প্রচণ্ড গরমে আসছে না ঘুম, বিশ্বজুড়ে দানা বাঁধছে যে মারাত্মক সংকট

চিন্তাশক্তি, কার্যক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেতে থাকে ক্রমাগত, একটানা পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে।

তাপপ্রবাহ এবার ঘুম কাড়ছে আবিশ্ব মানুষের। সম্প্রতি ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের গবেষক নিক ও-ব্র্যাডোভিকের তত্ত্বাবধানে করা একটি গবেষণা 'সেলপ্রেস' নামক বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার দরুন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে দৈনিক ঘুমের সর্বমোট সময়। শুধু তাই নয়, রাতে ঘুম আসতেও সমস্যা হচ্ছে এবং তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যাচ্ছে অনেকেরই। সাম্প্রতিক এই গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্ব উষ্ণায়ন ও তাপপ্রবাহের দরুন সবথেকে বেশি ঘুমের ঘাটতি হচ্ছে বয়স্ক ও মহিলাদের মধ্যে।

 

গ্রীষ্মপ্রধান দেশে যাঁদের বসবাস, তাঁদের মধ্যে ঘুমের ঘাটতি শীতকালীন দেশগুলোর বাসিন্দাদের তুলনায় বেশি। তবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না শীতপ্রধান দেশের বাসিন্দাদের ঘুমও। এদিকে, রাত্রিকালীন তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সারা বছর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলেও, গ্রীষ্মকালে ঘুমের ব্যাঘাত শীতকালের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি হারে ঘটছে বিভিন্ন দেশজুড়ে।

 

গবেষকরা বিশ্বব্যাপী মোট ৬৮টি দেশের সাত মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্কের রিস্ট-ব্যান্ড (এমন রিস্ট-ব্যান্ড, যেগুলো সারাদিনে কোনও ব্যক্তি কতটা ঘুমিয়েছেন, তা সেন্সরের মাধ্যমে নজরে রাখে) থেকে তাদের দৈনিক ঘুমের সময়-সংক্রান্ত তথ্য জোগাড় করেন। তারপর সেই ব্যক্তির বাসস্থানের সঙ্গে মেলানো হয় সেই অঞ্চলের দৈনিক তাপমাত্রা- বিশেষ করে দিন ও রাতের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা, দিন ও রাতের মোট তাপমাত্রার পার্থক্য এবং ঋতু-অনুযায়ী তাপমাত্রার পরিবর্তন। উক্ত গবেষণায় আন্টার্কটিকা বাদে সমস্ত মহাদেশের বাসিন্দাদেরই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

 

আরও পড়ুন: প্রলয় আসছে, দায়ী আপনি, রাষ্ট্রনেতার চোখে চোখ রেখে বলে যান গ্রেটা

 

বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণেই চলতি বছরে ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলজুড়ে চলেছে অসহ্য তাপপ্রবাহ। গরমকালে সারাদিন তাপমাত্রার পারদ ওপরদিকে থাকলেও, রাতে অন্তত তাপমাত্রা সাধারণত কিছুটা আরামদায়ক হয়। কিন্তু এই বছর, রাতের, এমনকী ভোরবেলার তাপমাত্রাও স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে অনেকের রাতের ঘুমের ব্যঘাত ঘটছে, যা হয়তো অনেকেই ইতিমধ্যেই লক্ষ করে থাকবেন।

 

দেখা যাচ্ছে, রাতের তাপমাত্রা তিরিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলেই, দৈনিক ঘুমের সময় অন্তত চোদ্দ মিনিট আট সেকেন্ড হ্রাস পায়। আর রাতের তাপমাত্রা পঁচিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ালেই, ঘুম সাত ঘণ্টার কম হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক এই গবেষণা বলছে, প্রতি এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, অন্যান্য বয়সের মানুষদের তুলনায় বয়স্কদের ঘুম দ্বিগুণ হারে কমছে।

 

রিসার্চ পেপারটির ফার্স্ট অথর কেল্টন মাইনর একটি প্রকাশনায় জানিয়েছেন, আমাদের দেহ তার অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত হয়েছে। তাই প্রতি রাতে দেহের অভ্যন্তর থেকে তাপমাত্রা নির্গত হয়ে দেহের বাইরে পরিবাহিত হয়। তার জন্য হাত ও পায়ের পাতায় রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, আর সেখান থেকেই সবচেয়ে বেশি তাপ নির্গত হয়।

 

তিনি আরও জানাচ্ছেন, দেহের বাইরে তাপ নির্গমনের জন্য, পরিবেশের তাপমাত্রা, দেহের তুলনায় কম হওয়া আবশ্যক। তা না হলে পর্যাপ্তভাবে দেহ ঠান্ডা হয় না, যার প্রভাব গিয়ে পড়ে ঘুমের ওপর। পরিবেশের তাপমাত্রা অত্যধিক বেশি বা অত্যধিক কম হলেই, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। এবং তা যে গবেষণাগারে রাখা প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা করে হাতেনাতে প্রমাণিত হয়েছে, এমনই তিনি জানাচ্ছেন। তবে তাপমাত্রার পরিবর্তন সত্ত্বেও, গরমের তুলনায়, ঠান্ডা পরিবেশে আমাদের শরীর অনেক সহজে ও ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারে।

 

বিশ্ব উষ্ণায়ন ও তাপপ্রবাহের কারণে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের বেশি ঘুমের ব্যঘাত ঘটার কারণ হিসেবে জানানো হচ্ছে, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা সন্ধের দিকে কমতে থাকে। ফলে, দেহের তাপমাত্রা বাইরে নির্গমনের সময়, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের বেশি সমস্যা হয়। পাশাপাশি, মহিলাদের ক্ষেত্রে ত্বকের সাবকিউটিনিয়াস স্তরে পুরুষদের তুলনায় বেশি ফ্যাট উপস্থিত। যার ফলে দেহের তাপমাত্রা বাড়লে, ফ্যাটের উপস্থিতির কারণে তা সহজে ত্যাগ করা যায় না।

 

পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে প্রবলভাবে যে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয়, তা বোধহয় কখনও না কখনও আমরা নিজেদের ক্ষেত্রেই লক্ষ করেছি। ক্লান্তি, স্ট্রেস থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, হজমের সমস্যা, ক্রমহ্রাসমান রোগ প্রতিরোধক্ষমতার মতো সমস্যা দেখা যায় পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে। কেবল শারীরিক ক্ষতি-ই নয়, মানসিক স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হয়। মানসিক অবসাদ, দুশ্চিন্তা, রাগ, আগ্রাসী মনোভাব ইত্যাদি দেখা যায় দিনের পর দিন অপর্যাপ্ত ঘুমের ফলে।

 

শুধু তাই নয়, চিন্তাশক্তি, কার্যক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেতে থাকে ক্রমাগত, একটানা পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে। ফলে অপর্যাপ্ত ঘুম কর্মনাশের কারণ তো বটেই, কাজের গুণগত মান হ্রাস ও তার ফলে দেশের অর্থনৈতিক অবনতির কারণও বটে।

 

বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলি। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে তৈরি শারীরিক ক্ষতির বোঝাও গরীব দেশেরই বেশি। সাম্প্রতিক এই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতেই বিশ্ব উষ্ণায়ন ও তাপপ্রবাহের ফলে সবথেকে বেশি ঘুমের ঘাটতি ঘটছে। ধনী দেশগুলোর তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশের মানুষদের মধ্যে ঘুমের ঘাটতি তিনগুণ বেশি।

 

একজন মানুষের দৈনিক ঘুম গড়ে আট ঘণ্টা হওয়া উচিত, তাঁর বার্ষিক ঘুম হওয়া উচিত তিন হাজার ঘণ্টার কাছাকাছি। কিন্তু এই ভাবে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘুমের সময়ের দৈর্ঘ‍্য হ্রাস পেতে থাকলে, এই শতকের শেষে হয়তো ব্যক্তি-পিছু বার্ষিক ঘুমের সময় পঞ্চাশ থেকে আটান্ন ঘণ্টায় পরিণত হবে।

 

এই গবেষণা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে, পরিবেশ-সংক্রান্ত ভবিষ্যৎ পলিসিগুলো এবার আরও বেশি ভেবেচিন্তে গ্রহণ করতে হবে এবং বাস্তবে কার্যকর করতে হবে, অন্তত সরাসরি স্বাস্থ্যের ওপর পড়া জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কথা ভেবে।

 

More Articles