লাসসা জ্বর কতটা ভয়ানক? জেনে নিন এই রোগের লক্ষণগুলি...

করোনা অতিমারীর প্রকোপ শুরু হতেই বিশ্বের নানাপ্রান্তে এমন কিছু ভাইরাসের মধ্যে খোঁজ মিলেছে যা অনায়েসেই হতে পারে আরও এক মহামারীর কারণ। সদ্য আফ্রিকায় হদিশ মিলেছে তেমনই এক ভাইরাসের। ইতিমধ্যেই সে দেশে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে ' লাসা ভাইরাস'। নাইজেরিয়ার এক শহরের নামেই এই ভাইরাসের নাম দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এখনও পর্যন্ত ৪০০-রও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন লাসসা জ্বরে।তবে এই সংখ্যাটা বাস্তবে কয়েক হাজার বলেই মনে করছেন চিকিসকেরা।শুধু আফ্রিকাতেই এখনও পর্যন্ত  এই জ্বরে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৭০ জনের। সিরিয়ার দা ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের দেওয়া এই তথ্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরায় প্রকাশ পেয়েছে।

তবে শুধু আফ্রিকা নয় যুক্তরাজ্যেও তিনজন ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন এই জ্বরে। এর মধ্যে একজনের মৃত্যুও হয়েছে গত ১১ ফেব্রুয়ারি।চলুন জেনে নেওয়া যাক এই ভাইরাসের সাতসতেরো-

লাসসা জ্বর কী ?

নাইজেরিয়ার দ্য সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড পলিউশন অনুসারে, ১৯৬৯ সালে প্রথম নাইজেরিয়ার লাসা শহরে এই ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া যায়।এটি একধরনের রক্তক্ষরণজনিত রোগ। লাসা ভাইরাসের কারণে মানুষের শরীরে যে জ্বর হয় তার মূল বাহক ইঁদুর। পশ্চিম আফ্রিকার অন্ডো,বাদুনা, ডেল্টা, গিনিয়া, ঘানা প্রদেশের কয়েকশো মানুষ এই জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন।তবে এখনও এন্ডেমিক অবস্থাতেই রয়েছে সংক্রমণ।  

কীভাবে মানুষের ছড়িয়ে পড়তে পারে এই সংক্রমণ?

লাসা ভাইরাসে আক্রান্ত ইঁদুরের লাল , প্রস্রাব এবং মলের সংস্পর্শে এলে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে এই ভাইরাস।কিছু ক্ষেত্রে খাদ্যবস্তু বা অন্যান্য কোনো ব্যবহার্য জিনিস সংক্রমিত ইঁদুরের সংস্পর্শে এলেও মানুষের শরীরের সঞ্চারিত হতে পারে এই  রোগের ভাইরাস।

মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের সম্ভাবনা

আক্রান্ত ব্যক্তির মলমূত্র কিংবা শারীরিক যেকোনো ধরনের তরল পদার্থের সংস্পর্শে এলে অন্য ব্যক্তির মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। এছাড়া আলিঙ্গন, হ্যান্ডশেক বা সংক্রামিত ব্যক্তির কাছে গেলেও এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে সুস্থ মানুষের দেহে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এই ভাইরাস পরীক্ষারগার থেকেও মানবদেহে সঞ্চারিত হতে পারে।

লক্ষণগুলি কী?

লাসসা জ্বরের উপসর্গগুলির সাথে করোনার উপসর্গের অনেকটাই মিল রয়েছে। চিকিৎসক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এর সাথে ইবোলার কিছু মিলও খুঁজে পেয়েছেন।

ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার এক থেকে তিন সপ্তাহ পরে ব্যক্তির দেহে বিভিন্ন  লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়। জ্বর, মাথাব্যথা, গলা ব্যথা, বমি ও ডায়রিয়ার মত উপসর্গ দেখা যায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে। গুরুতর ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট,বুকে ব্যথা, পেশীতে ব্যথার মত লক্ষণগুলিও দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তির মুখ ফুলে উঠতে পারে।মুখ,নাক বা যৌনাঙ্গ থেকেও রক্তপাতও ঘটতে দেখা গেছে অনেকের ক্ষেত্রে। লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার দু - তিন সপ্তাহের মধ্যে ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে। মূলত মাল্টি অরগান ফেইলিওরের কারণে ব্যক্তির মৃত্যু হয়।

চিকিৎসা

এখনো পর্যন্ত লাসসা জ্বরের চিকিৎসার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ বা ভ্যাকসিন নেই।২০১৯ সালে দুটি ভ্যাকসিন প্রথম ধাপের ট্রায়ালের জন্য আনা হয়েছিল।সেগুলির ট্রায়াল এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয়নি।

তবে সাধারণত এ জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ৬ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে,লাসসা জ্বরে আক্রান্ত হলে অবহেলা না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। রিভাভিরিন এন্টিভাইরাল নামক একটি প্রতিষেধক এই জ্বরে ভালো কাজ করে।

রোগের পরবর্তী প্রভাব 

সংক্রমণ থেকে সেরে উঠলেও বিভিন্ন মাত্রার বধিরতার সমস্যা দেখা গিয়েছে অনেকের ক্ষেত্রে। প্রতি তিন আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে একজনের মধ্যে বধিরতার সমস্যা ধরা পড়েছে। চিরকালের মতোও শ্রবণশক্তি হারিয়ে গেছে অনেকের।

চিন্তার বিষয়

মাত্র ১ শতাংশ রোগীদের ক্ষেত্রেই এই ভাইরাস মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। রোগীদের হাসপাতালেও ভর্তি করতে হয় এবং ভর্তি রোগীদের ১৫ শতাংশের মৃত্যু হতে পারে। তবে  ৮০ শতাংশ রোগীর দেহেই এর কোনো লক্ষণ দেখা যায় না ফলে সঠিক চিকিৎসাও হয়না।ইউরোপীয় সেন্টার ফর দিসিজ প্রিভেনশন এন্ড কন্ট্রোল অনুসারে কিছু কিছু মানুষের জন্য এই ভাইরাস মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই এই রোগ মারাত্মক রূপ নেয়।

আফ্রিকার সবচেয়ে জনবহুল দেশ নাইজেরিয়ায় মাত্র পাঁচটি ল্যাবরেটরিতে এ মুহূর্তে এই রোগ সনাক্তকরণের পরীক্ষা চালানো হচ্ছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

More Articles