বিশ্বকাপের মাঝেই কাতারে সাংবাদিকের মৃত্যু! হত্যা নাকি... শোরগোল বিশ্বজুড়ে

Fifa WorldCup 2022 : শুক্রবার আর্জেন্টিনা ও নেদারল্যান্ডসের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ চলাকালীন হার্ট আট্যাক হয় গ্রান্ট ওয়াহেলের

ভারতীয় সময়ের হিসেবে তখন মধ্যরাত। ব্রাজিল হারার শোক তখনও দগদগে ঘা। তার মধ্যেই মাঠে নেমেছে আর্জেন্টিনা আর নেদারল্যান্ড। মরণ-বাঁচন লড়াই চলছে কাতারের ময়দানে। এক চুল জমি নিয়ে টানটান উত্তেজনা। ঠিক এরকম সময়ে মাঠের বাইরেও চলছিল আর একটা উত্তেজনা। যার টের পায়নি কেউই। টের পাননি স্বয়ং ব্যক্তিটিও। হঠাৎ মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে যান বিশিষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক গ্র্যান্ট ওয়াহল। তড়িঘড়ি তাঁকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যান চিকিৎসকেরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। কাতার বিশ্বকাপের মাঝেই নিমেষে নজর ঘুরিয়ে নিল নিজের দিকে। মারা গেলেন গ্র্যান্ট ওয়াহল।

উত্তেজনা তখন চরমে। কাতার বিশ্বকাপে লুসেইল স্টেডিয়ামে ২-০ এগিয়ে লিওনেল মেসিরা। কিন্তু নেদারল্যান্ডও রয়েছে স্বমহিমায়। ইনজুরি টাইমের একেবারে শেষে ২-২ করে ফের খেলায় ফেরে তারাও। যদিও শেষ হাসি হাসে আর্জেন্টিনা। কিন্তু মাঠের এই উত্তেজনার বাইরে অন্য যে উত্তেজনা চলছিল সেই খেলাতে জয় হয়নি কারোরই। চিকিৎসকরা স্ট্রেচারে করে স্টেডিয়াম থেকে হাসপাতালে নেয়ার আগে প্রায় ৩০ মিনিটের জন্য ওয়াহলকে চিকিৎসা করেন। শনিবার সকালে ওই হাসপাতালেই তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ হিসেবে চিকিৎসকেরা হার্ট অ্যাটাকেই দায়ী করেছেন।

আরও পড়ুন : খুনোখুনি, সংঘর্ষ! বিশ্বকাপের মরশুমে যেভাবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা শিবিরে দু’ভাগ বাংলাদেশ

আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডস বিশ্বকাপ খেলায় মিডিয়া ট্রিবিউনে ছিলেন সাংবাদিক। ফুটবলের প্রতি অকৃত্রিম টান যে তাঁর আমৃত্যু, তা আজ স্পষ্ট। গ্রান্ট ওয়াহল, বয়স মাত্র ৪৮। একজন খেলাধুলা সচিত্র সাংবাদিক ছিলেন তিনি। পাশাপাশি নিজের একটি স্বয়ংক্রিয় ওয়েবসাইট চালাতেন। আর তাতেই তুলে ধরছিলেন কাতার ময়দানের সব গল্প। সেই গল্পের পাতা ফুরোল আজ। লেখা হল না সেমিফাইনাল আর ফাইনাল ম্যাচের কিসসা। বিনা নোটিশে চলে গেলেন তিনি।

বিজ্ঞান বলছে, তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিক। চিকিৎসকেরাও তাইই বলছেন। একটা হার্ট অ্যাটাক, তা তো যখন তখন হতে পারে। তার ওপর অমন ম্যাচের উত্তেজনা, তাতেই নার্ভ ধরে রাখতে পারেননি ওয়াহল। কিন্তু এটাই কি আসল কারণ? নাকি এর আড়ালে রয়েছে অন্য কোনও কারণও? প্রশ্ন উস্কে দিয়েছেন স্বয়ং গ্রান্ট ওয়াহলের ভাই এরিক ওয়াহেল। দাদার মৃত্যুর খবর পেয়েই তিনি অভিযোগ করেন, এ মৃত্যু তিনি স্বাভাবিক বলে মানেন না। এমনকী এ ঘটনায় তিনি সরাসরি আঙুল তুলেছেন কাতার সরকারের দিকে।

প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার, সাম্প্রতিক আরও একটি ঘটনা। যে ঘটনার জেরে শিরোনামে এসেছিলেন সাংবাদিক গ্রান্ট ওয়াহল। ঘটনাটি ২১ নভেম্বর, সোমবারের। পোশাকে রামধনু রঙ থাকায় চরম বিপদের সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে। ঘটনাটি সামান্য কিছুতে আটকে থাকে না। রীতিমত হেনস্থার শিকার হন তিনি। অপরাধ কেবল ওই পোশাক পরাটিই। রামধনু রং অর্থাৎ এলজিবিটিকিউ এর সমর্থক। এদিকে কাতারে সমকামিতা অবৈধ। ব্যাস, এতেই সমস্যা গড়ায়। বিশ্বকাপের নিরাপত্তারক্ষীরা আটক করেন সাংবাদিককে। ঘটনা শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ থাকে না। তাঁর পোশাক খুলে ফেলতেও বাধ্য করে তাঁরা। কেড়ে নেওয়া হয় ফোনও। এই সমস্ত ঘটনাই টুইট করে জানান গ্রান্ট ওয়াহল। টুইটটি ভাইরালও হয়ে যায় নিমেষে। বৈশ্বিক বিচারে শুরু হয় পর্যালোচনা।

কাতারের শরিয়া আইন অনুসারে, সমকামী সম্পর্ককে অনৈতিক বলে মনে করা হয়। এই আইন অনুযায়ী একজন অনৈতিক কাজের জেরে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডও হতে পারে। শুধু এটুকুই নয় হতে পারে মোটা অঙ্কের জরিমানাও। এমনকী নির্বিশেষে পাথর ছুঁড়ে মারার নির্দেশও দিতে পারে কাতারের আইন। পাশাপাশি মুসলিম সমকামীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দিতে পারে আইন। ২০০৪ সালের এই আইন অনুসারে কাতারে সমকামিতা নৈব নৈব চ! অথচ তারই সমর্থনে সাংবাদিক পোশাক পরেছেন। উত্তাপ তো ছড়াবেই। হয়েছিলও তাই। সাংবাদিকের ট্যুইট থেকে আঁচ পাওয়া যায় গোটা ঘটনাটির।

আরও পড়ুন : উটে উঠলেই বিপদ! বিশ্বকাপে হু হু করে যে রোগ ছড়াচ্ছে কাতারে

সাম্প্রতিক এই ঘটনাটি কাতার ময়দান সহ কাতারের আইন রক্ষকের অনেকই ভুলে গিয়ে থাকলেও ভুলতে পারেননি গ্রান্ট ওয়াহলের ভাই এরিক ওয়াহেল। এদিন তিনি সরাসরি খুনী হিসেবে দাগিয়ে দিয়েছেন কাতার সরকারকেই। পাশাপাশি তিনি এও বলেন যে, তাঁর দাদার ওপর নাকি হত্যার হুমকি আনা হয়েছিল।ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে এরিক বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন না তাঁর ভাই স্বাভাবিক কারণে মারা গিয়েছেন। বিশ্বাস করেন এটি পরিকল্পিত হত্যা। তাই এ বিষয়ে সবরকম সাহায্যের প্রার্থনা করেছেন তিনি নেটমাধ্যমে।

যদিও গ্রান্ট ওয়াহেল গত সোমবার একটি বিবৃতিতে লেখেন, তাঁর শারীরিক অসুস্থতার কথা। সেখানে তিনি জানান, গত তিন সপ্তাহ কম ঘুম, মানসিক চাপ এবং কাজের চাপে তিনি ভিতরে ভিতরে ভাঙছিলেন। তার ওপর অতিরিক্ত ঠান্ডার জেরে আরও খারাপ দিকে গড়ায়। এমনকী চিকিৎসকের দ্বারস্থও হন তিনি। ব্রঙ্কাইটিস হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হয় এবং প্রয়োজনীয় ওষুধও খেতে শুরু করেন তিনি। শুধু তাই নয়, সেই ওষুধ খাওয়ার পর যে তিনি ভালো বোধ করেছিলেন সেকথাও নিজেই স্বীকার করে গিয়েছেন ইতিমধ্যেই। ফলে এ ঘটনার আকস্মিকতা যতোই আমাদের চমকে দিক, যতোই আহত করুক, যতোই মনের কোণে রাগ জমুক কাতার সরকারের এই অনৈতিক আইনের জন্য, বিজ্ঞানের বলা স্বাভাবিক মৃত্যুর তকমাকে মেনে নিতেই হয়।

More Articles