কয়লা পাচার কাণ্ডের তদন্তে চাবিকাঠি অভিষেকের শ্যালিকা? কীভাবে ঘনাচ্ছে রহস্য
Coal Scam: কয়লা পাচার কাণ্ডের কিংপিন কে? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে কি মেনকার মধ্যে!
ভারতের নাগরিক নন! এই দেশের সঙ্গে নাকি আইনগত সম্পর্কও নেই তাঁর! তবুও তিনি অভিযুক্ত। জড়িত কয়লা পাচারের অভিযোগের সঙ্গে। রাজ্যের অন্যতম 'হাই প্রোফাইল' মামলার অভিযুক্তদের তালিকায় উঠে এসেছে তাঁর নামও। রাজ্যের শাসক দলের 'যুবরাজ' অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্যালিকা মেনকা গম্ভীর। কলকাতা হাই কোর্টের একটি নির্দেশ ফের সামনে এনেছে থাইল্যান্ডের বর্তমান বাসিন্দার নাম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বউমা রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায় নারুলার বোনকে নিয়ে ফের অস্বস্তিতে তৃণমূল।
কী হয়েছে? ২ ডিসেম্বর, শুক্রবার কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবের ডিভিশন বেঞ্চ মেনকাকে নিয়ে দেওয়া সিঙ্গল বেঞ্চের 'রক্ষাকবচ' প্রত্যাহার করেছে। ১২ সেপ্টেম্বর যে হাই কোর্টের নির্দেশের বলে মেনকা রক্ষাকবচ পেয়েছিলেন। যেখানে তদন্ত থেকে শুরু করে দিল্লি ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ। সব ক্ষেত্রেই খানিকটা স্বস্তি পেয়েছিলেন অভিষেকের শ্যালিকা। সুপ্রিম কোর্টের তরফেও এসেছিল স্বস্তির খবর। কিন্তু ২ ডিসেম্বরের দুপুর ফের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিল কয়লা পাচার মামলায় অভিযুক্ত মেনকার।
আরও পড়ুন: রাজ্যের সঙ্গে বন্ধুত্বের পথে নতুন রাজ্যপাল? ধনখড়ের থেকে কতটা আলাদা সিভি আনন্দ বোস
মেনকা-অভিষেক সংযোগে
একদা দিল্লির বাসিন্দা নারুলা পরিবার ব্যবসায়িক সূত্রে পাড়ি দেয় থাইল্যান্ডে। সেখানেই তাঁরা বাঁধেন বাসা। একে একে প্রতিষ্ঠিত হন সে-দেশেই। আর ওই পরিবারের সন্তান রুজিরার সঙ্গে পড়াশুনার সূত্রে আলাপ হয় অভিষেকের। দিল্লিতে মহাসমারোহে বিয়েও করেন তাঁরা। রুজিরার বোন হিসেবেই মেনকার সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়দের।
কয়লা-পাচার এবং 'মেনকা-যোগ'
রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন শেষ হতেই একাধিক দুর্নীতি মামলায়, তদন্তের তৎপরতা ফের চরম পর্যায়ে নেয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। যা আরও বাড়ে কলকাতা বিমানবন্দরে অভিষেকের স্ত্রী-র সঙ্গে সোনা পাচারের অভিযোগ জড়িয়ে যাওয়ার পরে। কয়লা পাচারের অভিযোগে বিদ্ধ একাধিক 'মাথা'-র সঙ্গে যোগসাজশে ইডি-র সামনে আসে কোটি কোটি টাকার বেআইনি লেনদেনের তথ্য। আর সেই লেনদেনের তথ্যতালাশেই উঠে আসে বিভিন্ন নাম। যেখানে বিদেশি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এবং নানাভাবে টাকা লেনদেনের অভিযোগে জড়িয়ে যায় মেনকার নামও। অভিষেকের স্ত্রী অথবা স্বয়ং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর শ্যালিকাকেও ডেকে পাঠাতে শুরু করে ইডি। আর এই ডেকে পাঠানো, জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রেই বাধে বিপত্তি। মামলা ওঠে আদালতে। মেনকা শরণাপন্ন হন আদালতের। পাল্টা আইনি-অস্ত্রে শান দেয় ইডি-ও।
মেনকার আদালত-ইতিহাস
১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২। একাধিকবার তলবের রঙ্গমঞ্চের পর ফের নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয় এদিন। দিল্লিতে জিজ্ঞাসাবাদে আপত্তি জানিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন মেনকা। আদালতের রায় যায় তাঁর পক্ষেই। কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি মৌসুমী ভট্টাচার্য নির্দেশ দেন, দিল্লি নয়, কলকাতায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে মেনকাকে। এছাড়াও একাধিক ক্ষেত্রে খানিকটা স্বস্তি মেলে মেনকার। তাঁর বিদেশযাত্রার ক্ষেত্রেও কোনও বাধার কথা সেদিন বলেনি আদালত।
এই সময়েই ফের মেনকা নিয়ে বিপাকে পরে ইডি। সময়ের ভুলে মধ্যরাতে জেরার জন্য হাজির হন অভিষেকের শ্যালিকা। কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি।
সিঙ্গল বেঞ্চের নির্দেশের পর ফের আদালতের দ্বারস্থ হয় ইডি। ১২ সেপ্টেম্বরের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে ফের আবেদন করে ইডি।
১৭ অক্টোবর, ২০২২। অসুস্থ মাকে দেখতে বিনা বাধায় থাইল্যান্ড যাওয়ার অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করেন মেনকা। কয়েকদিন আগেই তাঁকে বিমানবন্দরে আটকায় ইডি। এই ঘটনায় তীব্র বিরোধিতা করেন মেনকার আইনজীবীরা। যদিও ওই মামলা পরে খুব একটা সুবিধা দেয়নি মেনকাকে। তিনি কলকাতাতেই থাকেন।
৩০ নভেম্বর, ২০২২। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্যালিকা মেনকা কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন বলে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে জানান অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল। ইডি তাঁকে যাতে হেনস্থা না করে সেই আর্জি জানিয়ে ডিভিশন বেঞ্চে মামলা করেছিলেন মেনকা। সেই মামলা খারিজ করা উচিত বলেও আদালতে মন্তব্য করেন অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল অশোক চক্রবর্তী।
আবার ওই দিনই আদালতে দাঁড়িয়ে মেনকা গম্ভীরের আইনজীবী জিষ্ণু সাহা দাবি করেন, "অহেতুক দিল্লিতে ডেকে যাতে জিজ্ঞাসাবাদ না করা হয়, এটাই আমাদের দাবি। মেনকা গম্ভীর একজন পরিচিত রাজনৈতিক নেতার শ্যালিকা মানেই তাঁকে অকারণে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায় না। তিনি কোনও তথ্য গোপন করেননি । তাঁকে সমন পাঠানো হলে তিনি জিজ্ঞাসাবাদে হাজির ছিলেন। তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন মেনকা।" যদিও একাধিক তথ্য তুলে ধরে ফের সরব হন ইডি-র আইনজীবি। মেনকার মামলা যে খারিজ হওয়া উচিৎ, এমনও জানানো হয় তাঁদের তরফে। আদালতেই প্রভাবশালী তকমা জোটে মেনকার।
৩ ডিসেম্বর, ২০২২। এবার সেই মামলাতেই নির্দেশ গেল ইডির পক্ষে। মেনকা গম্ভীরকে নিয়ে খানিকটা স্বস্তি পেল ইডি। অন্যদিকে হাইকোর্টের এই রায় সমস্যা বাড়াতে পারে অভিষেকের শ্যালিকার।
যদিও এই প্রসঙ্গে তৃণমূলের দাবি, "মেনকা কেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও বারবার তদন্তে সহযোগিতা করছেন। আদালতকে আমরা সম্মান করি, কিন্তু কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা যদি মনে করে রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে কাউকে অস্বস্তিতে ফেলবে, সেটাও চলবে না আর।'' বিজেপি-র দাবি, "এই তো সবে শুরু মেনকা দিয়েই সংখ্যা বৃদ্ধি হবে কি না, এর জবাব কে দিতে পারে!''
কয়লা পাচার কাণ্ডের কিংপিন কে? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে কি মেনকার মধ্যে! এমন প্রশ্নেও বারবার উত্তাল হয়েছে বঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এবার সেই মেনকাকে ঘিরেই ফের তৈরি হল জল্পনা। দিল্লি না কলকাতা! কোন পথে তদন্তের গতি বাড়াবে ইডি? না কি হাইকোর্ট ছাড়িয়ে ফের সুপ্রিম কোর্ট মুখে এগোবেন অভিষেকের আত্মীয়! একাধিক জল্পনা বিতর্ক আর প্রশ্নের মধ্যেই উঠে আসছে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য, যা বঙ্গের শীতকালীন আবহের উত্তাপ বাড়াতে যে যথেষ্ট, একথাও বলছেন কেউ কেউ।