দাঁতকে অবহেলা! নিঃশব্দে এগিয়ে আসতে পারে ঘাতক ক্যানসার

ওরাল হাইজিন অর্থাৎ মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য ভালো না হলে পেটের স্বাস্থ্যও বিগড়ে যেতে পারে, এ কথা অনেকেরই অজানা। পেটের মধ্যে ব্যাক্টিরিয়ার মূল প্রবেশ পথ মুখ। আর সেই প্রবেশ পথ থেকেই যে বিভিন্ন ব্যাক্টিরিয়া-জনিত সংক্রমণ আর সেই থেকে পেটের অসুখের কারণ হবে তাই-ই স্বাভাবিক।

গাট মাইক্রোবায়োটা অর্থাৎ পেটের মধ্যে অন্ত্রে উপস্থিত ব্যাক্টিরিয়ার সম্পর্কে আমরা ধীরে ধীরে অনেক কিছু জেনেছি সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক আলোচনার সুবাদে। এই ব্যাক্টিরিয়াগুলির উপস্থিতির জন্যেই শরীরে হজম ক্ষমতা থেকে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ থেকে আমাদের অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ হয়। পেটের মধ্যেকার ব্যাক্টেরিয়ার প্রজাতি, তাদের সংখ্যার উপর নির্ভর করে তাদের সামগ্রিক কাজের ধরণ। তাদের প্রজাতি, সংখ্যা ইত্যাদির যদি হেরফের হয়, আর সেই অবস্থা যদি দীর্ঘায়িত হয়, তার জন্যে শরীরকে খতিয়ান দিতে হয় বিভিন্ন রোগের রূপে।

আর গাট মাইক্রোবায়োটার ধরনধারণ নির্ভর করে জিন থেকে শুরু করে খাদ্যাভাসের উপরে। আর গাট মাইক্রোবায়োটার ধরণ নির্ভর করে আরও একটি বিষয়ের উপর, আর তা হল ওরাল হাইজিন। তার মানে বোঝাই যাচ্ছে, ওরাল হাইজিন মেনে না চললে গাট মাইক্রোবায়োটা কী ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে, আর তার ফলে ভুগতে হতে পারে বিভিন্ন শারিরীক জটিলতায়।

শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, গাট মাইক্রোবায়োটার সার্বিক গঠনে গোলমাল হলে ক্যান্সার বা টিউমারও দেখা দিতে পারে অন্ত্র এবং মলাশয়ে।  এ আর এমনকি কথা! গাট মাইক্রোবায়োটার জন্যে যদি এত অসুখ হতে পারে, ক্যান্সার আর বাদ যায় কেন?

কিন্তু ওরাল হাইজিন - তা-ও যে ক্যান্সারের কারণ হতে পারে, তা নিয়ে আর আলোচনা কতটুকু হয়! মানে আপনি নিয়মিত দাঁত মাজছেন কিনা, আপনি দিনে অন্তত দুইবার দাঁত মাজছেন কিনা, আপনার মুখে কত ঘনঘন দুর্ঘন্ধ হয় বা আপনার দাঁত বা মাড়িতে অসুখ আছে কিনা, তার উপরেও নির্ভর করছে আপনার ক্যান্সারের সম্ভাবনা কতটা। মদ্যপান এবং তামাক সেবনও বড় একটা কারণ, যা আপনার মুখের ভেতরকার স্বাস্থ্য কেমন হবে তা নির্ধারণ করে দেয়।

খারাপ ওরাল হাইজিনের কারণে গাট মাইক্রোবায়োটা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মানে এমন নয় যে কেবল অন্ত্র বা মলাশয়েরই ক্যান্সার হবে, ক্যান্সার হতে পারে শরীরের বিভিন্ন অংশে, এমনকি গলা এবং মাথাতেও। যদিও সেক্ষেত্রে গাট মাইক্রোবায়োটার সম্পর্ক নাও থাকতে পারে, কিন্তু খারাও ওরাল হাইজিনের সম্পর্ক অবশ্যই আছে।

খারাপ ওরাল এবং ডেন্টাল হাইজিনের ফলে পেরিওডেন্টাইটিস দেখা যায়। এই অসুখে দাঁতের মাড়ি আলগা হয়ে আসে, দাঁতের পার্শ্ববর্তী মাড়িতে জ্বালা করে, মাড়ি কুঁকড়ে যায়। এই রোগের জন্যে দায়ী কিন্তু বেশ কিছু ব্যাক্টিরিয়া, যা বেড়ে ওঠে মুখ ও দাঁতের স্বাস্থ্য সঠিক ভাবে না মেনে চললে। এই ব্যাক্টিরিয়াগুলোর মধ্যে অন্যতম অ্যাক্টিনোব্যাসিলাস, পরফাইরোমোনাস, প্রিভোটেলা, এবং ট্যানেরেলার বিভিন্ন প্রজাতি।

একটি দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষণায় দেখা যাচ্ছে পেরিওডন্টাইটিস, কোলোরেক্টাল অ্যাডেনোমা এবং কোলোরেক্টাল ক্যানসারের জন্যে দায়ী। কোলোরেক্টাল অ্যাডেনোমায় কোলোন অর্থাৎ অন্ত্র, এবং রেক্টাম অর্থাৎ মলাশয় অঞ্চলে টিউমার দেখা যায়। যদিও এই টিউমার বিনাইন, অর্থাৎ এরা ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয় না।

তবে ক্যানসারের স্থান কেবল অন্ত্র বা মলাশয়ের আশেপাশেই সীমাবদ্ধ নয় পেরিওডন্টাইটিসের কারণে। এর ফলে খাদ্যনালি উপরিভাগ থেকে শুরু করে, গলা, লিভার, এমনকি মাথাতেও ক্যান্সার হতে পারে।

পেরিওডন্টাইটিসের আশঙ্কা বাদ দিলেও, খারাপ ওরাল হাইজিনের জন্যে ডেন্টাল ক্যাভিটি ক্যানসারের মত সমস্যা দেখা দেয়। আর ঠিক একই কারণেও দেখা যেতে পারে গলা ও মাথার ক্যান্সার।  আর এসবের সূত্রপাত ঘটে খারাপ ওরাল হাইজিনের কারণে যখন মাড়ি আলগা হয়ে যায়, সেখানে গভীর ক্ষত ও রক্তপাত হয়।  

কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের জন্যে দায়ী মুখের মধ্যে বাড়তে থাকা আরও বেশ কিছু ব্যাক্টিরিয়া, যার মধ্যে অন্যতম ফিউজো়ব্যাক্টেরিয়াম, এশ্চেরিচিয়া কোলাই বা ই. কোলাই এবং বিভিন্ন ব্যাক্টেরয়েডস। আমাদের দাঁতের মধ্যে শক্ত হয়ে জমাট বাঁধা প্লেক কিংবা লালারস হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরির আখড়া যেন। এই ব্যাকেটেরিয়া রিয়াটি দায়ী গ্যাস্ট্রাইটিসের পেছনে। তবে শুধু এখানেই শেষ নয়, এরা গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারেরও কারণ।

কিন্তু এই ব্যাকটেরিয়ার কারণে ক্যান্সার হওয়ার কারণ কী? প্রথমত, এদের মধ্যে বেশ কিছু ব্যাকটেরিয়ার ক্ষমতাই আছে টিউমার তৈরির। দ্বিতীয়ত, বেশ কিছু ব্যাক্টিরিয়া বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য (বা সাইটোটক্সিন) তৈরি করে, যেগুলি টিউমার বা ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। তৃতীয় কারণটি হল, ইনফ্ল্যামেশন - যা শরীরে কোনো ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস প্রবেশ করলেই ঘটে। ইনফ্ল্যামেশন আদতে এই ব্যাকটেরিয়াগুলিকে রোধ করার জন্যে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতারই একটা বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এর ফলে শরীরে ক্ষতিও হয় নানান রকম, যার কোপ গিয়ে পড়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইম্যুন সিস্টেমের উপরেও। আমাদের ইম্যুন সিস্টেম কিন্তু ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাভাবিক ভাবেই, ইনফ্ল্যামেশনের ফলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কোপ পড়লে, তার থেকে ক্যানসার হতেই পারে।

তাই ব্যাকটেরিয়া ঘটিত ইনফ্ল্যামেশনের কারণে একাধিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজি়জ় যেমন সাইনোসাইটিস, এন্ডোকার্ডাইটিস, সেপ্টিক অর্থাইটিস, রিউমাটয়েড অর্থাইটিস, ইরিটেবল বাওয়াল সিন্ড্রোম বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়।

আর এত কিছুতে  কার হাত থাকলেও থাকতে পারে? আমাদের খারাপ ওরাল হাইজিন!

More Articles