প্রশান্ত কিশোরের নতুন রাজনৈতিক দলকে বিশ্বাস করে ঠকবেন বিহারবাসীরা?

Prashant Kishor Jan Suraaj Party: প্রশান্ত কিশোরের নতুন বিহারের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে মানুষদের স্মৃতি থেকে কী করে মুছে যাবে গণহত্যার স্মৃতি?

দেশের প্রায় বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের হয়ে রাজনৈতিক কৌশল তৈরির কাজ করার পরে নিজেই একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করেছেন প্রশান্ত কিশোর। জন সুরজ পার্টি। গত বছর যখন পিকে বিহারে একটি জন সুরজ যাত্রা করছিলেন। তখন বেশ কিছু সাংবাদিক তাঁর সাক্ষাৎকার নেন, যা দেখে-শুনে মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় যে এইবার বিহার হয়তো কিছুটা উন্নতি করতে চলেছে। জাতপাতের রাজনীতির পরিবর্তে প্রশান্ত কিশোরের নেতৃত্বে বিহারবাসী শিক্ষার কথা, চাকরির কথা, দারিদ্রের কথাই যে সামনে নিয়ে আসতে চলেছে তা মনে হওয়া অস্বাভাবিক না। এবার বিহারে যে চারটি কেন্দ্রে উপনির্বাচন হলো সেই চারটি কেন্দ্রেই প্রশান্ত কিশোরের নতুন রাজনৈতিক দল জন সুরজ পার্টি প্রার্থী দিয়েছিল। তাঁদের দাবির মধ্যে উঠে এসেছে নতুন বিহার তৈরির কথা। যে আসনগুলিতে তাঁরা প্রার্থী দিয়েছিলেন তার মধ্যে দু’টি আসনে তাঁদের জামানত বাজেয়াপ্ত হলেও বাকি দুটো আসনে প্রাপ্ত ভোট কিন্তু অনেকটাই বেশি।এটাই ছিল তাঁর দলের প্রথম পরীক্ষা। কতটা সফল হয়েছেন প্রশান্ত কিশোর তা সময় বলবে কিন্তু তাঁর দলের প্রাপ্ত ভোট যদি এইরকম থাকে বা আরও একটু বাড়ে তাহলে ২০২৫ সালের বিহার বিধানসভার ভোটে অনেক হিসেব ওলটপালট হয়ে যেতে পারে।

জন সুরজ যাত্রা চলাকালীন পিকের বেশ কিছু ছবি এবং ভিডিও দেখে মনে হয়েছিল, তিনি বিহার এবং বিহারবাসীদের জন্যই এই পদযাত্রা করছেন এবং সেই জন্যই তাঁর রাজনৈতিক দল নতুন আশা দেখাতে পারে। এবারের উপনির্বাচনে বিহারে যা ফল হয়েছে, তাতে চারটি আসনেই বিজেপির এনডিএ জোট জিতেছে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে প্রশান্ত কিশোর বিরোধী ভোটেই ভাগ বসাচ্ছেন। ওয়াকিবহাল মহল জানে, বিহারে আরজেডির তেজস্বী যাদব, কংগ্রেস এবং বামেরা, অর্থাৎ ইন্ডিয়া জোট কর্মসংস্থানের কথা তুলছে, বেকারত্বের
প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসছে বারংবার। সেখানে এনডিএ মুখে জাতপাতের রাজনীতির বিরোধিতা করলেও, বেকারত্ব এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনের কথায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে না। বিভাজনের রাজনীতিতেই তারা অভ্যস্ত। সেখানে প্রশান্ত কিশোর যদি কর্মসংস্থান, বেকারত্ম দূর করার কথা প্রচার করেন তাহলে তাঁর দল কোন ভোট ব্যাঙ্কে ভাগ বসাচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়। শুধু তাই নয়, আগামীদিনে বিহার বিধানসভার ভোটের ফলে যদি দেখা যায় যে নীতীশকুমার এবং বিজেপির জোট আবারও ক্ষমতায় ফিরছে, তাহলে তার ফল ২০২৬ সালে বাংলার নির্বাচনেও পড়তে পারে। বিহারে কাজের অভাব ঘটলে বিহার থেকে বহু মানুষ বাংলায় আসবেন কাজের খোঁজে, যা বাংলার জনবিন্যাসে বদল আনতে পারে।

আরও পড়ুন-নীতীশকে টেক্কা দিতে নতুন দল গড়ে ফেললেন প্রশান্ত কিশোর! কী লক্ষ্য জন সুরজ পার্টির?

একটা সময়ে স্লোগান উঠেছিল, ‘Cast your vote but don’t vote your caste’। তবে বিহারজুড়ে জাতের রাজনীতি আছে আজও। প্রশান্ত কিশোর তাঁর নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের সময় কিছু কথা বলেছিলেন। তিনি বলছেন, এত বছর ধরে বিহারবাসীকে শুধু ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন মেট্রোপলিটন শহরে, তাঁরা সস্তার শ্রমিক হিসেবে কাজ করে এসেছেন। এইবার তাঁর নতুন দল, বিহারী অস্মিতার কথা বলবে এবং বিহারীরা যাতে তাদের হৃত সম্মান ফেরত পান সেই দিকে লক্ষ্য রেখে তাঁর দল কাজ করবে। পাশাপাশি তিনি এও বলেছেন ২০২৪ সালে এসে জাতপাতের রাজনীতি নিয়ে কথা বলাটাই অশোভনীয় এবং জাত জনগণনার কোনও প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ পিকে যে জাতিগত জনগণনার বিরোধী তা তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। সামনের বছরেই বিহার বিধানসভার নির্বাচন। প্রশান্ত কিশোরের এই কথাগুলোর মধ্যে দিয়ে তিনি নতুন কোনও বিভ্রান্তি ছড়াতে চাইছেন না কি তাঁর আরও অন্য কোনও সমীকরণ তাঁর মাথায় আছে তা বোঝা জরুরি।

সম্প্রতি শেষ হওয়া মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ড নির্বাচনের পর ইভিএমে বেশি ভোট পড়া নিয়ে এবং আবার ব্যালটে নির্বাচনের দাবি উঠে আসছে। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ইভিএম সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে একটা পদযাত্রার আয়োজনের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে বলছেন, আগামীতে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের উচিত ইভিএমে ভোট হলে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচন বয়কট করা এবং সেই নিয়ে অন্যান্য বিজেপি বিরোধী দলের সঙ্গে সমন্বয় স্থাপন করে এই সংক্রান্ত আন্দোলন আরও জোরদার করা। যাতে নির্বাচন কমিশন বাধ্য হয় একশো শতাংশ ভিভিপ্যাট এবং ইভিএম মিলিয়ে তবেই নির্বাচনের ফল প্রকাশ করে। তবে এখানেও প্রশান্ত কিশোরের প্রাসঙ্গিকতা আছে। কিছুদিন আগে একটি সাক্ষাৎকারে পিকে বলেছিলেন, যদি বিরোধীরা মনে করে, ইভিএম দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা যায়, তাহলে তাঁদের উচিত আগামী সব নির্বাচন বয়কট করা। তা যদি না করা হয় তাহলে এই বিষয় নিয়ে বেশি শোরগোলও না করাই উচিত। বিরোধীরা যদি প্রশান্ত কিশোরের কথামতোই ইভিএম বাতিল বা নির্বাচন বয়কটের মতো হারিকিরি করে বসে তাহলে পিকের নতুন দল সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে। সুতরাং এক্ষেত্রেও বিরোধী কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়া জোটকে অত্যন্ত সচেতন হয়ে পা ফেলতে হবে।

প্রশান্ত কিশোরের আগে ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই তাঁদের দলের কৌশল ঠিক করতেন। তাঁরাই ছিলেন তথ্য সংশ্লেষক, তাঁরাই স্লোগান তৈরি করতেন নিজস্ব বিশ্লেষণী ক্ষমতায়। প্রশান্ত কিশোর আসার পরে ভারতীয় রাজনীতি এক অন্য চেহারা নেয়। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর ক্ষেত্রে প্রশান্ত কিশোরের ভূমিকা অপরিসীম। কীভাবে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে মোদির গুজরাত গণহত্যার চেহারা লুকিয়ে উন্নয়নের মুখ হিসেবে দেখানো হয়েছিল, তা অনেকেরই জানা। প্রশান্ত কিশোরের জন্যই ২০১৫ সালে নীতীশ কুমার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। অন্যের নির্বাচনী কৌশল ঠিক করে এসে প্রশান্ত কিশোর কি পারবেন নিজের দলকে জিতিয়ে আনতে? আদৌ কি নিজে জিততে চাইছেন পিকে না কি বিরোধী জোটের পথের কাঁটা হয়ে উঠতে চাইছেন মাত্র?

আরও পড়ুন- মুখোশের আড়ালে প্রশান্ত কিশোরের আসল মুখ, উন্মোচন করলেন করণ থাপার

প্রশান্ত কিশোরের নতুন বিহারের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে মানুষদের স্মৃতি থেকে কী করে মুছে যাবে গণহত্যার স্মৃতি? দলিত, পিছিয়ে পড়া মানুষদের ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলনের জন্য যখন উচ্চবর্ণের ভাড়াটে সেনাবাহিনী মানুষদের হত্যা করেছিল, তা ভুলে যাওয়া
সম্ভব? এখনও তো এই মানুষদের দলিত বলে অপমানিত হতে হয় বিজেপির উচ্চবর্ণের মানুষদের কাছে। ব্রাহ্মণরা কি নিচু জাতির উত্থান মেনে নিতে পারেন? সারা দেশেই কি দলিতদের উপর অত্যাচার কমেছে? পিকের প্রাক্তন মক্কেল নীতীশ কুমার তো নিজেই বিহারে জাতিগত জনগণনা করিয়েছেন ২০২৩ সালে। সেই জনগণনা অনুযায়ী, প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ ‘পিছিয়ে’ পড়া, আর যদি তপশিলি জাতি এবং উপজাতিকে যুক্ত করা হয়, তাহলে ‘পিছিয়ে’ পড়ার শতাংশ প্রায় ৮০-তে গিয়ে ঠেকে। অর্থাৎ মাত্র ১৫-২০ শতাংশ মানুষ অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে একটু এগিয়ে আছেন। ‘পিছিয়ে’ পড়া মানুষজন কেনই বা পিকে-কে বিশ্বাস করবেন?

প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে বিশ্বাস শব্দটির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রশান্ত কিশোরের রাজনৈতিক কুশলী হিসেবে আবির্ভাবের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্ব জড়িত। পিকের হাত ধরেই নীতীশ কুমার ২০১৫ সালে বিহারের কুর্সিতে বসেছেন। পিকের রাজনৈতিক দলের টাকার উৎস কে বা কারা, তা স্বচ্ছ নয়। এমন মানুষকে মানুষ বিশ্বাস করবেন তো? প্রশান্ত কিশোরের অতীতই ভারতে ফ্যাসিবাদী শাসনকে প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছে। তাঁর কাছ থেকে যাঁরা পরামর্শ নিয়েছেন অতীতে, তাঁরাও প্রশ্নের
ঊর্ধ্বে নন। এসব সত্ত্বেও তাঁর নতুন দল এবং বক্তব্যে যদি কিছু মানুষও আবার প্রভাবিত হন, তাহলে আগামী বছর বিহার বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী ইন্ডিয়া জোট বড় ধাক্কা খেতে চলেছে। 

More Articles