে, লাল গ্রহের পাথর ও মাটির রাসায়নিক গঠন জানা এবং তার থেকে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সেখানে কোনো এক সময়ে আদৌ প্রাণের স্পর্শ ছিলো কি-না। এছাড়াও জানা লাল গ্রহের অতীতের আবহাওয়া, এবং বোঝা বর্তমানের লাল গ্রহ আদৌ মানুষের বাসযোগ্য কিনা!

শুধু কি তাই? মঙ্গলের জমির বর্তমান রাসায়নিক গঠন জানান দিয়ে দেবে লাল গ্রহের বুকে এখনও আণুবীক্ষণিক জীব আছে কি-না। অন্য গ্রহে যা বাস করে, তা-ই এলিয়েন। আদতে আমাদের ফ্যান্টাসি জগতের এলিয়েনের সাথে মিলিয়ে দেবে এই পার্সিভারেন্স রোভারের সংগ্রহ করা এই পাথরের স্যাম্পেলই।

কিন্তু তার সাথে ভেঙে যাওয়া পাথরের কী সম্পর্ক? প্রিজারভেরেন্সের প্রজেক্ট সায়েন্টিস্ট কেন ফার্লির মতে মঙ্গলের এই পাথরে জলের উপস্থিতিই এর ভেঙে যাওয়ার কারণ। আর জলের উপস্থিতি জেনে আনন্দে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছে বিজ্ঞানীদের। কারণ জলের উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় প্রাণ হয়তো কখনও ছিলো লাল গ্রহের বুকে, বা আজও আছে অন্তত মাটির তলায় আণুবীক্ষণিক জীবের রূপে।

আর সেই জন্যেই যেখান থেকে পাওয়া গেছে এই পাথরের স্যাম্পেল, সেই জেজে়রো খাদই হয়ে উঠেছে প্রাণ সন্ধানের আদর্শ ক্ষেত্র। কয়েক মিলিয়ন বছর আগে এই জেজে়রো খাদের উপর দিয়েই বয়ে গেছিলো কলোল্লিনী নদী।

আর কী জানান দিলো পার্সিভারেন্স রোভার লাল গ্রহের সম্পর্কে? পাথর সংগ্রহের পরেই বিজ্ঞানীরা ধন্দে ছিলেন এই পাথর পাললিক শিলা না-কি আগ্নেও শিলা। পাললিক শিলা বা সেডিমেন্টারি রক একের পর এক স্তরের উপর, অন্য একটি স্তর জমা হয়ে তৈরি হয়। আর আগ্নেয় শিলা তৈরি হয় অগ্নুৎপাত থেকে উদগীরিত লাভা যখন সময়ের সাথে সাথে ঠান্ডা হয়ে জমাট বেঁধে কঠিন হয়ে ওঠে, তখন। জেজে়রো খাদ থেকে খানিক এগিয়ে গেলেই একটি নদী আর তার ব-দ্বীপের চিহ্ন। বিজ্ঞানীরা এ যাবৎ ধারণা করেছিলেন লাল গ্রহ তৈরি নদীর স্রোতে বয়ে যাওয়া পলি আর জলে তৈরি পাললিক শিলায়। কিন্তু গত ডিসেম্বরে পার্সিভারেন্স রোভার একটি মারাত্মক কাজ করে ফেলেছে। নতুন সংগ্রহ করা একটি পাথরের নমুনা বিজ্ঞানীদের সেই পুরোনো ধারণাকে ফেলেছে প্রশ্নের মুখে। কারণ সেই নমুনা পাথরে উপস্থিত পাইরক্রিন ক্রিস্টাল বলে দিচ্ছে, সেই পাথর আদতে আগ্নেয়শিলা। আর এই আগ্নেয়শিলা সাহায্য করবে রেডিওঅ্যাক্টিভ ডিকের মাধ্যমে এই পাথরগুলির বয়স নির্ধারণ করতে।

নাসার জেট প্রোপালশান ল্যাবরেটরির সাথে যুক্ত, প্রিসার্ভেরেন্স মিশনের ডেপুটি প্রজেক্ট সায়েন্টিস্ট কেটি স্ট্যাক মর্গ্যানের মতে পার্সিভেরেন্স রোভার আমাদের সেই রকম এক পাথরের নমুনা দিয়েছে যেখানে আগ্নেয়শিলাও জলের সংস্পর্শে এসেছিল, আর সেখান থেকে ধারণা করা যায় সেই জলের সংস্পর্শে আগ্নেয়শিলা থাকা সত্ত্বেও হয়তো প্রাণের উদ্ভব ঘটেছিল। তাছাড়াও পাথরের নমুনাগুলি জানিয়ে দিচ্ছে মঙ্গলের একাধিক জৈব ও অজৈব রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি, যা প্রাণের স্পন্দন ঘটার জন্যে আবশ্যক। কিন্তু এই রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি কখনও জোর গলায় দাবি জানাতে পারে না মঙ্গলে প্রাণ ছিলই, কারণ প্রাণের সৃষ্টি হতে গেলে জৈব ও অজৈব রাসায়নিক পদার্থ ছাড়াও একাধিক অনুকূল পরিস্থির প্রয়োজন হয়।

শোনা যাচ্ছে ২০৩০ নাগাদ মঙ্গলে প্রথম মানুষ পাঠাতে চলেছে নাসা। কিন্তু তার আগে পার্সিভেরেন্সের পাঠানো নমুনা দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে জানা হবে মঙ্গল মানুষের বাসের যথোপযুক্ত জায়গা কি-না। মঙ্গল নাকি আমাদের জানতে সাহায্য করবে জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্বউষ্ণায়ণের কারণে পৃথিবীর ভবিষ্যত কী হতে চলেছে। কারণ মঙ্গলে একসময় বয়ে গেছে একাধিক কল্লোলিনী নদী - বস্তুতই মঙ্গলের পাথরেই তারা লিখে গেছে তাদের উপস্থিতির কথা।  কিন্তু লাল গ্রহ আজ শুষ্ক, নিথর। আর সেখানেই একটা পরস্পরবিরোধী বিষয় কাজ করছে - মঙ্গলের বর্তমান অবস্থা দেখে, আমরা আমাদের নীল গ্রহের অবস্থা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নই, তার সুস্থতার জন্যে আমাদের হেলদোল নেই। আরেকটি আপাত সুস্থ গ্রহকে এক দশকের মধ্যেই দখল করার কথা ভাবছি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা তাকেও কলুষিত করবো।

পার্সিভেরেন্স রোভার নির্দ্বিধায় মঙ্গল সম্পর্কে জানার জন্যে, আমাদের উৎসাহ পূরণের দরজা খুলে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের বাসভূমি সম্পর্কে চেতনা না হলে, আমাদের মঙ্গলের দরজা চিরতরেই বন্ধ থাকবে। যদি কাল মঙ্গলে বসবাসের দরজা উন্মুক্তও হয়, তা গুটিকয় মুষ্টিমেয় লোকের জন্যেই হবে। আপনার আমার বা আমাদের মত সাধারণ মানুষের জন্যে নয়। 

More Articles