বারবার আইনি নোটিশ, সত্যিই বিশ্বভারতীর জমি দখল করে রেখেছেন নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন?
Amartya Sen Visva-bharati University : তাঁর গবেষণা, কাজ আজও অনেক মানুষকে প্রভাবিত করেন। সেই অমর্ত্য সেনই নাকি জমি কেড়ে নিয়েছেন!
সব ঠিকঠাক থাকলে ২০২৩-র নভেম্বরে তিনি ৯০ বছর পূর্ণ করবেন। গোটা বিশ্বের কাছে ভারতের নাম উজ্জ্বল করেছেন তিনি। অর্থনীতি ও দর্শনের মানচিত্রে এক আলাদা জায়গা তৈরি করেছেন। তিনি কেবল শান্তিনিকেতন, প্রেসিডেন্সি, কলকাতার নন। তিনি ‘ভারতরত্ন’, অমর্ত্য সেন। তাঁর হাত ধরে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেখেছে এই দেশ। তাঁর গবেষণা, কাজ আজও অনেক মানুষকে প্রভাবিত করেন। সেই অমর্ত্য সেনই নাকি জমি কেড়ে নিয়েছেন! ‘জমি কব্জা’ করে রেখেছেন!
এমন অভিযোগই করেছে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। একবার নয়, বারবার সেই অভিযোগ সামনে আনা হয়েছে। খবরের শিরোনামে জায়গা পেয়েছে সেটি। শান্তিনিকেতনের ওই অঞ্চলেই রয়েছে অমর্ত্য সেনের বাড়ি ‘প্রতীচী’। সেই বাড়িতে তাঁর জন্ম, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নামকরণ করেছিলেন। তাঁর দাদু ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। মা অমিতা সেন ছিলেন খোদ রবি ঠাকুরের ছাত্রী। এই বাড়ি বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতনের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর সেই বাড়িটাই আজ বিশ্বভারতীর রোষে পড়েছে! কিন্তু, কেন?
আরও পড়ুন : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য! কেন এমনটা বললেন অমর্ত্য সেন?
২০২৩-র জানুয়ারিতে শান্তিনিকেতনে এসেছেন নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন। তারপরই ফের একটি নোটিশ পাঠানো হয়েছে বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ ডেসিম্যাল জমি (প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বর্গফুট) অমর্ত্য সেন দখল করে রেখেছেন। জমি মাপজোকের সময় সেই তথ্য পাওয়া গিয়েছে। অবিলম্বে সেই জমি ফেরত দেওয়ার কথা সেই নোটিশে বলা হয়েছে। এটাই অবশ্য প্রথমবার নয়। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বিশ্বভারতীর জমি দখল করে রয়েছেন, সেই কথা বারবার বলা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। এমনও বলা হয়েছে, রাজ্যের ভূমি সংস্কারের নিয়ম মেনে দুই তরফেরই প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে জমির মাপজোক নেওয়া হোক।
প্রতিবারই অমর্ত্য সেন বলেছেন, বিশ্বভারতীর এই দাবির কোনও ভিত্তি নেই। বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি ব্যবহার করেছেন ‘কল্পনাপ্রসূত’ শব্দটি। অমর্ত্য সেন বারবার বলেছেন, এই জমি তাঁর বাবা নিজে কিনেছিলেন। সামান্য কিছু অংশ বিশ্বভারতীর থেকে কেনা। প্রায় ৫০ বছর হয়ে গেল এই জায়গায় তাঁরা বসবাস করছেন। তাহলে হঠাৎ এখন কেন এই বিতর্কের সূত্রপাত? এতদিন তো কোনও কিছু হয়নি!
১৩ ডেসিম্যাল জায়গাটি আদতে কার, সেই বিতর্কে যাওয়ার অবকাশ নেই। কার জমি, সেটা অবশ্যই প্রমাণ সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু বেশকিছু জায়গায় একটু নজর দেওয়া দরকার। প্রথমত, অমর্ত্য সেন জমি দখল করে রেখেছেন, এই বিতর্ক ঠিক কবে থেকে শুরু হল? সত্যিই তো, আগে এই ব্যাপারে কিছুই শোনা যায়নি! রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সরাসরি ইঙ্গিত দিচ্ছেন বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর দিকে। ২০১৮ সাল থেকে তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। প্রায় সেই সময়ের পর থেকেই অমর্ত্য সেনের সঙ্গে জমি সংঘাতের শুরু। এছাড়াও বিশ্বভারতীর নানা বিষয় নিয়ে বারবার বিতর্ক তৈরি করেন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। অনেকেরই মত, তিনি নাকি একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ মেনে চলেন। রাজ্য সরকারের সঙ্গেও তাঁর সংঘাত অব্যাহত।
আরও পড়ুন : অভিজিৎ থেকে বিদ্যুৎ, উপাচার্য-ছাত্র সংঘাত অব্যাহত, সমস্যাটা কোথায়?
এর ঠিক উল্টোপিঠে দাঁড়িয়ে রয়েছেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। তিনি ভারতরত্ন, দেশকে সর্বোচ্চ জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন। অথচ তাঁকেই এখন শুনতে হয়, তিনি ভারতের জন্য কী করেছেন? সারাজীবন বিদেশে পড়ে থেকেছেন, আর দেশের নাম খারাপ করেছেন। যদি সত্যিই তাই হয়, তাহলে ‘ভারতরত্ন’ কী করে দেওয়া হল?
আর এই কথাগুলি আগে শোনা যায়নি। ২০১৪-র পর থেকে অমর্ত্য সেনকে ঘিরে যাবতীয় বিতর্কের জন্ম। কারণ? অধ্যাপক সেন ঘোষিতভাবে বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরোধী। প্রকাশ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন। বিজেপি সরকারের বিভিন্ন কাজ, নীতির সমালোচনা করেন। দেশের ইতিহাস বদলে দেওয়ার চেষ্টাকে তিরস্কারও করেন। সেজন্য বারবার গেরুয়া শিবিরের রোষানলে পড়েন তিনি। ‘বিজেপি এক হিন্দু ভারতের জন্ম দিয়েছে’ – অধ্যাপক সেনের এমন মন্তব্য ভালো চোখে নেননি বিজেপির শীর্ষ নেতারা।
তাই বারবার তাঁর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে গেরুয়া শিবির। কী এমন করেছেন অধ্যাপক সেন? বাইরে গিয়ে কেবল দেশের বদনাম করেছেন! তাঁর থেকে ভালো অর্থনীতি নাকি অনেকেই বোঝেন! এমন অনেক ‘বুলি’ আউরে থাকেন বিজেপি নেতারা। সম্প্রতি বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী উপাসনা গৃহে বলেছেন, আজকাল জমি কব্জাকারীরাও রাবীন্দ্রিক! ইঙ্গিত কার দিকে, সেটা নতুন করে বলে বোঝাতে হবে না। সেই বিরোধিতারই একটি অংশ এই জমি বিতর্ক? ইঙ্গিত তো সেদিকেই যাচ্ছে।