নতুন ভারতের অন্য নাম এখন বুলডোজার

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের শাসক দল তথা হিন্দু জাতীয়তাবাদী 'ভারতীয় জনতা পার্টি'-র সরকারের কাছে এটি হয়ে উঠেছে 'অস্ত্রস্বরূপ'। সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি, সম্পত্তি এবং জীবিকা ধ্বংস করার কাজে ব্যবহার হচ্ছে বুল...

জোসেফ সিরিল ব্যমফোর্ড, নামটা অনেকের কাছে পরিচিত হলেও, এমনও অনেকেই থাকবেন, যাঁরা ঠিক চিনবেন না এই ব্যক্তিকে। ভারতীয় রাজনীতির দিক থেকে দেখতে গেলে ইনি কিন্তু ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক! এ এঁর তৈরি করা কোম্পানির প্রস্তুত করা একটি বিশেষ জিনিস এই মুহূর্তে ব্যবহার হয় ভারতের রাজনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ 'অপরাধ' দমনকারী অস্ত্র হিসেবে।

চারের দশক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছে। সেই সময় ইংল্যান্ডের ইলেকট্রিক এবং বিমান উৎপাদন মন্ত্রকের সঙ্গে কর্মরত এই ব্যক্তি ভেবেছিলেন, বিশ্বযুদ্ধের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি ব্যবস্থাকে আবার নিজের জায়গায় ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি নিয়ে আসবেন একটি বিশেষ যন্ত্রকে। বিশ্বযুদ্ধের পর যখন বিশ্বের আর্থিক অবস্থা এবং বিশ্বের কৃষিব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়ল, সেই সময় থেকেই তাঁর প্রকৃত অভ্যুত্থান। যুদ্ধের প্রভাব থেকে পুনরুদ্ধার করে ব্রিটেনের কৃষি-দুনিয়াকেই একেবারে পাল্টে দিয়েছিলেন এই ব্যক্তি। শুধু ব্রিটেন না, তাঁর জনপ্রিয় এই যন্ত্রের কারসাজিতে কৃষি-বিপ্লব এসেছিল ইউরোপজুড়েই। কৃষিক্ষেত্র থেকে শিল্পক্ষেত্র- হাইড্রোলিক লোডার যে কী ক্যারিশমা দেখাতে পারে, তার প্রকৃত প্রমাণ দিয়েছিলেন এই জোসেফ সিরিল ব্যমফোর্ড। নিজের নামের আদ্যক্ষরগুলি জুড়ে দিয়েই তৈরি করেছিলেন একটি বিশেষ কোম্পানি, 'জেসিবি', যে কোম্পানিটি তৈরি করত এই হাইড্রোলিক লোডার, বা সহজ ভাষায় বুলডোজ়ার। মাটি কাটা থেকে শুরু করে ঢাউস ঢাউস অবকাঠামো তৈরি, সবই যেন এই জেসিবি-র বুলডোজ়ারের কাছে একেবারে বাঁহাতের খেলা। তবে মোদি জমানায়, এই জেসিবির বুলডোজ়ারই যেন ভারতের কাছে হয়ে উঠেছে এক 'নয়া জুজু'।

সারা বিশ্বেই এমন একটা সময় ছিল, যখন স্বৈরাচার ছিল চরমে। রাজার বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই, আদেশ আসত ধড় থেকে মাথা নামিয়ে দেওয়ার। যিনি অভিযোগকারী, তিনিই করছেন বিচার, তিনি সর্বময় কর্তা। রাজতন্ত্র উঠে গিয়ে সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হলেও, এর মধ্যেও এমন কিছু রাজনীতিক এসে হাজির হলেন, যাঁরা হয়ে উঠলেন স্বৈরতান্ত্রিক। দেশের সবকিছুর ক্ষমতা নিজের হাতে রাখা, দেশের মানুষের বিধাতা হয়ে ওঠা, মারলে উনিই মারবেন, রাখলে উনিই রাখবেন, এই সমস্ত যেন প্রবেশ করে গেল কিছু মানুষের ডিএনএ-তে। স্বৈরতন্ত্রর চেহারাটা বরাবরই ছিল কিছুটা এরকমই।

আরও পড়ুন: নুপুর শর্মা একা নন, যে বিজেপি নেতারা একই কাজ করেছেন অতীতে

অনেকের প্রশ্ন, ধীরে ধীরে কি স্বৈরতন্ত্রের আঁতুড় হয়ে উঠছে ভারত? প্রশাসনের মাথায় বসে থাকা কিছু রাজনৈতিক নেতা আনছেন অভিযোগ, বিচারও করছেন নিজেরাই, আর শাস্তিও দিয়ে দিচ্ছেন তুরন্ত। মিডিয়া প্রচার করছে জিরো টলারেন্স, বড় বড় করে কাগজে ছাপা হচ্ছে, 'সরকারের আসল স্বরূপ', ভক্তরা গলা উঁচিয়ে বলছেন, 'এই হলো শাসনব্যবস্থা!' কিন্তু এই বিরাট শাসনব্যবস্থা, আইনের বই, ধারা, এগুলো কি সত্যিই হারিয়েছে নিজের প্রয়োজন? সরকারের বিরুদ্ধে মন্তব্য করার সাহস ক'জনের আছে? কেউ কেউ, যাঁরা ইতিউতি স্লোগান দিলেন, তাঁদের কণ্ঠ শোনাই গেল না। যাঁরা করতে এলেন সরাসরি বিক্ষোভ, তাঁদের বাড়িতে সোজা চলে গেল জেসিবি-র বুলডোজ়ার! ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হল গোটা বাড়ি। অপরাধ? তেমন কিছুই না, শুধু একটি বিশেষ ধর্মের অবলম্বন!

মুসলমান হলেই বুলডোজারের শিকার? ছবিটি প্রতীকী

Bulldozing Muslim

ভাঙা হচ্ছে জাভেদ আহমেদের বাড়ি

কিছু বছর আগে পর্যন্ত এই বুলডোজ়ার ব্যবহার হতো ভবন, অফিস এবং সড়কের মতো কিছু বিশেষ অবকাঠামো তৈরি করার জন্য। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের শাসক দল তথা হিন্দু জাতীয়তাবাদী 'ভারতীয় জনতা পার্টি'-র সরকারের কাছে এটি হয়ে উঠেছে 'অস্ত্রস্বরূপ'। সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি, সম্পত্তি এবং জীবিকা ধ্বংস করার কাজে ব্যবহার হচ্ছে বুলডোজ়ার। রাজনৈতিকভাবে ভারতের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য উত্তরপ্রদেশেই বর্তমানে এই বুলডোজ়ারের ব্যবহার সর্বাধিক দৃশ্যমান। বুলডোজ়ার যেন হয়ে উঠেছে শাসকের পৌরুষ প্রদর্শনের প্রতীক!

মাসখানেক আগে উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজ শহর কর্তৃপক্ষ সেই এলাকার স্থানীয় একজন রাজনৈতিক কর্মী জাভেদ মহম্মদের বাড়ি বুলডোজ়ার দিয়ে একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। শহর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, বাড়িটি অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল এবং এই কারণেই তা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। জাভেদের পরিবার এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও, কর্তৃপক্ষের নোটিশ অমান্য করেনি ওই বুলডোজ়ার। সমালোচকরা দাবি রাখছেন, এই বুলডোজ়ার দিয়ে জাভেদের বাড়ি ভেঙে দেওয়ার আসল কারণ কিন্তু আলাদা। আইনকানুনের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। আসলে জাভেদ সরকারের একজন কট্টর সমালোচক। এবং সরকারের কঠোর সমালোচনা করার কারণেই তাঁর বাড়ি ভেঙে দিয়ে তাঁকে রীতিমতো 'শায়েস্তা' করা হয়েছে। বাড়ি ভেঙে দেওয়ার একদিন আগে জাভেদকে গ্রেফতার পর্যন্ত করেছিল পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, মহানবী হজরত মহম্মদ-কে নিয়ে বিজেপির দুই নেতার অবমাননাকর মন্তব্যের প্রতিবাদে শহরে সংঘটিত সহিংস বিক্ষোভের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন জাভেদ।

যদিও জাভেদ প্রথম নয়, বিজেপি সরকারের বুলডোজ়ার নীতি এর অনেক আগে থেকেই ভারতে ভালোভাবে ক্রিয়াশীল। এই বুলডোজ়ার বিতর্কের শুরু মূলত উত্তরপ্রদেশেই, ২০১৭ সালে। সেই বছর উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর যোগী আদিত্যনাথ অপরাধজগতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবিশেষকে 'শায়েস্তা' করার জন্য একটি ভিন্ন আইনের প্রস্তাব দিয়ে বসেন। উত্তরপ্রদেশ পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়, বেশি আইনের ওপর জোর না দিয়ে, সোজা 'এনকাউন্টার' করতে। যোগী আদিত্যনাথের সেই বাণী অনুযায়ী, জেলায় জেলায় দাগি অপরাধীদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়। আর যাঁরা যোগীর আদেশ অমান্য করেন, তাঁদের মধ্যে অনেকের মৃত্যু হয় এনকাউন্টারে। যাঁরা ফেরার, তাঁদের চাপ দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় সেই বুলডোজ়ার। বাড়িঘর ভেঙে ফেলে তাঁদের ফিরে আসতে বাধ্য করে যোগীরাজ্যের পুলিশ।

রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার উন্নতির দাবি উঠলেও, যোগীর এই দমননীতি অত্যন্ত সংগত কারণেই হয়ে ওঠে ব্যাপক বিতর্কিত। জানা যায়, সরকার যে-সমস্ত মানুষদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৯০ শতাংশই ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। এই অবস্থায় উত্তরপ্রদেশ জুড়ে মানবাধিকারের প্রশ্ন যেই সবে উঠতে শুরু করেছে, সেই সময় ব্যক্তি বাহুবলীর জায়গা দখল করে বসে উত্তরপ্রদেশ সরকার। আর বুলডোজ়ার হলো তার প্রধান অস্ত্র।

উত্তরপ্রদেশের দেখাদেখি বিজেপিশাসিত আশপাশের বেশ কিছু রাজ্যে চালিত হয় এই অলিখিত বুলডোজ়ার আইন। হরিয়ানা এবং মধ্যপ্রদেশেও শুরু হয় বুলডোজ়ারের দাপাদাপি। রামনবমী এবং হনুমান জয়ন্তী উপলক্ষে বিজেপিশাসিত কর্নাটক, উত্তরাখণ্ড, মধ্যপ্রদেশ এবং গুজরাতের সংঘর্ষেও ব্যবহার হয় বুলডোজ়ার। হলুদ রঙের এই বিশেষ যন্ত্রটি চালিয়ে ভেঙে ফেলা হয় গরিব মুসলিমদের বাড়ি। কর্নাটকের উদুপি অঞ্চলে হিজাব বিতর্কের প্রতিবাদে যোগ দেওয়া মুসলিম পরিবারের রেস্টুরেন্ট ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় এই বুলডোজ়ারের মাধ্যমেই। জাহাঙ্গিরপুরীতে বুলডোজ়ার চালানোর পাশাপাশি বিজেপির স্থানীয় নেতারা টেনে আনেন বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। বলেন, 'বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ঠিক এইভাবেই ঢিট করা হবে।'

'শোলে' সিনেমার ভিলেন ডাকু গব্বর সিং যেরকমভাবে বুলডোজ়ারের হুমকি দিয়েছিলেন, কিংবা অনিল কাপুর অভিনীত 'নায়ক' সিনেমাতে বাড়ি ভাঙার জন্য যেভাবে বুলডোজ়ার ব্যবহার করা হয়েছিল, এখানেও বিজেপির স্থানীয় নেতাদের মনোভাব অনেকটা একইরকম। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বুলডোজ়ার আর নিছক একটি যন্ত্র নয়। সংখ্যালঘু নির্যাতনের একপ্রকার সরকারি ব্যবস্থাপনার রূপক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এই বুলডোজ়ার। তবে ভারতের রাজনীতির ইতিহাস কিন্তু এরকম ছিল না।

ভারতীয় রাজনীতিতে বুলডোজ়ার যেভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠছে, তার পিছনে বিজেপির সুকৌশল রাজনীতি। চলতি বছরের শুরুতে উত্তরপ্রদেশে যখন বিধানসভা নির্বাচন হয়, সেই সময় দ্বিতীয় মেয়াদে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন যোগী আদিত্যনাথ। আর উত্তরপ্রদেশের এই নির্বাচনেই বিজেপির পক্ষ থেকে যোগী আদিত্যনাথের এই ভাবমূর্তিকে তুলে ধরার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল একটি বিশেষ শব্দবন্ধ- 'বুলডোজ়ার বাবা'। এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিল স্থানীয় মিডিয়া। তবে যোগী আদিত্যনাথের এই বিশেষ নামটিকে প্রচারের আলোয় নিয়ে এসেছিলেন সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব। এক নির্বাচনী সমাবেশে আদিত্যনাথকে উপহাস করে 'বুলডোজ়ার বাবা' শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন অখিলেশ। তবে এই শব্দদয়কে কোনওভাবেই আদিত্যনাথের বিপরীতে ব্যবহার করেনি বিজেপি। বরং এক পর্যায়ে নিজেদের রাজনীতির অনুকূলে ব্যবহার করে আদিত্যনাথের শক্তিশালী ভাবমূর্তির প্রচার চালায় তারা।

নির্বাচনী প্রচারকালে একটি রোড শোতে বিজেপির একদল কর্মী-সমর্থক ছোট হলুদ রঙের খেলনা বুলডোজ়ার নিয়ে হাজির হন ওই সমাবেশে। স্লোগান উঠতে থাকে, 'বুলডোজ়ার বাবা' ফির সে আয়েগা, অর্থাৎ 'বুলডোজ়ার বাবা' আবার ক্ষমতায় আসবেন। সংখ্যালঘু উৎপাটনে সরকারি ব্যবস্থাপনার রূপক হিসেবে আত্মপ্রকাশ হওয়া এই বুলডোজ়ার হঠাৎ করেই হয়ে উঠল একজন রাজনৈতিক নেতার 'শৌর্যের প্রতীক'। আর এই 'বুলডোজ়ার'-এর সুফলও পেল বিজেপি। নির্বাচনে জয়লাভ করে উত্তরপ্রদেশের ডবল ইঞ্জিন সরকারের মাথায় বসলেন 'বুলডোজ়ার বাবা'। দলের সমর্থকরা বুলডোজ়ারে চেপে সদর্পে বিজয় উৎসব পালন করলেন। উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভবনের সামনেও সাড়ম্বরে প্রদর্শন করা হলো বুলডোজ়ার। নিশানা ঠিক হতে না হতেই কর্পোরেশন বা মিউনিসিপ্যালিটি থেকে শুরু হলো একের পর এক 'ব্যাকডেট নোটিশ' লটকানোর কাজ।

উত্তরপ্রদেশের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় শুরু হলো বুলডোজ়ারের যথেচ্ছ ব্যবহার। মধ্যপ্রদেশের খারগোন থেকে শুরু করে, উত্তরপ্রদেশে এলাহাবাদ, প্রয়াগরাজ, সর্বত্রই শুরু হলো এই একই পদ্ধতির ব্যবহার। বছরের পর বছর একটি বাড়ির জন্য পুরকর নেওয়া হলেও হঠাৎ করেই সামনে নিয়ে আসা হল 'অবৈধ নির্মাণ' থিওরি। একেবারে ভেঙে ঘুরিয়ে দেওয়া হলো একের পর এক বাড়ি। মাত্র দু'দিনের নোটিশে রাতারাতি বাড়ি ভেঙে দেওয়ার অধিকার কোন আইনবলে পেলেন আদিত্যনাথ? আসলে এটা কোনও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা নয়, শুধুমাত্র হিন্দুত্ববাদী শক্তির অপরিসীম দম্ভ প্রদর্শন। হিন্দুত্ববাদী শক্তির একটা প্রতীক হয়ে এই বিশেষ যন্ত্রটি মুসলিমদের যেন প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, ভারত তাদের মাটি নয়, এখানে তাদের বসবাস এবং তাদের জীবনে যাই-ই হচ্ছে না কেন, তা হচ্ছে সংখ্যাগুরুর অনুগ্রহের কারণেই।

বছরদুয়েক আগে কুখ্যাত অপরাধী বিকাশ দুবে এবং গ্যাংস্টার রাজনীতিবিদ মুখতার আনসারির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যও বুলডোজ়ার ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন যোগী আদিত্যনাথ। বুলডোজ়ার দিয়ে এই দু'জনের সম্পত্তি ভেঙে দেওয়ার ভিডিও জাতীয় টেলিভিশনেও প্রচার করেছিল বিজেপি। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রশংসা পেয়েছিলেন যোগী আদিত্যনাথ। স্পটলাইটে উঠে এসেছিল যোগীর বুলডোজ়ার নীতি। তবে, সময় যত এগোলো, অর্থ পরিবর্তন হতে শুরু করল এই বুলডোজ়ারের। অপরাধ দমনের প্রতীকের পরিবর্তে, বুলডোজ়ার হয়ে উঠল মুসলমানদের ভয় দেখানোর কৌশল। যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতে এ খুব একটা বিস্ময়কর কোনও ব্যাপার নয়। ভারতে বুলডোজ়ার যেমন একদিকে সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা সঞ্চার করতে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই একইভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে দোর্দণ্ডপ্রতাপ পৌরুষোদ্দীপ্ত শাসকের একটি ছবি জনমানসে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্যও। এমন একজন শাসকের ছবি তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যিনি অনায়াসে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যাঁর শাসন সমস্তরকম চ্যালেঞ্জকে প্রতিহত করতে পারে, ঠিক এই বুলডোজ়ারের মতোই। সংবিধানের সমস্ত স্বাধীনতার বিধানকে পদদলিত করা এই বুলডোজ়ার এখন রাষ্ট্রক্ষমতার নতুন রথ! এই রথের চাকায় পিষে প্রতিদিন নিজের ভিটেমাটি হারাচ্ছেন বহু সংখ্যালঘু মানুষ। 'তুমি ঢিল ছুড়লে, আমি তোমার বাড়ি ভেঙে দেব, তোমার পুরো পরিবারকে শাস্তি দেব', যোগী-মোদির বুলডোজ়ার কাজ করছে অনেকটা এভাবেই।

সরকার আত্মপক্ষ সমর্থন করে জোর দিয়ে বলছে, তারা শুধুমাত্র মুসলমানদের টার্গেট করছে না, তারা অবৈধভাবে নির্মিত ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলছে। এটা নাকি এক ধরনের 'মিউনিসিপাল ক্লিন আপ মিশন'। কিন্তু এটা যে কোনও বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়, সেটা সবাই জানেন। মানুষকে এটা বিশ্বাস করানোর জন্য বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে উপহাস হিসেবেই। সন্ত্রাস এবং বিশৃঙ্খলা উসকে দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে এই সমস্ত কথা। কোনওরকম নোটিশ না দিয়েই এবং কোনওরকম আপিল বা শুনানি ছাড়াই ভেঙে দেওয়া হচ্ছে মুসলমানদের বাড়িঘর এবং ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এক ঢিলে মারা হচ্ছে অনেকগুলি পাখি। আগে যখন স্বেচ্ছাসেবক জনতা এই মুসলমানদের কঠোর সাজা দেওয়ার এই কাজটি করেছিল, সেই সময় পুলিশ দাঁড়িয়েছিল ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে। আর এবারে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মিউনিসিপাল কর্তৃপক্ষ এবং গণমাধ্যম-কর্মীরা। জায়গামতো উপস্থিত থেকে অসুর বধের এই দৃশ্যটি সম্প্রচার করছেন বিশেষ কয়েক শ্রেণির গণমাধ্যম-কর্মী। হস্তক্ষেপ করতে পারছে না আদালত পর্যন্ত। মুসলমানদের বলে দেওয়া হচ্ছে, "তুমি একা। তোমাকে সাহায্য করার জন্য কেউ আসবে না। তোমার আপিল করার মতো কোনও আদালত নেই। এই আইন-ব্যবস্থায় এতদিন যে-সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলি শাসনরক্ষার দায়ভার নিত, সেগুলো তোমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা এক একটি অস্ত্র।"

Bulldozing Muslims

মুসলমান হলেই বুলডোজারের শিকার?

তবে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য কিন্তু এই একই নিয়ম কাজ করে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৬ জুন বিজেপি সরকারের নতুন সেনা নিয়োগ নীতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে কয়েকহাজার যুবক যখন উত্তর ভারতজুড়ে হিংসাত্মক তাণ্ডব চালিয়েছিলেন, ট্রেন এবং যানবাহন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, রাস্তা অবরোধ করেছিলেন, বিজেপির দফতর পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, তখনও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তার কারণ ছিল, এদের মধ্যে অধিকাংশই কিন্তু মুসলমান নন। ২০১৪ এবং ২০১৯- এই দু'টি সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি ভালোভাবেই দেখিয়ে দিয়েছে, লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য ভারতের মুসলিম ভোটের কোন প্রয়োজন নেই। ৭৫ শতাংশ হিন্দু ভোটই যথেষ্ট।

সুতরাং বলাই যায়, ভারতে একভাবে ভোটাধিকারহীনতার দিকে এগোচ্ছে মুসলমানরা। বিজেপির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রকাশ্যেই ইসলাম ধর্মের সবকিছুকে অপবিত্র বলে দাবি করলেও বিজেপির জনভিত্তি এত সহজে কমবে না। মুসলমানরা উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ করে কেউ কেউ ধর্মদ্রোহ দমন আইন পাস করার দাবি জানালেও, বিজেপি তাতে সায় দেয়নি, বরং হয়তো মনে মনে এই দাবি শুনে খুশি হয়েছে। কারণ ধর্মদ্রোহ দমন আইন পাশ হয়ে গেলে, হিন্দু জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত প্রায় সমস্ত মন্তব্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। আর অপরাধ বলে প্রমাণিত হবে মুসলমানদের সমস্ত বক্তব্য।

তবে এসবকিছুই যে একেবারে হঠাৎ করে শুরু হয়েছে, তা কিন্তু নয়। আসলে সবটাই পরিকল্পিত। কেন হঠাৎ এই পরিকল্পনার প্রয়োজন পড়েছে? আসলে এই মুহূর্তে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা প্রবল সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, রান্নার গ্যাস কিংবা জ্বালানির দাম যে জায়গায় দাঁড়িয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষের অবস্থা একেবারে নাজেহাল। তাই এরকম সময় কোনও একটা কিছু করে সকলের মন তো ঘোরাতেই হবে। তাই জন্যই এই বিশেষ মুসলিম-বিরোধী ব্যবস্থা। তাতে যে বিজেপি ব্যাপকভাবে সফল, সেটা তো বলতেই হবে। পরিকল্পিতভাবেই রাষ্ট্র এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রশ্রয় সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাদের করে দিয়েছে বেলাগাম। প্রকাশ্যেই দেওয়া হচ্ছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে 'হেট স্পিচ'। কয়েকজন মুসলিম নেতাদের 'হিন্দুদের শিরশ্ছেদ' জাতীয় মন্তব্যকে তুলে এনে, জাতীয় নিউজ মিডিয়াতে কার্যত তাদের ধুয়ে দিচ্ছেন কয়েকজন হিন্দুত্ববাদী নেতা।

প্রকাশ্যে মুসলিম 'গণহত্যার' ডাক দিতেও গলা কাঁপছে না এই সমস্ত গেরুয়াধারীদের। গরু নিয়ে যে কোনও ছুতোনাতায় অনুমোদন পাচ্ছে গ্রেফতারি, মুসলিম এবং দলিত সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যার মতো বিষয়গুলি। রাষ্ট্রদ্রোহ এবং জাতীয় নিরাপত্তা আইনে যত গ্রেফতারি হচ্ছে, তার ৯০ শতাংশ মুসলিম। শাসক চিহ্নিত 'টুকরে টুকরে গ্যাং' এর শরিক তারা। আদালতের বিচার পেতে তাদের সময় লাগছে বছরের পর বছর। অন্যদিকে, রাষ্ট্র এবং শাসক দলের এই তীব্র ধর্মবাদী রাজনীতির চাপে পড়ে, ভারতের রাজনীতিতে শুরু হয়েছে তীব্র মেরুকরণ। অপমানজনক কথা বলার জন্য বিজেপির মুখপাত্রর দলীয় পদ স্থগিত করা হলেও, বিজেপির ক্যাডাররা প্রকাশ্যেই তাঁকে আবাহন করছেন। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ একেবারে উজ্জ্বল। অন্যদিকে এক্সপোজ় করার জন্য জেলের হাওয়া খেতে হচ্ছে একজন ফ্যাক্ট চেকারকে, যিনি আদতে একজন মুসলিম। পত্রপত্রিকায় যেভাবে প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে, তাতে মনে হবে যেন বুলডোজ়ার এক ধরনের ঐশ্বরিক হাতিয়ার এবং ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার একটি পবিত্র মারণাস্ত্র। শত্রুকে চূর্ণ করতে সক্ষম নখরওয়ালা এই ভয়ংকর যন্ত্রকে বর্তমানে ঈশ্বরের একটি নব সংস্করণ হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে। বুলডোজ়ার যেন এখন প্রতিশোধপরায়ণ এক নতুন হিন্দু জাতির মন্ত্রপূত রক্ষাকবচ।

এটাই যেন বর্তমান ভারতের নিউ নর্মাল। এখানে একটাই বার্তা, যদি থাকতে হয়, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে হবে। নাহলে তোমাকে দমন করবে সরকার। মেনে নিতে হবে একটা সত্য, দেশটা চলবে সংখ্যাগরিষ্ঠর ইচ্ছায়। একনায়কতন্ত্র কায়েম হবে গোটা দেশে। কখনও ব্যক্তির হিংস্রতা, আবার কখনও রাষ্ট্রীয় প্রতিহিংসা- অপরাধ দমনের জন্য এই দ্বিমুখী অস্ত্র ব্যবহার হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির জন্য হয়ে উঠেছে খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়।

আজ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় জনসংখ্যা অনুযায়ী ২০ শতাংশ মানুষ মুসলিম হলেও, রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের হার ৫ শতাংশর থেকেও কম। আধা-সামরিক বাহিনীতে কাজ করেন মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ মুসলিম। ভারতের আমলাতন্ত্র, বিদেশ মন্ত্রক এবং পুলিশ সার্ভিসে মুসলিমদের সংখ্যা মাত্র ৩ শতাংশের কাছাকাছি। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে খুব বেশি হলে ১ শতাংশ মুসলিম রয়েছেন। যেখানে আনুপাতিক হারের বিবেচনায় লোকসভায় মোটামুটি ৭৪ জন মুসলিম সদস্যর থাকা উচিত, সেখানে আজ লোকসভার সদস্য মাত্র ২৭ জন মুসলিম। ভারতের এমন ১৫টি রাজ্য আছে, যেখানে একজনও মুসলিম মন্ত্রী পর্যন্ত নেই। দশটি রাজ্য এমন রয়েছে, যেখানে মাত্র একজন করে মুসলিম মন্ত্রী রয়েছেন, আর তাঁদের হাতেও রয়েছে সংখ্যালঘু মন্ত্রক। দেশের কোনও রাজ্যে এই মুহূর্তে মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী নেই। উগ্র হিন্দুত্ববাদের উৎস গুজরাতে মুসলিম জনসংখ্যা ৯ শতাংশ হলেও ১৯৯৮ থেকে আজ অবধি কোনও মুসলিম বিধানসভা কিংবা লোকসভায় প্রার্থী হননি এই রাজ্য থেকে। ২০১৪ ও ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি কোনও মুসলিম প্রার্থীকে টিকিট পর্যন্ত দেয়নি। অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বারবার বলছেন, 'সবকা সাথ সবকা বিকাশ'-এর মতো কথা।

বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা বলছেন, "বিরোধীরা ভোট ব্যাঙ্কের লক্ষ্যে নিম্নমানের রাজনীতি করছে... দেশের আত্মায় আঘাত আনছে... দেশের মানুষ এই ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে।" তবে ভালো করে দেখতে গেলে, ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতি কিন্তু বিজেপিও করছে। কিছু কিছু বিরোধী দল হয়তো মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কের ভোট পাওয়ার আশায় বসে আছে, বিজেপিও কিন্তু বসে রয়েছে হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কের আশায়। বিজেপির মিথ্যাকে প্রচার করার জন্য, প্রতিদিন ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ছোট-বড় অজস্র জাতীয়তাবাদী বিষ। এতদিন বহু নির্বাচনেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, নিরন্তর মিথ্যে কথা বলেও বারবার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব। 'বহুত্বকে আক্রমণ করা' সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে ক্ষমতা ধরে রাখা সম্ভব। এভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে গেলে তৈরি করতে হবে অহেতুক ভীতির আবহ। আর যোগী আদিত্যনাথরা সেই পথে রয়েছেন একেবারে জোরালোভাবে।

আসলে আজকের ভারতে আমরা অন্তর্ঘাতমূলক নীতিকে রাজনীতির মূল নীতি হিসেবে গ্রহণ করে ফেলেছি। এআইএমআইএম-এর মতো প্রো-ইসলামিক রাজনৈতিক দলের নেতারা যেমন প্রকাশ্যেই স্লোগান দিচ্ছেন, "একবার ছাড় দিয়ে দেখুন, কথা দিচ্ছি ভারতের ২০% মুসলিম, ৭৫% হিন্দুকে শায়েস্তা করে দেবে", সেরকমই বিজেপি নেতারাও স্লোগান দিচ্ছেন মুসলিমদের গণহত্যার। যেসব প্রতিষ্ঠান গড়তে আমাদের বছরের পর বছর লেগে গিয়েছে, সেগুলিকে ধ্বংস করা হচ্ছে অবলীলাক্রমে। মগজধোলাই করা এমন একটি নতুন প্রজন্মের জন্ম হচ্ছে, যারা নিজেদের দেশের ইতিহাস বা সাংস্কৃতিক জটিলতা সম্পর্কে কিছুই তেমন জানে না, শুধু জানে পরস্পরকে শত্রু হিসেবে।

অগণিত টিভি চ্যানেল, হিন্দুত্ববাদী ওয়েবসাইট এবং সংবাদপত্রের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে এমন একটি মহীরুহ, যার মাধ্যমে প্রবল ক্ষমতাধর শাসক গোষ্ঠী চালিয়ে যাচ্ছে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের কাজ। বিষ এবং ঘৃণা যে শুধুমাত্র হিন্দুদের দিকে ছড়ানো হচ্ছে, তা কিন্তু নয়, মুসলমান বেশ কিছু নেতাও তাঁদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন উসকানি। ক্রমাগত বাজানো হচ্ছে ঘৃণার ঢোল, যার লাভ গ্রহণ করছে ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী 'ভারতীয় জনতা পার্টি'। তবে রাজনৈতিক নেতাদের থেকেও বর্তমানে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে অতি-ডানপন্থী একটি বিশেষ প্রশাখা। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে যখন নরেন্দ্র মোদির জন্য চালানো হয়েছিল প্রচার অভিযান, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, সেই সময়ে প্রচার চলেছিল দু'টি লাইনে। প্রথমটি, মনমোহন সিং সরকারের খারাপ দিকগুলিকে তুলে ধরে নরেন্দ্র মোদিকে জননেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আর দ্বিতীয়টি হলো, সাম্প্রতিক ইতিহাসে ঘটে যাওয়া কিছু জঙ্গি কার্যকলাপে মুসলিমদের যোগাযোগ তুলে ধরে 'হিন্দু খতরে মে হে' বলে নরেন্দ্র মোদিকে হিন্দুত্বের রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

আদতে এই দ্বিতীয় ক্যাম্পেনটিই এখন হয়ে উঠেছে বিজেপির মূল সমর্থন-ভিত্তি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন প্রকাশ্যেই মুসলমানদের ওপরে গণহত্যা চালানোর খোলামেলা আহ্বান দেওয়া হচ্ছে। অবস্থা এখন এমন জায়গায় যে, আমরা পৌঁছে গিয়েছি একটি 'নো রিটার্ন পয়েন্ট'-এ। এখান থেকে ফিরে আসার আর কোনও রাস্তা নেই। বুলডোজ়ার দিয়ে মুসলমানদের বাড়িঘর ভেঙে দেওয়া, কোনও আদালতের আদেশে নেই। ক্ষমতাসীন গেরুয়া শিবির তাদের রাজনৈতিক অভিলাষ প্রতিষ্ঠা করার তাগিদে কার্যত ভুলেই গিয়েছে, নির্বাচনী গণতন্ত্রে মানুষের কথা মাথায় রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে শাসকের ওপরেই। শাসনক্ষমতায় থাকতে হলে সমালোচনাকে মর্যাদা দিতে হয়। নিজের আত্ম-অহমিকাকে দূরে সরিয়ে রেখে দাঁড়াতে হয় সকলের সঙ্গে। শুনতে হয় অপরের কথা। বিরোধী যুক্তিকে গ্রহণ করতে হয়। সেটাই গণতন্ত্র দাবি করে। তবে সেই দাবি শুনলে অবশ্য বর্তমান শাসকরা ধর্মচ্যুত হবেন। তাই অগত্যা ক্ষমতার জোরেই তাঁরা প্রতিষ্ঠা করবেন ভারতের প্রাচীন গৌরব! বিশ্বগুরুর আদেশমতো আবির্ভাব হবে গেরুয়াবসনধারী এক গণিতের ছাত্রর। তাঁর হিসেবের ওপর ভর করেই চলবে বুলডোজ়ার, পরিষ্কার হবে তাঁর স্বপ্নের অগ্নিপথ, আর সেই অগ্নিপথেই তীব্র বেগে দৌড়বে বিজেপির 'বিজয় রথ'!

 

 

More Articles