রাত পোহালেই হুলুস্থুল বাংলায়, কাঁথিতে অভিষেক-ঝড়ে টলবে শান্তিকুঞ্জ?

Subhendu Adhikari: শনিবার বারবেলায়, রাজনৈতিক শনির দশা কাটাতে দু'জনেই অবতীর্ণ হচ্ছেন একে অন্যের পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে।

কথার যুদ্ধে ছারখার! কথায় বাড়ে কথার মধ্যেই এখানে কথা অস্ত্রসম চরে। শুভেন্দু বনাম অভিষেক। গত দু'বছরে বারবার কথার যুদ্ধে জড়িয়েছেন তৃণমূলের 'যুবরাজ' অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhishek Banerjee) এবং বিজেপি-র 'অবলম্বন' শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari)। বারবার বাক্যের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে শান্তিনিকেতন এবং শান্তিকুঞ্জ। বঙ্গের রাজনীতির সমগ্র পটভূমি পর্যবসিত হয়েছে দুই ব্যক্তির কথার লড়াইয়ে। খানিকটা কবিগানের মতো! যেন, 'একবারটি দেখে যা আমার কথার কী দম!'

এবার ফের সেই কথার বোমা বিস্ফোরণেই নামছেন অভিষেক এবং শুভেন্দু। শনিবার বারবেলায়, রাজনৈতিক শনির দশা কাটাতে দু'জনেই অবতীর্ণ হচ্ছেন একে অন্যের পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে। একদিকে অভিষেকের গড় ডায়মন্ড হারবারের লাইটহাউস মাঠ মাতবে শুভেন্দু-বাণীতে। অন্যদিকে কাঁথির শান্তিকুঞ্জ থেকে মাত্র ১০০ মিটারের মধ্যেই ঝড় তুলবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।

এই যুদ্ধ হবে কি হবে না, তা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। মামলাও হয়েছে আদালতে। শুভেন্দু কলকাতা হাই কোর্টে আবেদন করেছেন অভিষেকের সভার স্থল পরিবর্তনের জন্য। কিন্তু বৃহস্পতিবার শর্তসাপেক্ষে ওই একই জায়গায় সভার অনুমতি দিয়েছে আদালত। পাল্টা শুভেন্দুর সভায় বাধা নিয়ে অভিযোগ করে আদালতে গিয়েছে বিজেপি। কোর্টের নির্দেশে সভার অনুমতি এসেছে।

আরও পড়ুন: কয়লা পাচার কাণ্ডের তদন্তে চাবিকাঠি অভিষেকের শ‍্যালিকা? কীভাবে ঘনাচ্ছে রহস্য

কিন্তু যে কথার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এমনই এক শীতের দুপুরে, ডিসেম্বরে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো এবং শিশির অধিকারীর পুত্র শুভেন্দুর প্রকাশ্য বাক্য-লড়াই শুরু হয়েছিল ঠিক যে সময়ে, তাই-ই যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে শনিবারের এই সভার লড়াই! যা সামগ্রিকভাবে বঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকেই ঘুরিয়ে দিয়েছে নতুনভাবে।

'বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র' মেদিনীপুর থেকে কলকাতা ছাড়িয়ে উত্তরবঙ্গ হয়ে ঝড়ের গতিতে যা ছড়িয়েছে দক্ষিণবঙ্গেও। প্রত্যেক মুহূর্তে বিরচিত হয়েছে কেবলমাত্র এই দুই চরিত্রের একে অন্যের বিরুদ্ধে কুৎসা! দুই প্রান্তের কথার দামামায় বারবার উত্তাল হয়েছে বঙ্গের রাজনীতি।

অভিষেক বনাম শুভেন্দু
মাত্র ২ বছরেই বঙ্গ রাজনীতির শুভেন্দু-ম্যানিয়া ওলটপালট করে দিয়েছে অনেক কিছু! আদৌ বাংলায় বিজেপি আছে কি নেই, এই প্রশ্নের আবহেই উঠে এসেছে এই নাম। আর বঙ্গের রাজনীতির মঞ্চে নীতি-আদর্শ, মানুষের কাজের উর্ধ্বে উঠে এসেছেন দুই 'মহামানব'। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারী। যেন সমস্ত বিরোধ এই দুইয়ের মাঝেই। দোঁহে মিলে আন্দোলন করছেন! দু'জনেই গড়ে তুলছেন সবটা! আর সেখানেই উপজীব্য হয়েছে কথা।

কথায় বাড়ে বিরোধ
১৯ ডিসেম্বর, ২০২০। দু'দশকের সম্পর্ক শেষ করে তৃণমূল ছাড়লেন শুভেন্দু। অমিত শাহের হাত ধরে দিলীপ ঘোষ-মুকুল রায়দের উপস্থিতিতে গেরুয়া-ঘরে প্রবেশ করলেন শুভেন্দু অধিকারী। কুণাল ঘোষ, সৌগত রায়ের উপস্থিতিতে অভিষেক-অসন্তোষ কাটানোর চেষ্টায় জল ঢেলে মোদীর পথেই পা বাড়ালেন মমতার দলের এই অন্যতম মুখ।

সেই থেকে শুরু। দল পরিবর্তনের মঞ্চে, বিজেপি-র হয়ে প্রথম বক্তৃতায় শুভেন্দু বললেন, "তোলাবাজ ভাইপো হঠাও!" অমিত শাহের সামনে তখন সেই হুঙ্কারে হাততালি দিচ্ছেন মুকুলও। যদিও তিনি পরে অভিষেকের শরণে ঘরে ফেরেন।

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সংবাদমাধ্যম এবং একাধিক জনসভায় পাল্টা আক্রমণে সরব হতে হতেই অভিষেক পৌঁছে গেলেন কাঁথি। শান্তিকুঞ্জের কাছে দাঁড়িয়েই হুঙ্কার ছাড়লেন। শুভেন্দুকে ভরিয়ে দিলেন ব্যক্তিগত আক্রমণে। ''তুমি অকৃতদার নও বাবা, তুমি অকৃতকার্য।বেইমান গদ্দার।''

২৮ মে, ২০২২
কয়েকদিন আগেই হলদিয়ার এক সভা থেকে শুভেন্দু অধিকারীকে আক্রমণ করেছিলেন অভিষেক। সেই আক্রমণের জবাবে নন্দীগ্রামে দাঁড়িয়ে শুভেন্দু বলেন, "দিল্লি থেকে এসে উনি রাজনীতি শুরু করেছেন। ওঁর বাংলার রাজনীতিতে কোনও ডেডিকেশন নেই। ছাত্র রাজনীতি আন্দোলন, বিরোধী আন্দোলন, কোথাও কোনও অবদান নেই। ওঁর পেশা কী? রুজিরা নারুলা কে? কেন উনি এমবিএ লেখেন না?''

২৫ জুন, ২০২২
এদিন ফের অভিষেককে আক্রমণে বিদ্ধ করেন শুভেন্দু। তিনি বলেন, ''সব থেকে বড় তোলাবাজ ওঁ নিজেই, রুজিরা নারুলা কে? তার পরিচয়টা ঘোষণা করুক। কয়লার টাকা কে তুলত, বলে দিলেই তো হয়। অন্য অনেক কথা নিয়ে তো মানহানির মামলা করেছে। কিন্তু এটা নিয়ে তো করে না। কারণ আমি চেক দেখাই।''

৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২
উত্তরপাড়ার এক সভা থেকে ফের আক্রমণ শানান শুভেন্দু। অভিষেকের স্ত্রীর নাম করে, অভিষেকের শ্যালিকা মেনকা গম্ভীরকে নিয়েও আক্রমণ করেন শুভেন্দু।

ফের এর পাল্টা আক্রমণে সরব হন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। শুভেন্দুকে আক্রমণ করেন তিনিও।

১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২
বিজেপি-র নবান্ন অভিযানকে ঘরে অশান্তি এবং আহত পুলিশকর্মীকে দেখতে গিয়ে কপালে গুলি চালাতাম মন্তব্য করে বিতর্কে জড়িয়ে যান অভিষেক। কিন্তু সেখানেও ছাড় পাননি শুভেন্দু। পুরুষ পছন্দ করেন নেতা, এই কটাক্ষে বিদ্ধ হন শুভেন্দু।

১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২
পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুরে দলীয় কর্মীসভায় যোগ দিয়ে বিতর্ক বাড়ান শুভেন্দু অধিকারী। ওই অনুষ্ঠান মঞ্চে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একাধিক ইস্যুতে কটাক্ষ করেন। এর সঙ্গেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও আক্রমণ করতে শুরু করেন তিনি। মমতার দলের সাধারণ সম্পাদককে 'মাকাল ফল' বলে কটাক্ষ করেন শুভেন্দু অধিকারী। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে অভিষেকের পিতৃপরিচয় নিয়েও জোরালো আক্রমণ করেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা।

৪ নভেম্বর, ২০২২
ডায়মন্ডহারবারের এক বিজয়া সম্মিলনীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েও শুভেন্দুকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করতে ছাড়েননি অভিষেক।

১৩ নভেম্বর, ২০২২
অভিষেকের পুত্র আয়াংশের জন্মদিনের এলাহি আয়োজন এবং বিরাট ব্যবস্থা নিয়েও মন্তব্য করে বিতর্কে জড়ান শুভেন্দু। 'পিসি-ভাইপোর কোম্পানি' সহ একাধিক ব্যক্তিগত আক্রমণে জড়িয়েছেন তিনি।

১৪ নভেম্বর, ২০২২
জন্মদিন-অভিযোগকে কেন্দ্র করে ফের বিতর্ক বাধে দুই পক্ষের মধ্যে। 'গেট ওয়েল সুন' কার্ড পৌঁছয় তৃণমূলের তরফে। সেই কার্ড নিয়েও পাল্টা সরব হন শুভেন্দু।

১৫ নভেম্বর, ২০২২
একাধিক বাক-বিতণ্ডার পর এবার কথার যুদ্ধে অবতীর্ণ হল ইডি-সিবিআই ইস্যু। প্রকাশ্য জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে শুভেন্দু বললেন, ''ইডি একটা চার্জশিট দিয়েছে, কার নাম আছে। কে একটা বলেছিল না, এক টাকা নিয়েছি প্রমাণ করতে পারলে গলায় দড়ি দেব!''

ওই একই দিনে অভিষেক পাল্টা মুখ খোলেন। তিনি বলেন, ''ওঁকে শুধু বলুন কল রেকর্ড বের করব!'' এরপরে প্রকাশ্যে আসে কলের তথ্য। অস্বস্তিতে পড়েন শুভেন্দু। কিন্তু তারপরেই ফের 'তোলাবাজ ভাইপো' বলে আক্রমণ শানান শুভেন্দু।

মমতা-সাক্ষাতের রেশ ফুরোল!
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে রাজ্যের বিধানসভায় মুখোমুখি হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। দুই পক্ষের কথোপকথনে শুরু হয়েছিল বিতর্কও। আবার শুভেন্দুর ভাই দিব্যেন্দু অধিকারীর তরফে অভিষেককে চা পানের আমন্ত্রণে বিতর্ক বেড়েছিল আরও। বঙ্গ বিজেপি-র অন্দরে সমালোচিত হয়েছিলেন শুভেন্দু। কিন্তু সেই রেশ বেশিদিন টেকেনি। ফের একে অন্যের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। ব্যক্তিগত আক্রমণের অস্ত্রে শান দিয়েছে দু'পক্ষই। 'পুরনো বন্ধু' আর বর্তমান শত্রুর রাজনৈতিক নিধনে সচেষ্ট হতে সময় নেননি কেউ-ই। কিন্তু সেই দু'জন। সামনে এসেছেন শুভেন্দু আর আক্রমণের কেন্দ্রে অভিষেকই।

একের পর রাজনৈতিক যুদ্ধে ভূমিকা পালন করে কথা। কখনও তা নীতিগত, কখনও তা আদর্শের রসদ হয়। কিন্তু বঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে কথা হয়েছে অনন্য, ব্যক্তিগত আক্রমণের মাধ্যম। যা রাজনৈতিক বিভেদের বিচ্ছুরণ ঘটানোর তুলনায় যেন প্রকাশ করেছে ব্যক্তিগত বিচ্ছেদ। যা রপ্ত করেছেন অভিষেক এবং শুভেন্দুও, বলছেন অনেকেই।

More Articles