শুভেন্দু-অভিষেক দ্বৈরথে কে এগিয়ে? খেলা যেদিকে ঘুরছে

Subhendu-Abhisek: দুই হেভিওয়েটের দ্বৈরথ নিয়ে কী বলছেন বাংলার জনতা?

ডিসেম্বর, ২০২০। জল্পনা কল্পনা সত্যি করে মুকুলময় বিজেপিতে প্রবেশ ঘটল বঙ্গের অধিকারীর। নন্দীগ্রামের মসীহা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের অন্যতম হোতা, দিদির প্রিয় ভাই যোগ দিলেন গেরুয়া শিবিরে। দিল্লি গিয়ে নয়, শুভেন্দুর মোদি-শাহ গৃহে প্রবেশ ঘটল এই বঙ্গের মাটিতেই।

এরপর বঙ্গের রাজনৈতিক নদী দিয়ে বয়ে গিয়েছে গ্যালন গ্যালন জল। প্রবল উত্তেজনার বিধানসভা নির্বাচনে মমতার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন স্বয়ং শুভেন্দু। বিজেপি ক্ষমতায় আসছে এই মিথের প্রবল হয়রানির মধ্যেও মমতার সাধের নন্দীগ্রামে জিতেছেন কাঁথির সম্রাট! শিউলি সাহা, অখিল গিরিদের মনে আনন্দ দিয়ে ক্রমশ তৃণমূলের মূল রাজনৈতিক শত্রু হিসেবে বিবর্তিত হয়েছেন তিনি। একদিকে  বঙ্গ বিজেপিতে দিলীপায়নের অবসান অন্যদিকে শুভেন্দু উত্থানে মুকুল ফিরেছেন ঘরে। শত্রু থেকে বন্ধু হয়েও প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়েছেন কাঁচরাপাড়ার নেতা। অন্যদিকে উঠে এসেছেন শুভেন্দু।

কিন্তু এখানেই প্রশ্ন উঠেছে বারবার। বঙ্গ বিজেপি, বিরোধী রাজনৈতিক দল নাকি শুধুমাত্র শুভেন্দু অধিকারী। তৃণমূলের আক্রমণের, রাজনৈতিক ধ্বংসের লক্ষ্য কি! বলা হয়েছে, বঙ্গের গেরুয়া নেতারা নন, বঙ্গের বিজেপি দল নয়। শুধুমাত্র পুরনো বন্ধু শুভেন্দু র রাজনৈতিক নিধনেই সচেষ্ট হয়েছে তৃণমূল! তার অন্যতম কারণ না কি, ঘরের শত্রু বিভীষণের বিভীষিকা! অর্থাৎ পুরনো বন্ধু সব জানেন, তাঁকে কালো অন্ধকারে ঘিরে ধরতে পারলেই বাকিটা সম্ভব।

আরও পড়ুন: কুকথাই অস্ত্র! পঞ্চায়েত ভোটের আগে শুভেন্দুকে এভাবেই বিপাকে ফেলবে তৃণমূলের হোয়াটস্যাপ?

আর এই কাজেই প্রাধান্য পেয়েছেন তৃণমূলের বর্তমান যুবরাজ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই বিশেষত, তৃণমূলের মারাত্মক ভাঙনের সময় থেকে যাঁর দলীয় প্রভাব বেড়েছে ঝড়ের গতিতে। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, মমতাময় সবুজ শিবিরের দ্বিতীয় মুখ, একপ্রকার দলের হোতা হয়ে উঠেছেন অভিষেক। আর তাঁকে দিয়েই শুভেন্দু বিপদ রক্ষায় তৎপর হয়েছে তৃণমূল। যেখানে একইভাবে শুভেন্দুও চেষ্টা করেছেন তৃণমূলের অভিষেক খ্যাতিকে বিড়ম্বনায় ফেলতে। আর যার ফলস্বরূপ, রাজ্যে তৃণমূল বনাম বিজেপি লড়াই আখেড়ে হয়ে উঠেছে অভিষেক বনাম শুভেন্দুর মধ্যে।

আর সেখানে দাঁড়িয়েই বারবার এই দুই নেতার বাক বিতণ্ডা, ব্যক্তিগত আক্রমণের ঝুলি গরম করেছে পরিস্থিতি। বঙ্গের রাজনৈতিক মঞ্চে বারবার শুভেন্দু এবং অভিষেকের নাম উঠে এসেছে রাজনৈতিক অসৌজন্য এবং ব্যক্তিগত আক্রমণের দাবদাহে। বাম, কংগ্রেসের উত্তেজনাময় কূটকচালির মধ্যেও যুবরাজ আর দাদার কীর্তিতে ব্যতিব্যস্ত হয়েছেন জনতা! ক্রমশ, ছেলের জন্মদিন থেকে কয়লা ভাইপোর দুর্নীতি। ডোন্ট টাচ মাই বডি থেকে ট্রিপল চুরি, গেট ওয়েল সুন ছাড়িয়ে হোয়াটসঅ্যাপের কান্ডকারখানা! রাজ্যের রাজনৈতিক আর আর নীতি, আদর্শের লড়াই পর্যবসিত হয়েছে বন্দ্যোপাধ্যায় আর অধিকারী পরিবারের মধ্যে। সুকান্ত বিজেপি, দিলীপ অমিত শাহ আর কালীঘাট, মমতা ববিদের ছাড়িয়ে এই লড়াই পৌঁছেছে হাজরার শান্তিভবন বনাম কাঁথির শান্তিকুঞ্জে।

কিন্তু এই একাধিক টানাপড়েন আর দুই মুখের লড়াই কেন? কী বলছেন জনতা? এগিয়ে কে?

লড়াইয়ের কারণ
রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শুভেন্দু অধিকারী। এই দু'জনের রাজনৈতিক লড়াই ঠিক যতটা তার তুলনায় এঁরা বরাবর ব্যক্তিগত লড়াইয়ে টিকে থেকেছেন বেশি। কেন? এর উত্তর পেতে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন ইতিহাসের।

২০০৬ সাল। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সুতো পাকছে তখন থেকেই। সঙ্গে সিঙ্গুর। বিশেষত, মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম আবহে তখন বেশ প্রভাব বিস্তার করেছেন শুভেন্দু। শিশির পুত্রের রাজনৈতিক বাড়ন্ত হয়েছে। তখন থেকে দিদির কাছের লোক হয়েছেন শুভেন্দু। এরপর ক্ষমতার স্বাদ। শুভেন্দু অধিকারীর দিল্লির সংসদের অলিন্দে প্রবেশের ক্ষেত্রেও মমতার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের হাত ছিল। এহেন শুভেন্দু হঠাৎ করে পড়লেন চ্যালেঞ্জের মুখে। তৃণমূল রাজ্যের ক্ষমতা দখলের পর সরাসরি শুভেন্দুর মাথাব্যথার কারণ হলেন অভিষেক। কেন?

২০১১ সাল। তৃণমূলের যুব সংগঠনের জাতীয় সভাপতি হলেন অভিষেক। মমতার ভাইপোর হাতেই এই সংগঠনের জাতীয় দায়িত্ব গেল। যদিও ওই সময়ে দাঁড়িয়ে শুধু পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া বাইরের রাজ্যে এই সংগঠনের প্রভাব প্রায় ছিল না বললেই চলে। সেখানে দাঁড়িয়ে অভিষেকের এই দায়িত্ব, শুধু পদের জন্য পদ বলেই বলেছিলেন অনেকেই।

এখানেই বাধে গোল! এই সংগঠনের মূল ক্ষেত্র অর্থাৎ রাজ্যের সভাপতি তখন শুভেন্দু। যুব তৃণমূলের মুখ। সর্বেসর্বা। মমতার পর তিনিই সব। তাঁর সংগঠন বাড়ানো এবং কাজের পরিসরে ক্রমেই ঢুকছিলেন অভিষেক! সেই থেকেই শুরু বিবাদ।

২০১৪ সাল। অভিষেকের প্রভাব বাড়তে শুরু করল। পরিচিতি পেলেন এই নেতা। ডায়মন্ডহারবার লোকসভা আসন থেকে জিতে দিল্লির রাজপথে পা পড়ল অভিষেকের। তখন তিনি সাংসদ।

এরপরই বিবাদ বাড়ল আরও। যা মারাত্মক হল ২০১৬ এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে। দলীয় সূত্রে বলা হয়, মমতার হস্তক্ষেপে সেবার রাজ্যের রাজনীতিতে ফেরেন শুভেন্দু। বিধানসভা নির্বাচনের জিতে রাজ্যের মন্ত্রী হন তিনি। এর মধ্যেও নাকি হাত ছিল অভিষেকের!

২০১৯। অভিষেক বনাম শুভেন্দু। দলীয় দ্বন্দ্বের গোপনীয়তা ভাঙতে শুরু করে। শিরোনামে আসে মতবিরোধ!

২০২০। অভিষেক শুভেন্দু র বিবাদ ভাঙাতে সৌগত রায়, কুণাল ঘোষেরা চেষ্টা করলেও শুভেন্দু পা বাড়িয়ে দেন বিজেপির দিকে। অস্বস্তিতে পড়ে তৃণমূল। আর এখানেই ফের গুরুত্ব বাড়ান অভিষেক। শুভেন্দু অস্ত্র ভোঁতা করতে এগিয়ে যান তিনিই। ততদিনে দলের নাগাল প্রায় হাতে নিয়েছেন মমতার ভাইপো।

এখানেই ফের প্রশ্ন উঠেছে। রাজ্যের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাপে-নেউলে যুদ্ধের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছেন এই দু'জন। আর যে লড়াইয়ের বশবর্তী হয়েই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যেও।

এগিয়ে কে?
শুভেন্দু না অভিষেক। কাকে এগিয়ে রাখছেন জনতা! এই প্রশ্ন নিয়েই বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষের কাছে গিয়েছিল ইনস্ক্রিপ্ট। কলকাতার সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র বলা হয় নন্দনকে। সেখানেই বসে ছিলেন বাণীব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। পেশায় শিক্ষক। শুভেন্দু না অভিষেক? এই প্রশ্নের উত্তরে তাঁর দাবি, ''কেউ নয়! দুজনেই একই গাছের শাখাপ্রশাখা। তাই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে এই দুজনের একজনও এগিয়ে বা পিছিয়ে নন!'' বাঁকুড়ার বাসিন্দা, বর্তমানে যাদবপুর এলাকায় চাকরিসূত্রে বাস রবিউল ঘোষের। তাঁর বক্তব্য, ''রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যা, সেই হিসেবে এই মূহুর্তে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বা শুভেন্দু অধিকারী, কেউ-ই গ্রহণযোগ্য নন। তাই এই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে কে এগিয়ে, সেটাও ধর্তব্য হবে না।'' কলেজপড়ুয়া সুরজিৎ রায়ের কথায়, ''শুভেন্দু যাহা অভিষেক তাহা! উভয়ের তো চুরির একটা সুনাম রয়েছে বলে জানি!'' (নাম পরিবর্তিত)

যদিও এর বিপরীত কথাও বলছেন অনেকেই। গড়িয়াহাট অঞ্চলের গৌতম সাহা বলছেন, ''অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এগিয়ে। তৃণমূলের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না থাকার পরে অভিষেক শেষ কথা হবেন। আমার মনেহয়, অভিষেক পরিণত নেতা। তাঁর কথা দলের কর্মীরা শোনেন। আর শুভেন্দু চমকের নেতা। এই কারণে অভিষেক এগিয়ে।'' বালিগঞ্জের সুমতি নায়েক বলছেন, ''অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর প্রভাবিত করার ভঙ্গি, বেশ আকর্ষক। তাই রাজনীতি আর কোনও দলের মুখ হিসেবে এই মুহূর্তে অভিষেক এগিয়ে।'' আবার ঢাকুরিয়া এলাকার গোপাল বিশ্বাসের কথায়, ''শুভেন্দু অধিকারী। অভিষেক বনাম শুভেন্দু বললে শুভেন্দু অনেক এগিয়ে। তাঁর কথার মধ্যে মানুষের কথা রয়েছে। আর ভীষণ সাহসী নেতা।'' বিক্রমগড়ের বিশ্বদীপ চক্রবর্তীর মন্তব্য, ''শুভেন্দু অনেক বেশি পরিণত। অভিষেক হাওয়ায় হাওয়ায় কথা বলেন, এখানে দাঁড়িয়ে অভিষেক নন আমার কাছে শুভেন্দু এগিয়ে।''

কলকাতা ছাড়িয়ে শহরতলীর মানুষ কী বলছেন? হৃদয়পুরের বাসিন্দা। শুভময় মল্লিক নামের এক যুবকের কথায়, ''এখন তো গ্রেটার আর লেসার করে বাইনারি তৈরি করা হয়, সেই হিসেবে অভিষেক লেসার, কারণ ওঁ দল বদলাননি।'' প্রায় একই কথা বলছেন বারাসতের শর্মিষ্ঠা নাগ। তাঁর বক্তব্য, ''এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি, তাতে রাজ্যে শুভেন্দু আর অভিষেক কোনও পছন্দের তালিকায় থাকতেই পারেন না। এঁরা কেউ ঠিক নন। কিন্তু সবদিক থেকে দেখলে এগিয়ে অভিষেকই।" আবার মধ্যমগ্রামের বিমান মণ্ডলের কথায়, ''মনেহয় শুভেন্দু বেশি ভালো। এগিয়ে তিনি। অভিষেক নন।'' বিরাটির মধুসূদন দত্তের দাবি, ''অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শুভেন্দু অধিকারী তো নস্যি!''

যদিও কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে এই দোলাচলেও কেউ কেউ বলছেন তৃতীয় বিকল্পের কথাও। অর্থাৎ শুভেন্দু না অভিষেক, এই বিতর্কের মধ্যেই বঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উঠে আসছে ভিন্ন কোনও দল বা নামও। যার মধ্যে খানিকটা এগিয়ে বর্তমানের বামেরাও।

More Articles