সৌরঝড় ধেয়ে এলে বিপর্যস্ত হবে দৈনন্দিন জীবন?

১৮৫৯ সালের পয়লা এবং দোসরা সেপ্টেম্বর হঠাৎ করেই সারা বিশ্বে টেলিগ্রাফ পরিষেবা বিছিন্ন হয়। অদ্ভুত ভাবে এই ঘটনা ঘটার পরে টেলিগ্রাফের অপারেটররা হঠাৎ তড়িদাহত শুরু করেন, এদিকে আবার টেলিগ্রাপের পেপারে আগুন লেগে যায়। আরও মজার বিষয়, কিছু কিছু ব্যাটারিচালিত যন্ত্র, ব্যাটারি না থাকা অবস্থাতেই চলতে আরম্ভ করে।

এদিকে দক্ষিণ আমেরিকার কলোম্বিয়ায় সন্ধ্যে হতে আকাশ জুড়ে দেখা যায় রঙিন বর্ণচ্ছটা - সবুজ, গোলাপী রং মেশানো অরোরা বোরিয়ালিস। কিন্তু এই বর্ণচ্ছটা তো কলোম্বিয়ায় দেখা যাওয়ার কথা নয়। সাধারণত অবস্থায় অরোরা বোরিয়ালিস দেখা যায় কানাডার উত্তর ভাগে, এদিকে আলাস্কা, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ডে। অর্থাৎ উত্তর মেরুর কাছাকাছি জায়গাগুলোতে।

এই দুই দিনের একগুচ্ছ  ঘটনাকে নাম দেওয়া হয় ক্যারিংটন ইভেন্ট। ভাগ্যিস সেইদিন ইন্টারনেট পরিষেবা ছিলো না, নইলে আরও কিছু আশ্চর্যের সম্মুখীন হতে হতো ।

কিন্তু  ঠিক দুই দিন আগেই পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়েছিলো সোলার স্টর্ম বা সৌরঝড়। আশঙ্কা করা হয়েছিলো ইন্টারনেট পরিষেবা বিপর্যস্ত হবে। ২০২১ সালের সেপ্টম্বর মাস নাগাদও এরকম বিধ্বংসী সোলার স্টর্ম আছড়ে পড়েছিল। তবে অল্পের জন্যে রক্ষা পেয়েছিল ইন্টারনেট পরিষেবা। তবে কিছু অদ্ভুত ঘটনা আবার ঘটতে শুরু করে। ক্যারিংটন ইভেন্টের মতই মেরু অঞ্চল থেকে সূদুরে থাকা ভূখন্ডের দেশগুলির আকাশেও দেখা গিয়েছিলো অরোরা বোরিয়ালিস।

ক্যারিংটন  ইভেন্টের  জন্যে তাহলে দায়ী কে?

কেন ঘটল ক্যারিংটন ইভেন্ট? তা-ও একদিনে, একসাথেই এত কিছু?

কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল সৌরঝড়ের পাশাপাশি, এর পেছনে হাত আছে জিওম্যাগনেটিক স্টর্ম বা ভূ-চৌম্বকীয় ঝড়ের। জিওম্যাগনেটিসম বা ভূ-চৌম্বকত্ত্ব বলতে বোঝায় পৃথিবী পৃষ্ঠের নিজস্ব চৌম্বকীয় ক্ষমতা, ঠিক যার প্রভাবে কম্বাসের কাঁটা ঘুরে দিকনির্ণয়ে সাহায্য করে।

পৃথিবীর চৌম্বকত্ব দেখা যায় পৃথিবীকে বেষ্টন করে চৌম্বক ক্ষেত্র আছে বলেই। ভূ-চৌম্বকীয় ঝড় তখনই হয় যখন এই চৌম্বক ক্ষেত্র সাময়িক ভাবে বিপর্যস্ত হয়।

কিন্তু কীসের প্রভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র? এখানে দায়ী সেই সৌরঝড়।

সৌরঝড় কী? পৃথিবীর উপর তার প্রভাবই বা কী?

সৌরঝড়ের উৎস সূর্যের বাইরের অংশের অর্ধ-তরল প্লাজ়মার মত অংশ দিয়ে তৈরি, এই অংশটিকে বলে করোনা (নাহ, এই করোনা সেই করোনা নয়। তবে এই গঠনের সাথে মিল দেখেই ভাইরাসটির এই রকম নামকরণ)। সৌরঝড় হলে আলোড়িত হয় করোনা, আর যার কারণে শুরু হয় করোনাল মাস ইজেকশন যার মধ্যে থাকে প্রোটোন এবং ইলেক্ট্রন কণা। এই দুইটি কণা আয়নিত বা চার্জড অবস্থায় থাকে, ফলে এদের শক্তিও প্রচুর। সূর্যের বাইরের অংশে ঘটে চলা এই ঝড়ের আঁচ পড়ে পৃথিবীতেও - আয়নিত প্রোটোন এবং ইলেক্ট্রন আছড়ে পড়ে পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের উপর। আর তখনই ভূ-চৌম্বকীয় ঝড় শুরু হয়।

 

https://svs.gsfc.nasa.gov/vis/a020000/a020000/a020057/what_is_a_cme1.webmhd.webm

কিন্তু সৌরঝড়  আর  ভূ-চৌম্বকীয়  ঝড় মিলে তড়িৎপ্রবাহকে কেন ক্ষতিগ্রস্থ করবে?

জিওম্যাগনেটিক স্টর্ম বা ভূ-চৌম্বকীয় ঝড়ের ফলে ইন্ডিউসড কারেন্ট তৈরি হয়, সেটি প্রবাহিত হতে শুরু করে বৈদ্যুতিক গ্রিডের মধ্যে দিয়ে। আর ভূ-চৌম্বকত্বের জন্যে তৈরি কারেন্টের শক্তি একশো অ্যাম্পিয়ারকেও ছাড়িয়ে যায়। সহজ কথায় বললে একশো অ্যাম্পিয়ার বেশ কিছু বাড়িতে সরবরাহ করা সামগ্রিক  বিদ্যুৎপ্রবাহের সমান।  আর এই কারেন্ট ছড়িয়ে পড়তে থাকে বৈদ্যুতিক গ্রিড,  ট্রান্সফর্মার, রিলে এবং সেন্সরের মধ্যে দিয়ে। এত বৈদ্যুতিক শক্তি, এত দ্রুত বেগে প্রবাহিত হলে বিপর্যস্ত হয় বিদ্যুৎ পরিষেবা।

 

ক্যারিংটন ইভেন্টে টেলিগ্রাফ অপারেটরদের তড়িদাহত হওয়া কিংবা ব্যাটারি-বিহীন অবস্থাতেও ব্যাটারিচালিত যন্ত্রদের হঠাৎ চলতে শুরু হওয়ার কারণ কিন্তু এই ইন্ডিউসড কারেন্ট।

সৌরঝড়  আর  ভূ-চৌম্বকীয়  ঝড় ইন্টারনেট পরিষেবাকে কেন বিপর্যস্ত করবে?

বিদ্যুৎসরবরাহ বিপর্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি, সৌরঝড় আর ভূ-চৌম্বকীয় ঝড়ে  ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইন্টারনেট পরিষেবা। কারণ ইন্টারনেট সরবরাহের জন্যে ব্যবহৃত টাওয়ার, স্যাটেলাইট ইত্যাদি থেকে তৈরি হয় ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ বা তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ। ভূচৌম্বকীয় ঝড়ের কারণে তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, ফলে বিপর্যস্ত হয় ইন্টারনেট পরিষেবা।

এর পাশাপাশি আরও একটি কারণে ব্যহত হতে পারে ইন্টারনেট পরিষেবা। জিওম্যাগনেটিক স্টর্ম শুরু হলে বায়ুমন্ডলের পরিসীমা বৃদ্ধি পায়, ফলে বায়ুমন্ডলের ঘনত্ব বাড়ে। এর ফলে স্যাটেলাইট পরিষেবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ স্যাটেলাইটগুলি থাকে বায়ুমন্ডলের উর্দ্ধস্তরে। এর ফলে ইন্টারনেট পরিষেবা তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ই, সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হয় জিপিএস পরিষেবা।

পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় অরোরা বোরিয়ালিস কেন দেখা গেল?

সাধারণ অবস্থাতে অরোরা বোরিয়ালিস দেখা যায় উত্তর মেরুতে, দক্ষিণ মেরুতে আবার এর নাম অরোরা অস্ট্রালিস। কেন তৈরি হয় এরা? সূর্যের প্লাজ়মা থেকে সবসময়েই কিছু পরিমাণ ইলেক্ট্রন বাতাসের মত করে ধেয়ে আসে পৃথিবীর দিকে। এই ইলেক্ট্রন এসে ধাক্কা খায় পৃথিবীকে বেষ্টন করে থাকা ম্যাগনেটিক ফীল্ড বা চৌম্বকক্ষেত্রতে। পৃথিবীর অন্যান্য অংশে ম্যাগনেটিক ফীল্ড ছুটে আসা এই ইলেক্ট্রনগুলিকে ছিটকে সরিয়ে দিলেও, মেরু অঞ্চলে তা সম্ভব হয় না। কারণ দুই মেরুতেই ম্যাগনেটিক ফীল্ড দূর্বল। এই সুযোগে ছুটে আসা ইলেক্ট্রনগুলি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে উপস্থিত অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেনের সাথে ধাক্কা খেয়ে এই ধরণের আলো তৈরি করে আকাশের বুকে।

কিন্তু সোলার স্টর্ম বা সৌরঝড় শুরু হলে যে পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র বিপর্যস্ত হয় আগেই আলোচনা হয়েছে। তাই স্বাভাবিক ভাবে পৃথিবীর যে অংশে সেই সময় চৌম্বকক্ষেত্র দূর্বল হয়, সেখানেই তৈরি হয় অরোরা বোরিয়ালিস।

More Articles