অভিজিৎ থেকে বিদ্যুৎ, উপাচার্য-ছাত্র সংঘাত অব্যাহত, সমস্যাটা কোথায়?

Vice Chancellor and Student Clash: পড়ুয়াদের গুলি মারার নিদান কি দিতে পারেন উপাচার্য? কোন পরিস্থিতিতে রাজ্যের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক?

‘ওদের গুলি করে মেরে দিন’। পুলিস, মন্ত্রী কিংবা কোনও গ্যাংস্টারের বক্তব্য নয়। এমন বক্তব্য খোদ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর। তাঁর তর্জনীর লক্ষ্য ওই প্রতিষ্ঠানেরই ছাত্রছাত্রীরা। এই মুহূর্তে এমন ছবির দিকেই নজর যাচ্ছে সবার। প্রতিবারই আতঙ্কিত হচ্ছি আমরা, তলিয়ে দেখার চেষ্টা করছি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাণের প্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা অবশ্য নতুন কিছু নয়। বারবার উপাচার্য-পড়ুয়া সংঘাত ঘটেছে সেখানে। শো-কজ ও সাসপেনশনের তির নেমে এসেছে অধ্যাপকদের একাংশের বিরুদ্ধে। কিন্তু পড়ুয়াদের গুলি মারার নিদান কি দিতে পারেন উপাচার্য? কোন পরিস্থিতিতে রাজ্যের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক?

আলোচনার আগে একটু তলিয়ে দেখা যাক বিশ্বভারতীর দিকে। বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী দায়িত্ব নেওয়ার বহুবারই সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় জায়গা হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। কখনও পড়ুয়াদের সঙ্গে গোলমাল, কখনও বিশ্বভারতীর অধ্যাপক সংগঠন ভিবিউফার সঙ্গে সংঘাত। পড়ুয়াদের অভিযোগ, এসবের জেরে বিশ্বভারতীতে শিক্ষার পরিবেশ নেই। এনিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনিও উপেক্ষা করেন। বুধবারও প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা বিদ্যুৎবাবুর সঙ্গে কথা বলতে যান। তখনই শুরু হয় কথা কাটাকাটি। যা এই মুহূর্তে নেট দুনিয়ায় ভাইরাল। উপাচার্যের নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গেও ধস্তাধস্তি হয় ছাত্রছাত্রীদের। ফলস্বরূপ, উপাচার্যের গুলি মারার নিদান এবং পড়ুয়াদের ঘেরাও অভিযান। টানা ১০ ঘণ্টা আটকে থাকার পর অবশেষে উপাচার্য বিদ্যুৎবাবু মুক্ত হয়েছেন বটে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে অনেক। বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, তিনি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের ধ্বজাধারী হয়ে চেয়ারে বসে আছেন। বিশ্বভারতী একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কাজেই এই ‘বিশেষ রাজনৈতিক দল’ বলতে যে গেরুয়া শিবিরকে বোঝাচ্ছে, তা আন্দাজ করা যায়। তাছাড়াও, বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরাসরি টোপ দাগতে দেখা গিয়েছে বিদ্যুৎবাবুকে। সাম্প্রতিক গরুপাচার ইস্যু নিয়েও মুখ খুলেছিলেন তিনি। তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে প্রায়শই বিবাদ চলে তাঁর। যিনিই উপাচার্য হন,তিনি একজন ব্যক্তিমানুষ। তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক মত অবশ্যই থাকতে পারে। কিন্তু বারংবার সেটা যখন একপাক্ষিক একটা পরিস্থিতিতে চলে যায়, তখন প্রশ্ন তোলার সুযোগ আসে বৈকি!

আরও পড়ুন : প্রমাদ গুণছেন স্বয়ং অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়! এসএসসি মামলার ভবিষ্যৎও কি ‘সারদা-নারদ’-এর মতোই?

শাসকের ধ্বজাধারী হয়ে কাজ করে যাওয়ার অভিযোগ অবশ্য নতুন নয়। বিশেষত রাজ্যের শিক্ষার মানচিত্রে এই প্রশ্ন কালে কালে বারবার সামনে এসেছে। বাম আমলে ‘অনিলায়ন’-এর প্রসঙ্গ আজও অনেকের মনে আছে নিশ্চয়ই। অবশ্য অতদূর যেতে হবে না। উপাচার্য-পড়ুয়া সংঘাতের ঘটনা কম ঘটেনি এই রাজ্যে। প্রায় এক দশক ধরে এমন বহু ঘটনাই আমাদের সামনে উঠে এসেছে। বহুবারই সামনে এসেছে শাসক দলের তল্পিবাহক হয়ে ‘কাজ’ করার অভিযোগ। পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে ‘হোক কলরব’-এর কথা। ২০১৪ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ঘটনায় উত্তাল হয়েছিল কলকাতা। উত্তাল হয়েছিল নেটিজেনরা। আন্দোলন শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির প্রতিবাদে। এরপর এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল পড়ুয়া। কিন্তু সেখানেই শুরু হয় সংঘাত। যাদবপুরের তৎকালীন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে শুরু হয় বাকবিতণ্ডা। পরে ২০১৪ সালেরই ১৬ সেপ্টেম্বর উপাচার্য-সহ কয়েকজন অধ্যাপককে ঘেরাও করে বিক্ষোভ শুরু করেন পড়ুয়ারা।

আরও পড়ুন : ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় পরিকল্পনা কি নির্বিরোধী যন্ত্র বানানোর কল? প্রশ্ন করতেই হবে

আন্দোলনের ঢেউ এবার অন্যদিকে মোড় নেয়। ওইদিনই মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে পুলিস ডাকেন উপাচার্য অভিজিৎ। অভিযোগ, পুলিসের সঙ্গেই বেশ কয়েকজন বহিরাগতও ওইদিন ঢোকেন, যারা শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক। এরপরই আন্দোলনরত পড়ুয়াদের ওপর লাঠিচার্জ করা হয়। এমন ঘটনায় রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায় রাজ্যে। শুরু হয় ‘হোক কলরব’-এর সমর্থনে প্রতিবাদ মিছিল। তৎকালীন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা করেন। অবশ্য বহিস্কার তো দূরের কথা, একমাস গড়াতে না গড়াতেই অভিজিৎবাবুকে অস্থায়ী উপাচার্য থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী উপাচার্য করা হয়। এটাই কি ছিল তাঁর ‘পুরস্কার’?

শাসক ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ ওঠে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়েও। তির ছিল উপাচার্য ডঃ অনুরাধা লোহিয়ার দিকে। ঘটনার সূত্রপাত ২০১৫ সালে। প্রেসিডেন্সির সমাবর্তনের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে অনুদানের চেক তুলে দেন তিনি। মঞ্চে উঠে খোদ উপাচার্য লোহিয়াদেবীকে ‘নতমস্তকে’ সেই উপঢৌকন নিতে দেখা গিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্সি একটি স্বশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে পড়তে গেলে নির্দিষ্ট নিয়মে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে হয়। তারপর যোগ্য পড়ুয়ারা পড়ার সুযোগ পান। পড়াশোনা, পরীক্ষা থেকে প্রতিষ্ঠান সামলানো, কোনও ব্যাপারেই রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না। সেটাই ছিল সংস্কৃতি। তাহলে কেন নতমস্তকে বারবার সরকারের সামনে ঝুঁকে পড়া? সেদিন এমনই দাবি তুলেছিলেন প্রেসিডেন্সির ছাত্রছাত্রীরা। ওইদিন মুখ্যমন্ত্রীর সামনেই তাঁরা বিক্ষোভ দেখান। সেই সময় পুলিসের সঙ্গেও চলে ধস্তাধস্তি। পড়ুয়াদের দাবি ছিল, স্বশাসিত একটি প্রতিষ্ঠানে অনুদান দেওয়ার জন্য কেন মুখ্যমন্ত্রী আসবেন? উপাচার্যের বক্তব্য ছিল, মুখ্যমন্ত্রী নিজেই আসতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়াই তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন : তৃণমূল মানেই কি আর্থিক কেলেঙ্কারি? এক দশকে যা দেখলাম আমরা

এরপরও একাধিকবার প্রেসিডেন্সির উপাচার্যের বিরুদ্ধে শাসক ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ ওঠে। এই সুরই শোনা যায় প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন উপাচার্যদের গলায়। কেন বারবার একই ঘটনা ঘটছে রাজ্যজুড়ে? কখনও রাজ্য সরকার, কখনও কেন্দ্র- এই অদ্ভুত যুযুধানের অংশীদার হচ্ছে শিক্ষক মহল। অথচ ছোট থেকে এমন ছবি তো আমরা দেখিনি। উপাচার্য মানে তিনি প্রতিষ্ঠানের প্রধান, পাশাপাশি একজন শিক্ষকও। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক নিয়ে নানা গল্পকথা পড়ে এসেছি আমরা। ধুতি বা পাজামা পরা, মলিন বেশভূষার সেই শিক্ষকদের আমরা ভয় পেতাম, শ্রদ্ধা করতাম। ঘেরাও, পাল্টা তর্ক, গুলি মারার নিদান- এসব তো অনেক দূর জগতের বস্তু ছিল। তাহলে কি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে যে বিশ্বাসটা লুকিয়েছিল, সেটা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে?

আরও পড়ুন : কত শিশু ঘুরছে ভারতের রাস্তায়? পৃথিবীর বৃহত্তম শিক্ষাব্যবস্থায় অবাক করবে যে তথ্য

শেষ বক্তব্যটির স্বপক্ষে অনেক তথ্যও দেওয়া যায়। তথ্য থাক, একটু প্রতিদিনের খবরের দিকে আমরা চোখ বোলাই। নিজের এলাকার স্কুল-কলেজগুলোকে দেখি। তাহলেই বুঝতে পারব, আসল ফাঁকটি কোথায়। কেন এই বিশ্বাস বারবার ভেঙে যাচ্ছে। ছাত্র রাজনীতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এর ইতিহাসও বহু দীর্ঘ। তবে তার সঙ্গেও জড়িয়ে থাকে একটা শিক্ষা, থাকে যুক্তিবোধ, শ্রদ্ধা বিনিময়। সেখানে জড়িয়ে থাকে শিক্ষার অধ্যাবসায়ও। কিন্তু সেই শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর যখন কেবল ও কেবলমাত্র ক্ষমতার রাজনীতি, প্রভাব বিস্তারের আস্ফালন খেলা করে, তখন সবকিছুই ধুয়েমুছে যায়। ক্ষমতার রাজনীতি, ক্ষমতার আস্ফালন, দাবিয়ে রাখার নীতি কোনওদিনই শিক্ষা মানেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যেতে হবে না, সামান্য স্কুল, কলেজে গেলেই দেখতে পারবেন সেই দম্ভ। পরিচালন কমিটি থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ – সবেতেই এখন দুর্নীতির ছায়া দেখতে পাই আমরা। দেখতে পাই শাসন করার ‘গর্ব’। সে কারণেই আরাবুল ইসলামের মতো নেতারা শিক্ষকদের জগ ছুঁড়ে মারার নিদান দেন। ধীরে ধীরে সেই শিক্ষা, শিক্ষকদের ভাষাও শাসকের মতোই হয়ে যায়। ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনীতি তাঁদেরও শাসক ঘনিষ্ঠ করে তোলে। বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, অভিজিৎ চক্রবর্তীরা আজকের পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতে দাঁড়িয়ে কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি নন। ক্ষমতার ভাষ্যই সেই মঞ্চটা তৈরি করেছে। আক্ষেপ, হয়তো সেই কারণেই হারিয়ে যাচ্ছে পুরনো দিনের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কগুলি। হারিয়ে যাচ্ছে বিশ্বাস। তাই তো একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছি বারবার।

More Articles