উটে উঠলেই বিপদ! বিশ্বকাপে হু হু করে যে রোগ ছড়াচ্ছে কাতারে

FIFA World Cup 2022: কাতারে এখন টানটান উত্তেজনা। মাঠে-ময়দানে চূড়ান্ত লড়াই। তার মধ্যে এ কীসের অশনি সংকেত?

করোনা অতিমারির ভয়াবহতার পর এখন পৃথিবী নিউ নর্মাল পর্যায়ে। আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার দিকে সবাই। এরইমধ্যে মরুদেশে শুরু হয়েছে বিশ্ব ফুটবলের মহারণ। ফুটবল বিশ্বকাপ মানে কেবল ফুটবলার নয়, পৃথিবীর অনেক জায়গা থেকে বিশাল সংখ্যক মানুষ এসে ভিড় জমায় আয়োজক দেশে। কাতারেও তাই রীতিমতো উৎসবের মরসুম। ফুটবলের আনন্দ, সঙ্গে গোটা বিশ্ব একেবারে সামনে এসে হাজির। মরুবিজয়ের কেতন উড়িয়ে কোন দেশ বিশ্বকাপ জিতে ফেরে, সেটা তো ভবিষ্যতের বিষয়। তবে এখন অন্য বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে কাতার। সেইসঙ্গে চিন্তায় লাখ লাখ ফ্যান। সৌজন্যে, ক্যামেল ফ্লু…

কাতার তো বটেই, এই মুহূর্তে ফুটবলের পাশাপাশি এই বিশেষ রোগটিও চর্চার জায়গায়। এমনিতেই করোনার পর ডেঙ্গু, হামের মতো রোগ থাবা বসিয়েছে। ভারতও জেরবার এই সমস্যায়। তারইমধ্যে ক্যামেল ফ্লু নতুন করে চিন্তা বাড়িয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। চিন্তা বাড়িয়েছে ডাক্তারদেরও। তাই এখন থেকেই বারবার সতর্কবাণী আওড়াচ্ছেন তাঁরা।

কী এই ক্যামেল ফ্লু? কীভাবে ছড়ায়?

বলা ভালো, নামেই এর পরিচয়। ডাক্তারি পরিভাষায় এর নাম ‘মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম’, সংক্ষেপে ‘মের্স’। ২০১২ সালে মধ্য এশিয়ার দেশ সৌদি আরবের জেড্ডায় এই রোগের প্রথম সন্ধান মেলে। মূলত উট থেকেই এই ভাইরাসঘটিত রোগটি ছড়ায়। ক্যামেল ফ্লু-এ আক্রান্ত উটের সংস্পর্শে এলে সেই ভাইরাস মানুষের শরীরেও প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে সংক্রমণও বাড়তে থাকে। গবেষকরা বলছেন, ক্যামেল ফ্লু মূলত একপ্রকার জুনোটিক ভাইরাসের সংক্রমণ। সংক্রমিত উট কিংবা প্রাণীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংস্পর্শে এলেই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন : আপনার শরীরের প্রেমে পড়তে পারে মশারাও! ‘মশক চুম্বকে’র গবেষণায় মিলল অবিশ্বাস্য তথ্য

কতটা ভয়াবহ এই অসুখ?

আপাতত এই একটা প্রশ্নে চিন্তিত গবেষকরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র মতে, ক্যামেল ফ্লু নিয়ে এই মুহূর্তে চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ আছে। তার আজ্ঞে একটু পরিসংখ্যানের দিকে দেখা যাক। ২০১২-এ মের্সের সন্ধান পাওয়ার পর কেত এগিয়েছে গোটা একটা দশক। ২০২১-এর জানুয়ারি অবধি ২৫০০-এরও বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। ১০ বছরে মৃত্যু হয়েছে ৮৫৮ জনের। বিশ্বজুড়ে ২৭ টি দেশে নিজের থাবা বসিয়েছে এই ক্যামেল ফ্লু বা মের্স। পরিসংখ্যান আরও বলছে, কেবল এই বছরে আরবে এখনও পর্যন্ত ২৬০০ জনের দেহে এই ভাইরাসের সন্ধান মিলেছে। শতকরা হিসেবে এলে, এখনও অবধি এই রোগে মৃত্যুর হার প্রায় ৩৫ শতাংশ।

এ তো গেল পরিসংখ্যানের প্রসঙ্গ। হু বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, করোনা ভাইরাসের মতোই আচার আচরণ ক্যামেল ফ্লু-এর। ছদ্মবেশে ধরা দেয় আমাদের শরীরে। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, এই অসুখের প্রথম ও প্রধান লক্ষণ হল জ্বর, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট। যে কষ্ট পরে আরও বাড়তে থাকে। এছাড়াও ডায়ারিয়া, গ্যাস্ট্রিকের মতো সমস্যাও হতে পারে। আপাত দৃষ্টিতে দেখে সাধারণ অসুখ মনে হবে। অন্য রোগের সঙ্গেও গুলিয়ে যেতে পারে। ঠিক যে কাজটি করত করোনা ভাইরাসও।
এখানেই ভয় পাচ্ছেন চিকিৎসকরা। শরীর খারাপ হলে, জ্বর জ্বর ভাব কিংবা সর্দি-কাশি হলে আমরা অনেক সময় নিজেরাই ওষুধপত্র কিনে খেয়ে নিই। দেশ-কাল-সময় নির্বিশেষে মানুষের ধর্মই হয়তো এমন। তার ওপর এখন বিশ্বকাপের মরসুম। গবেষক ও চিকিৎসকদের ভয়, আনন্দ, উত্তেজনার মধ্যে হয়তো সেভাবে গুরুত্বও দেবে না সেখানকার মানুষ। ফলে কাতারেই এই রোগ মারাত্মক আকার নিতে পারে। উল্লেখ্য, হিসেব বলছে এই মুহূর্তে প্রায় ১২ লক্ষ মানুষ বিশ্বকাপ উপলক্ষে কাতারে আছেন। এই সংখ্যাটা গবেষকদের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘নিউ মাইক্রোবস অ্যান্ড নিউ ইনফেকশন’ নামের একটি জার্নালে এমন আশঙ্কার কথাই প্রকাশ করেছেন গবেষকরা।

আরও পড়ুন : এক লাখে চারজন আক্রান্ত! রোজের ওষুধের কুপ্রভাবেই দেখা যেতে পারে ভয়াবহ এই বিরল রোগ

তাহলে উপায়? কী করা যাবে?

হু জানাচ্ছে, এই রোগ থেকে পরিত্রাণের অন্যতম প্রধান উপায় হল উট পরিত্যাগ করা। উট থেকে দূরে থাকাই মঙ্গলজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। কেবল তাই নয়, উটজাত কোনও বস্তু দেখার আগে বা খাওয়ার আগে ভালো করে পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত। সতর্ক থাকাই সবচেয়ে ভালো উপায় বলে বলছেন চিকিৎসকরা। এদিকে এই মুহূর্তে এই রোগ প্রতিরোধের জন্য উপযুক্ত কোনও ভ্যাকসিনও আবিষ্কার হয়নি বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। তাই বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে এই ভাইরাস ও রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করছেন চিকিৎসকরা।

কিন্তু…

হ্যাঁ। শেষে এসে একটা ‘কিন্তু’ থেকে যাচ্ছে। রাজস্থান হোক বা মিশর, আরব, কাতার, মরু প্রদেশে বেড়াতে গেলে আমরা অনেকেই উটের পিঠে চড়তে পছন্দ করি। আজ উট ভ্রমণ ওই অঞ্চলের পর্যটন ব্যবসারও একটি বিশেষ অঙ্গ। বিশ্বকাপের মরসুমে যেখানে এত সংখ্যক পর্যটকদের আগমন, সেখানে এই ব্যবসা যে মহা তবিয়তে চলবে তা বলাই বাহুল্য। কাতারে তাই এই ব্যবসার চাহিদা তুঙ্গে। সমস্যাটা সেখানেই। এখনও পর্যন্ত এই পর্যটন বন্ধ হয়নি। সচেতনতা বাড়ানোর পরও চলছে উট ভ্রমণ। ব্যবসায়ীদের প্রসঙ্গকে অস্বীকার করা যায় না। এটা তাঁদের রুজি রুটি, এখান থেকেই সংসারে পয়সা আসে। তাই হঠাৎ এই মরসুমে ব্যবসা বন্ধ করে দিলে মুশকিলে পড়বেন। কিন্তু স্বাস্থ্যের দিকটাও তো খেয়াল রাখতে হবে। উট ব্যবসায়ীরা কি সেই খেয়াল রাখছেন? কাতার প্রশাসন, ফিফা বা অন্য কোথাও ক্যামেল ফ্লু প্রতিরোধ ও সচেতনতার জন্য কোনও বন্দোবস্ত এখনও চোখে পড়েছি। ভবিষ্যতে সেই ব্যবস্থা তারা করবে, সেই আশা নিশ্চয়ই দেখা যায়।

More Articles