বরফ গলানো না নৈতিক হারস্বীকার? কোন পথে হাঁটছেন অধিকারীরা

Subhendu Adhikari: অভিষেক-বিরোধী শুভেন্দু কি আলাদা করে মমতার সঙ্গে সমঝোতার রাস্তায় যেতে চান!

এখনও এক মাসও হয়নি। কাঁথির শান্তিকুঞ্জর সামনের রাস্তায় শুভেন্দু-সুস্থতার বার্তায় ভিড় জমেছিল সে-দিন। বৃদ্ধ শিশিরের উপস্থিতিতেও অভিষেকের যুব তৃণমূলের কর্মীরা জড়ো হয়েছিলেন সেখানে। হাজার হাজার রাজনৈতিক আরোগ্য কামনার কার্ড পৌঁছেছিল অধিকারী ভবনে।

ক'দিন আগেও শুভেন্দু-গড়ের সভা থেকে 'তুইতোকারি' করেছিলেন অভিষেক। কয়েক দিন আগেই 'বেইমান-চোর শুভেন্দু' স্লোগানে বারবার মুখরিত হয়েছিল নন্দীগ্রামের কুণাল-অখিল সভা।

কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল! বঙ্গরাজনীতির জ্বরের ওঠা-নামার মধ্যেই ফের সার্থক হলো তৃণমূল-শুভেন্দু এবং অধিকারী-তৃণমূল বিভেদ-বিচ্ছেদ ছাড়িয়ে ফের মিলনের পথ? আবার কি মুকুলের পথেই ঘরে ফেরার দৃষ্টান্ত তৈরি করতে চলেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীরা? না কি মমতাময়ী-রাজনীতির কাছে নৈতিক হার স্বীকার করে নিলেন নন্দীগ্রামের বিধায়কের পরিবার এবং তিনি নিজেও?

আরও পড়ুন: সেই তো আবার কাছে এলে… মমতা-শুভেন্দু সাক্ষাৎ নেহাত সৌজন্য? বাড়ছে জল্পনা

আরও কাছাকাছি?
২৫ নভেম্বর। শুক্রবার। রাজ্য বিধানসভার অধিবেশন চলাকালীন, 'সংবিধান দিবস'-এর আলোচনা শুরুর আগেই বহুদিন পরে ফের মুখোমুখি হন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari) এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। সৌজন্য-সাক্ষাতের আলোকে দোঁহে মেলেন আবার। 'কম্পার্টমেন্টাল মুখ্যমন্ত্রী দিদি'-র পা ছুঁয়ে প্রণাম থেকে 'গডসের দলের গদ্দার ভাই'-কে চা-পানের অনুরোধ। শুক্রবারের দুপুর উত্তেজনাময় করেছিল বঙ্গরাজনীতির এই হঠাৎ সাক্ষাৎ-পর্ব। দু'জনেই বলেছিলেন, 'সৌজন্য সাক্ষাৎ'। একাধিক দাবির কথা জানিয়েছি, বলেছিলেন ভাই শুভেন্দু। কিন্তু দিদি!

ঠিক একটু পরেই রাজ্য বিধানসভায় দাঁড়িয়ে শুভেন্দুর 'সংবিধান দিবস'-এর বক্তৃতায় যেন কোনও সমস্যা না হয়, বলে দিয়েছিলেন বিধায়কদের। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সহযোগীকে ভাই বলে সম্বোধন থেকে শুরু করে 'দাদা শিশির'-এর কথা তুলে আনা। মমতার এদিনের প্রকাশ ছিল দেখার মতো।

আর তার পরেই জল্পনা বেড়েছে আরও। সৌজন্য সাক্ষাতের আদলে ঢুকেছে বিতর্ক। হাই প্রোফাইল দুই রাজনৈতিক চরিত্রের এই সংবিধান-মিলন ঘিরে তুফান উঠেছে আলোচনায়। স্বাভাবিকভাবেই ঘরে ফেরার ডাক পড়েছে ফের! এই প্রশ্নেও উত্তাল হয়েছে রাজ্য রাজনীতি। আর সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সিপিএম-কংগ্রেস নেতারা বলেছেন, 'সেটিং। দিদি আর ভাইয়ের বিজেমুল গট-আপ!'

কিন্তু যা বলবেন সেটাই কী আর হয়! তৃণমূল বলেছে, সৌজন্য। বিজেপি-ও ঘুমোতে গিয়েছে সৌজন্য-বিছানাতেই।

যদিও এই সাক্ষাতের পরেই যেন কয়েক ঘণ্টার জন্য ঘুরেছে পরিস্থিতি। মিঠুন চক্রবর্তীর যে সভা নিয়ে অভিযোগ করছিল বিজেপি! সেই সভাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছেন স্বয়ং তৃণমূল বিধায়ক। অর্থাৎ, নেত্রী মমতার একটি কৌশল আর ভাই শুভেন্দুর সঙ্গে দেখায় বদলে গিয়েছে সবটা!

অধিকারীদের মমতা-শরণ
আর এই আবহেই আবারও জল্পনা বাড়িয়েছেন শুভেন্দু অধিকারীর ভাই সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারী। তিনি শুক্রবারই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলেন, "এটা সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি। এতে আমার কিছু বলার ধৃষ্টতা নেই। সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলনেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী। আজ যে সৌজন্যের নজির দেখা গিয়েছে, তার জন্য সাধুবাদ জানাচ্ছি।''

তাঁর বাবা অর্থাৎ শিশির অধিকারী নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য প্রসঙ্গে দিব্যেন্দু বলেন, "ব্যথা-যন্ত্রণার কথা তো আমরা ভুলতে পারব না। আমার বাবার ৮৪ বছর বয়স। নেত্রী আজ দাদা বলে সম্বোধন করেছেন। কিন্তু দলের যাঁরা এসব অসম্মান করেছেন, তাঁদের আগামী দিনে নিশ্চয় নেত্রী সাবধান করবেন।''

যদিও দিব্যেন্দু অধিকারী এখনও তৃণমূল সাংসদ। দলের তরফে কোনও সভায় ডাক না পেলেও দিব্যেন্দু এখনও বিজেপি-তে যোগ দেননি সরাসরি। এমনকি শিশির অধিকারীও খাতায় কলমে তৃণমূলের সাংসদ। তিনিও আনুষ্ঠানিকভাবে দল পরিবর্তন করেননি এখনও। অর্থাৎ একই পরিবারের বর্তমানের সর্বাধিক প্রভাবশালী রাজনীতিক, মমতার দলের প্রধান বিরোধী দলে থাকলেও তাঁর পরিবারেই রয়েছে তৃণমূলের একাধিক সাংসদ-নেতা! এই জল্পনাও তীব্র হয় মাঝে মাঝেই।

এদিকে দিব্যেন্দু (Dibyendu Adhikari) এই মন্তব্য করার পরেই শুরু হয়েছে জল্পনা। তাহলে কি একে একে অধিকারীরা আবারও কাছে আসছে তৃণমূলের! শুভেন্দু-ছোঁয়ায় কি ফের বিকশিত হচ্ছে মমতা-গ্রহণের পথ।

চা-য়ে চা-য়ে রাজনীতি
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhishek Banerjee)। মমতার পরে তৃণমূলের বর্তমান 'সেকেন্ডে ইন কম্যান্ডা' তিনি। বেশ কয়েক দিন আগেই তাঁর ছেলে আয়াংশের জন্মদিনের অনুষ্ঠান নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন রাজনৈতিক-শত্রু শুভেন্দু। একাধিক ক্ষেত্রে কয়লাপাচার, গরুপাচার থেকে শুরু করে তাঁর স্ত্রী-র সোনা-কাণ্ড। সব নিয়েই ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের পর থেকে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন অভিষেক। একের পর এক ব্যক্তিগত আক্রমণের তির ছুঁড়েছেন শুভেন্দু। নন্দীগ্রাম থেকে বর্ধমান, কয়লা-ভাইপো থেকে শুরু করে তোলামুল কোম্পানি-র প্রধান! অভিষেককে বিঁধতে একটুও খামতি রাখেননি এই বিজেপি নেতা তথা অভিষেকের প্রাক্তন সতীর্থ।

বলা হয়, এই অভিষেকের প্রভাবেই তৃণমূলে স্থান-সংকট তৈরি হয়েছিল শুভেন্দু অধিকারীর। এবার সেই শুভেন্দু-শত্রুও বন্ধু হলেন অধিকারীদের? বিধানসভা এবং সাক্ষাৎ আবহে আলোচনায় এসেছে দিব্যেন্দু অধিকারীর আর একটি মন্তব্যও। তিনি বলছেন, "অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যদি আমাদের বাড়িতে এসে চা খেয়ে যান, ভালো লাগবে। তাঁকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি!"

হঠাৎ কী হলো! প্রসঙ্গত, আগামী ৩ ডিসেম্বর শান্তিকুঞ্জ থেকে ২০০ মিটার দূরে একটি কলেজের মাঠে সভা করবেন তৃণমূল নেতা, সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিছুদিন আগে এমনই এক সভা থেকে শুভেন্দুকে একের পর আক্রমণে বিদ্ধ করেছিলেন তিনি। সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভায় এখনও ডাক পাননি তৃণমূল সাংসদ দিব্যেন্দু। কিন্তু সেই নেতাকেই আগেভাগে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলেন শুভেন্দুর ভাই!

কেন? রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, দাদার রাজনৈতিক সৌজন্যের পথে হাঁটার চেষ্টা করেছেন তিনি! সাংসদ নিজেও দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন আসলে মারামারি-হানাহানি আর ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, রাজনীতিতে সৌজন্য প্রয়োজন। কিন্তু!

নৈতিক হার অধিকারীদের?
রাজনৈতিক মহলের আর এক অংশ বলছেন, সৌজন্য নয় আসলে যেন ফের নমনীয় হচ্ছে পরিস্থিতি। আর সেখানে দাঁড়িয়েই অধিকারীরা হয়তো বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের প্রতি খানিকটা ঝুঁকছেন! আর এর সঙ্গেই একাধিক সাক্ষাতের, চা-য়ের আমন্ত্রণের আদলে আসলে উঠে আসছে নৈতিক হারের প্রশ্নও।

কেন? রাজনৈতিক মহলের আর এক অংশের মতে, ২০২০ এর ডিসেম্বরে একাধিক জল্পনার মধ্যে শুভেন্দু অধিকারীর দলবদল ঠেকাতে সর্বাধিক চেষ্টা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেককে সঙ্গে নিয়ে সৌগত রায়, কুণাল ঘোষেরা বসেছিলেন আলোচনায়। কিন্তু পারেননি! শুভেন্দুকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা।

২০২১। রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। একের পর এক জনসভা থেকে রাজনৈতিক কৌশল, দিলীপ-প্রতিভা ছাড়িয়ে বঙ্গ বিজেপি-র রাশ হাতে নেন শুভেন্দু। নন্দীগ্রামে হারিয়ে দেন তাঁর প্রাক্তন নেত্রীকেই। বিজেপি ক্ষমতায় না এলেও শুভেন্দু হয়ে ওঠেন অন্যতম। রাজ্যের বিরোধী দলনেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েই নাস্তানাবুদ করেন সবুজ শিবিরকে। আদালত, চাকরি, দুর্নীতি আর একাধিক ইস্যুতে চেপে বসেন তিনি। পুরনো বন্ধুর কাজে খানিকটা যেন অস্বস্তিতে পড়ে তৃণমূল।

কিন্তু অনেকেই বলেন, এতে এখনও কাজের কাজ কিছু হয়নি। ডিসেম্বরেই সব হবে! এই হুজুগ তুলেই এগিয়েছে বঙ্গ বিজেপি। আর কেন্দ্রীয় অনুদান আটকে উন্নয়ন বন্ধ করার অভিযোগ এবং লক্ষ্মীর ভান্ডার ধরে রাজনৈতিক কৌশল সফলের পথে এগিয়ে গিয়েছেন মমতারা।

কেউ কেউ এ-ও বলছেন যে, এই দুইয়ের গেরোয় রাজনৈতিকভাবে দুই পক্ষের তরফে দুই পক্ষকে প্রয়োজন হতে পারে। আর সেই প্রয়োজনীয়তায় রাজনৈতিক প্রভাবের বিস্তারের জন্মদাত্রী, নেত্রী মমতার কাছে যে খানিকটা নৈতিক হার ঘটতে পারে শুভেন্দু অধিকারীদের, এ-কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর সেখান থেকে ফের একটু নিজেদের হেয় করেও এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারবদ্ধ হতে পারেন অধিকারীরা?

যদিও পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। অভিষেক-বিরোধী শুভেন্দু কি আলাদা করে মমতার সঙ্গে সমঝোতার রাস্তায় যেতে চান! না কি সৌজন্যের আবহেই বিজেপি-র জন্য কিছু করতে চাইছেন তিনি। তাহলে আবার অভিষেককে চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ কেন!

একাধিক প্রশ্ন, জল্পনা-কল্পনা আর শীতের মরশুমে সৌজন্য-উষ্ণতার ছোঁয়ায় উঠে আসছে নৈতিক হার-জিতের প্রসঙ্গও। কিন্তু সবটাই ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যেন হাতড়ে বেড়াচ্ছে উত্তর। যা প্রকাশ করবে সময়!

More Articles