কী ভাবে তৈরি হল কোভিড ভাইরাস ডেল্টাক্রন? কতটা ক্ষতিকর নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট?

ফেব্রুয়ারি মাসে ওয়াশিংটনের পাব্লিক হেল্থ ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী স্কট ন্যুয়েন করোনা ভাইরাসের আন্তর্জাতিক জিনোমের ডেটাবেস পরীক্ষা করছিলেন। সোজা কথায় বোঝালে এখনও অবধি যত রকমের করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে, তাদের প্রত্যেকের জিনের গঠন কীরকম, তারই বিস্তারিত তথ্য আছে এই ডেটাবেসে। পরীক্ষা চলাকালে উনি হঠাৎ খেয়াল করেন, ফ্রান্সে এই বছরেই জানুয়ারি নাগাদ সংগ্রহ করা কিছু নমুনাতে নোভেল করোনাভাইরাসের ডেল্টা এবং ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের মিশ্রণ রয়েছে। দেখা যাচ্ছে যখন কেউ এই দুই ভ্যারিয়েন্টের দ্বারাই আক্রান্ত হন, তখনই এমন মিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায় - অন্তত প্রাথমিক ভাবেই এই রকমই সিদ্ধান্তে আসেন গবেষকরা। কিন্তু গভীর ভাবে জেনোমিক ডেটা খুঁটিয়ে দেখতেই ন্যুয়েন বুঝতে পারেন, প্রাথমিক ভাবে গবেষকরা ভুল বুঝে  এই রকম দাবী করেছিলেন যে স্যাম্পেলে ওমিক্রন ও ডেল্টার মিশ্রণ আছে।

তাহলে আদতে কী ঘটেছে? ন্যুয়েন প্রত্যেকটি ভাইরাস স্যাম্পেল আলাদা আলাদা করে পরীক্ষা করে দেখেন, একই ভাইরাসে ওমিক্রণ এবং ডেল্টা দুই ভ্যারিয়েন্টেরই জিন উপস্থিত আছে। অর্থাৎ ডেল্টা এবং ওমিক্রণ, এই দুইয়ের জিনই মিলিত হয়ে একটি নতুন নোভেল করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টের জন্ম দিয়েছে। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এই ঘটনাকে বলে জিন রিকম্বিনেশন। আর যেহেতু দুই ভ্যারিয়েন্টেরই জিন উপস্থিত আছে, তাই এদের নাম দেওয়া হয়েছে ডেলমাইক্রন বা ডেল্টাক্রন।

ন্যুগেন নিউ ইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন, ডেল্টা ও ওমিক্রনের জিন রিকম্বিনেশনের ঘটনার সূত্রপাত মূলত নেদারল্যান্ড ও ডেনমার্কেই। এর পাশাপাশি ন্যুগেন কোভ- লিনিয়েজ নামের একটি অনলাইন ফোরামে নিজের নতুন এই অবিষ্কারের কথা উল্লেখও করেছেন। এখানে উল্ল্যেখ্য, কোভ- লিনিয়েজ ফোরামটিরে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা একে-অপরকে নতুন কোভিড ভ্যারিয়েন্ট চিহ্নিত করতে সাহায্য করেন।

ডেলমাইক্রন বা ডেল্টাক্রন যে আসলে ডেল্টা এবং ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের জিনের রিকম্বিনেশনের ফলেই তৈরি তা নিশ্চিত করেছেন প্যারিসের পাস্তুর ইনস্টিটিউটের ভাইরোলজিস্ট এটিয়েন সাইমন- লরিয়ের। এবং অবশেষে গত ৮ ই মার্চ কোভিড জিনোমের আন্তর্জাতিক ডেটাবেসে ডেলমাইক্রন বা ডেল্টাক্রনের জিনের পূর্ণ গঠন নথিভুক্ত করা হয়।

ড: এটিয়েন সাইমন- লরিয়ের, নিউ ইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন নতুন ভ্যারিয়েন্ট ডেলমাইক্রন বা ডেল্টাক্রনকে নিয়ে নতুন করে চিন্তার কিছু নেই, এবং এরা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ওমিক্রনের মতই। অর্থাৎ ওমিক্রনের মতই দ্রুত ছড়ালেও, রোগের প্রকোপ খুব বেশি হবে না। এবং ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের জিন থাকলেও, ডেল্টার মত আগ্রাসী এবং ক্ষতিকর এই ভ্যারিয়েন্ট নয়।

এর কারণ বিশদে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ড: সাইমন জানাচ্ছেন, করোনাভাইরাসের বাইরে কাঁটার মত দেখতে স্পাইক প্রোটিন থাকে। ডেল্টাক্রন বা ডেলমাইক্রনের ক্ষেত্রে সেই স্পাইক প্রোটিন গঠনের জন্যে দায়ী ডেলমাইক্রনে উপস্থিত ওমিক্রন থেকে আসা  জিন। তাই ওমিক্রন ও ডেলমাইক্রনের স্পাইক প্রোটিনের গঠন একই হবে। এই স্পাইক প্রোটিনই নোভেল করোনাভাইরাসকে সাহায্য করে আমাদের শরীরের কোশে প্রবেশ করার সময়, তাই এই প্রোটিনের গঠনের উপরই নির্ভর করে আছে কত দ্রুত ছড়াবে এই ভাইরাস। সুতরাং বলার অপেক্ষা রাখে না, ডেল্টাক্রন বা ডেলমাইক্রনের আক্রমণ করার ক্ষমতা ওমিক্রনের মতই হবে।

অন্যদিকে নতুন ভ্যারিয়েন্টের বাদবাকি অংশ গঠন নিয়ন্ত্রণ করে, এর মধ্যে উপস্থিত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে আসা জিনের অংশ।

এই সব কারণেই স্পাইক প্রোটিনের গঠনের কথা মাথায় রেখেই ভ্যাক্সিনের রাসায়নিক নকশা বানানো হয়, যাতে যে গঠনকে অস্ত্র করে ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে, সেই অস্ত্রের বিরুদ্ধেই লড়তে পারে ভ্যাক্সিন।

ওমিক্রন খুব সহজে নাক এবং শ্বাসনালির উপরের অংহ আক্রমন করলেও, সহজে ফুসফুস অবধি পৌঁছতে পারে না। এর দৌড় নাক থেকে গলা অবধি, বা খুব বেশী হলে গলার সামান্য নীচের অংশ। অবশ্য শ্বাসজনিত অসুখ থাকলে আলাদা কথা। গবেষকদের ধারণা ডেলমাইক্রনকে নিয়েও তাই এখনই  বিশেষ ভয় পাওয়ার কারণ নেই।

তবে নেচারে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়, শিশুদের ক্ষেত্রে ওমিক্রনের প্রভাব ভিন্ন হতেই পারে। যেহেতু তাদের শ্বাসনালির দৈর্ঘ্য প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় কম, তাই ওমিক্রন সহজে পৌঁছে যায় ফুসফুসে। অবশ্য ডেলমাইক্রন বা ডেল্টাক্রন শিশুদের কী ভাবে প্রভাবিত করবে তা এখনও অজানা।

ওমিক্রন ও ডেল্টার জিনের মিলন বা রিকম্বিনেশন হতে পারে? গবেষকদের ধারণা, জনবহুল এলাকায় তো সব রকম ভ্যারিয়েন্টই একসাথে থাকতে পারে। দেখা গেল এই ভীড়ে মিশে থাকা কেউ, এই দুই ভ্যারিয়েন্ট দ্বারাই আক্রান্ত হল। তাঁর শরীরে দুই ভ্যারিয়েন্ট প্রবেশ করলে তখনই ঘটতে পারে দুটি আলাদা আলাদা ভ্যারিয়েন্ট থেকে আসা জিনের মিলন। যদিও রিকম্বিনেশনের  সম্ভাবনা খুবই স্বল্প, এমনই দাবি করছেন ড: সাইমন।

খুব সম্প্রতি ফ্রান্সের একদল গবেষক দাবি করেন ডেল্টা এবং ওমিক্রনের জিন রিকম্বিনেশনে তৈরি নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের অদ্ভুত কিছু নাম দেন এবং দাবি করেন এগুলি গবেষণাকারে কৃত্রিম ভাবে বানানো। ড: ন্যুগেন জানান এই ভ্যারিয়েন্ট আদৌ ল্যাবে তৈরি করা হয়নি।

More Articles