প্রযুক্তি কীভাবে বদলে দিচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে

ডিজিটাল ইন্ডিয়া, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মস্তিষ্কপ্রসূত এই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বর্তমানে পুরোদমে শুরু হয়েছে সারা ভারতে। প্রতিবছর রেকর্ড হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যাও। ২০২৫ সালের মধ্যেই আশা করা যায়, ভারতের ৫৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করতে শুরু করবেন। কিন্তু, বিগত দশক পর্যন্ত ভারতের অধিকাংশ মানুষের কাছেই ইন্টারনেট ছিল শুধুমাত্র সময় নষ্ট করার জিনিস। ফেসবুক, ইউটিউবের মত জায়গাগুলিতে সারাদিন ভিডিও দেখা থেকে শুরু করে ভিডিওকলে বন্ধুদের সঙ্গে কথোপকথন, এই ছিল এতদিন ভারতে ইন্টারনেটের পরিভাষা। কিন্তু একটি ছোট্ট ভাইরাস যেন ইন্টারনেটের প্রতি পুরো ভারতের ভাবমূর্তিটাকেই একেবারে পাল্টে দিল।

২০২০, এই বছরটি আমাদের সকলের কাছেই একটি ত্রাস হয়ে থাকবে। করোনা ভাইরাসটির কামড়ে যেমন রীতিমতো নড়ে উঠেছিল আমাদের চিকিৎসা, অর্থনীতির মত বড় সেক্টরগুলি, ঠিক একইভাবে সম্পূর্ণ ভোল পাল্টে গিয়েছিল আমাদের চিরকালীন প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার। ছোট থেকে বড় সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিজেদের শিক্ষণের পদ্ধতি বদলাতে হয়েছিল। এত যুগ ধরে অফলাইনে চলতে থাকা শিক্ষাব্যবস্থাকে মুহূর্তের মধ্যে নিয়ে যেতে হয়েছিল অনলাইনে। সব কিছুই ভার্চুয়াল। এ যেন প্রখ্যাত কল্পবিজ্ঞান গল্পকার আইজ্যাক অ্যাসিমভের 'দ্য ফান দে হ্যাড' -এর মত অবস্থা। দেশের প্রত্যেক পড়ুয়াই যেন এক একজন মারগি এবং তাদের সামনে তাদের কম্পিউটার অথবা মোবাইলের স্ক্রিন।

শুধু দেশে কেন সারা বিশ্বে এরকম দৃশ্যই দেখা গিয়েছিল বিগত এক থেকে দেড় বছর ধরে। শিক্ষকদের শিখতে হয়েছিল নতুন পদ্ধতি, মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল গুগল মিট, জুম, মাইক্রোসফট টিমস- এর মত বহু অ্যাপ্লিকেশন। শুধু অনলাইন পড়াশোনা না, অনলাইন অ্যাডমিশন, অনলাইন প্রজেক্ট, অনলাইন প্রেজেন্টেশন, অনলাইন পরীক্ষা এমনকি শিক্ষক দিবসের দিনের অনুষ্ঠানটা পর্যন্ত সারতে হয়েছিল অনলাইনেই। শিক্ষকেরা এবং তাদের পছন্দের প্রথম বেঞ্চের ছাত্ররা বলেছিলেন, অফলাইনটাই ভালো ছিল। স্কুল এবং কলেজের শিক্ষায় হয়তো অনলাইন ব্যবস্থাটি অনেকের ক্ষেত্রে অনেক কিছু সমস্যার কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছিল। যাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ তাদের অনেকের পক্ষে একদম সাধারণ মোবাইলটুকু কেনাটাও সমস্যার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবার অতি সাধারণ পড়ুয়াদের 'রেজাল্ট' দেখেও চক্ষুচড়কগাছ হওয়ার মতো অবস্থা। তবুও ২০২০  ছিল ভারতের শিক্ষার মানোন্নয়নে এবং ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে একটি বড় মাইলফলক।

২০২০ থেকে ভারতের অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা একটা অন্য উচ্চতায় পৌঁছানো শুরু করেছে। যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এর আগে মাত্র ২০ শতাংশ ডিগ্রি কোর্স অনলাইনে পড়াত, তারাও ধীরে ধীরে অনলাইনের আলাদা বিভাগ তৈরি করছে। বিভিন্ন ই-লার্নিং ওয়েবসাইট এবং ইউটিউব চ্যানেলগুলি ভালো কাজ করতে শুরু করেছে। বহু টেকনোলজি নির্ভর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি অনলাইনে নিত্যনতুন ডিগ্রী কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স চালানো শুরু করেছে। ম্যানেজমেন্ট, কথোপকথনমূলক শিক্ষা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর বিভিন্ন রকমের কোর্সে ছেয়ে যাচ্ছে গোটা ভারত। যারা এতদিন ইউটিউবকে শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতো, তারাও ইউটিউবের মাধ্যমে নতুন কিছু শেখা শুরু করছে। শুধু এটুকুই নয়, ভারতের শিক্ষার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট নির্ভর ব্যবস্থাপনা আরো কিছু এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে চলেছে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে। যা, এর আগে কল্পনাও করা যেত না।

সাধারণ অফলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় একসঙ্গে প্রতিটি পড়ুয়ার উপরে একইভাবে নজর দেওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু ইন্টারনেট-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্র এবং তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটা সু-নিবিড় সম্পর্ক তৈরিও হতে পারে। অফলাইনে কোনওভাবেই শুধুমাত্র একটি ছাত্রকে আলাদা করে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা অনলাইন হলে, যে কোনও  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ছাত্রের প্রতিটি প্রয়োজন বুঝে ওঠা আরও সহজ হয়ে যাবে। এর ফলে, পড়ুয়া তার সমস্ত প্রয়োজন সহজভাবে জানাতে পারবে এবং যে কোনও জিনিস আরও গভীরভাবে শিখতে পারবে।

অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার জন্য আলাদা করে নতুন কিছু টেকনোলজি তৈরি করা হবে। অনলাইনে শিক্ষা দেওয়ার জন্য আরও বেশি সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। এর ফলে ,একদিকে যেমন প্রত্যেক পড়ুয়া নিজের পছন্দের শিক্ষকের কাছে পড়তে পারবে, তেমনই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও কমবে সারাদেশে। সাম্প্রতিক সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য তৈরি করা হবে নতুন কিছু শিক্ষাপদ্ধতি এবং শিক্ষার জন্য বিভিন্ন নতুন কৌশল। যা, দেশের সবথেকে প্রত্যন্ত এলাকাতেও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে সক্ষম। প্রত্যন্ত এলাকায় যেখানে শিক্ষক এবং ছাত্রদের অনুপাত সবথেকে খারাপ থাকে, সেখানেও অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতের বড় বড় শিক্ষকরা নিজেদের জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে পারবেন ছাত্রদের কাছে।

সাবেকি শিক্ষাব্যবস্থা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর নতুন প্রজন্মের শিক্ষাব্যবস্থার মেলবন্ধনে একটি নতুন ধরনের অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা জন্ম নেবে যেটি শুধুমাত্র কোন পড়ুয়াকে পড়াবে না, বরং তার ভবিষ্যতের দিকনির্দেশেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষকরা একটি ছাত্রকে শেখাতে পারবেন, কী করে নিজে একজন শিক্ষক হতে হয়, কী করে অন্যকে শেখাতে হয়।

নতুন প্রজন্ম সবসময় এমন ব্যবস্থা পছন্দ করে যেখানে, সমস্ত জিনিস খুবই সহজে তারা শিখে নিতে পারে। সেখানেই তাদের সাহায্য করবে স্মার্ট কনটেন্ট এবং উন্নতমানের অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা। এই ধরনের অনলাইন শিক্ষা সকলের কাছেই হয়ে উঠবে আরও সহজ, আকর্ষণীয় এবং উপভোগ্য। নব প্রজন্মের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্তমানে তাদের পড়ুয়াদের জন্য নতুন ধরনের পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তক এবং অনলাইন স্টাডি মেটিরিয়াল তৈরি করা শুরু করেছে। এছাড়াও, সহজ কিছু অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে শিক্ষকরাও পড়ুয়াদের সঙ্গে আরো ভালোভাবে যোগাযোগ রাখতে পারছেন। অনলাইন গেম, ক্যুইজ, অ্যানিমেশন ভিডিওর মাধ্যমে নবপ্রজন্মের পড়ুয়াদের কাছে শিক্ষাটাকে আরও আনন্দদায়ক করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে।

আগামী প্রজন্মের কাছে সবথেকে ভালো জিনিসটা পৌঁছে দিতে ব্যবহার করা হবে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটিকে। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় ভার্চুয়াল রিয়েলিটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সাধারণভাবে হাতে লিখে অথবা ভিডিও তৈরি করে যে সমস্ত বিষয়গুলি বোঝানো সম্ভব হয় না, সেক্ষেত্রে কাজে লাগবে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। তবে এই জিনিসটি আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল পড়ুয়াদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়তো খুব একটা সহজ কাজ হবে না।

সর্বোপরি ভারত সরকারের তরফ থেকেও নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে অনলাইন এবং ইন্টারনেট-নির্ভর শিক্ষার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে আগামী প্রজন্মের জন্য নতুন কিছু আরো আকর্ষণীয় তৈরি করার পরিকল্পনা চলছে। ২য় এবং ৩য় সারির গ্রামের সকল পড়ুয়াদের হাতের মুঠোয় সবথেকে ভালো শিক্ষাকে তুলে দেওয়ার জন্য ভারত সরকার বদ্ধপরিকর। এই পুরো বিষয়টি ভারতের মতো একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশের কাছে একটি পাহাড়প্রমাণ বিষয় ছিল। কিন্তু, মাত্র একটি বছরের মধ্যেই অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় ভারতের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য ভারত সরকারের তরফ থেকে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ৯৩,২২৪.৩১ কোটি টাকা বরাদ্দও করা হয়েছে।

তবুও, অনলাইন শিক্ষা এবং ক্লাসরুম শিক্ষার মধ্যে এখনও কিছুটা তফাত রয়েই গিয়েছে। যে সমস্ত জায়গায় ক্লাসরুম শিক্ষা সম্ভব, সেখানে কিন্তু সাবেকি শিক্ষা ব্যবস্থাকে টেক্কা দেওয়ার মতো জায়গায় এখনও পর্যন্ত আসতে পারেনি ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে প্র্যাকটিক্যাল, ফিল্ড প্রজেক্টের মত বিষয়গুলি কোনোভাবেই অনলাইন মাধ্যমে শেখানো সম্ভব নয়। তবুও, ২০২০ সাল আমাদের এটা অন্তত দেখিয়ে দিয়ে গেল যে, অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা আগামী ১০ বছরের মধ্যে শিক্ষার জগতে একটা ভালো জায়গা দখল করবে। বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রে অনলাইন মাধ্যম সাবেকি শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও টক্কর দেবে। সেই সময় হয়তো প্রয়োজন হবে আরও কিছু নতুন প্রযুক্তির, আরও কিছু নতুন গ্যাজেটের। বৃদ্ধি পাওয়া চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে প্রযুক্তির হবে বহুল ব্যবহার। তৈরি হবে অগণিত নতুন সম্ভাবনা। যার ফলে, আশা যে, আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে ভারতের যুবসমাজ।

তথ্যসূত্রঃ

  • https://timesofindia.indiatimes.com/blogs/toi-edit-page/how-tech-is-shaping-education-technology-can-offer-more-flexibility-and-learning-support-than-traditional-formats/
  • https://www.globusinfocom.com/blog/how-technology-changed-education-in-india
  • https://www.indiatoday.in/education-today/featurephilia/story/7-immediate-changes-needed-in-the-indian-education-system-1579167-2019-08-09
  • https://www.thehindubusinessline.com/opinion/how-digitisation-and-technology-are-shaping-education-in-india/article34090642.ece

More Articles