কেন বেছে বেছে ১৩-তেই অভিষেককে ডাকল ইডি
Opposition Meet in Delhi, Abhishek Banerjee: তবে ইন্ডিয়া জোটের এমন জরুরি বৈঠককে দুর্বল করতে যে আগে থেকেই জল মেপেছে বিজেপি, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি-র এদিনই অভিষেককে ডাকার মধ্যে তেমনই ষড়যন্ত...
বিজেপিকে হঠাতে একজোট বিরোধীরা। একার শক্তিতে যে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না, তা গত কয়েক বছরে ভালোই বুঝেছে দেশের বিরোধী শক্তিরা। অগত্যা একতাই বল। শেষপর্যন্ত বিজেপিকে হঠাতে এককাট্টা দেশের প্রায় সবকটা বিরোধী শক্তি। জোটের নামও জোরালো। এমনই জোরালো, যে বিরোধী জোটের মনোবল কমাতে দেশের নামই পাল্টে দিতে চাইছে বিজেপি সরকার। সেই ইন্ডিয়া জোটের সমন্বয় ও নির্বাচনী রণকৌশল কমিটির প্রথম বৈঠক ১৩ সেপ্টেম্বর, বুধবার। এদিকে সেই বৈঠকেই থাকছে না জোটের প্রধান দুটি দল তৃণমূল কংগ্রেস ও সিপিএম। তাঁদের কোনও প্রতিনিধিই এই বৈঠকে হাজির থাকছেন না। থাকবেনই বা কী করে! তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১২ দিনের বিদেশ সফরে দুবাই হয়ে স্পেনে। আর দলের অন্য কাণ্ডারি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যস্ত এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেটের প্রশ্নের উত্তর দিতে।
ইন্ডিয়া জোটের প্রথন কো-অরডিনেশন কমিটির বৈঠকের দিনেই ইডি দফতরে অভিষেক- এই দুই ঘটনার মধ্যে সাদা চোখে কোনও যোগ নেই বলে মনে হলেও সত্যি কি তাই! সত্যিই কি এই দু'টি ঘটনা একেবারে সম্পর্কহীন? ভাবাচ্ছে রাজনৈতিক অভিজ্ঞদের।
ইডি-র দফতরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, এই ঘটনার সঙ্গে বাংলার মানুষ যথেষ্ট ধাতস্থ। কারণ এমন ঘটনা প্রায়শই ঘটে। কখনও সিজিও কমপ্লেক্স, তো কখনও দিল্লিতে ইডি-র অফিসে হাজিরা দিতে ছুটতে হয় অভিষেককে। কখনও কয়লা কেলেঙ্কারি মামলা, তো কখনও নিয়োগদুর্নীতি, ডাক পড়তেই থাকে অভিষেক-সহ একাধিক তৃণমূল নেতার। বুধবার ফের স্কুল নিয়োগ সংক্রান্ত মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অভিষেককে ডেকে পাঠায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট। হাজিরা এড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক। তবে সেই চেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়ে। বুধবার কড়া নিরাপত্তায় মুড়ে ইডি-র দফতরে পৌঁছতেই হয় তৃণমূল কংগ্রেসের সহ-অধিনায়ক অভিষেককে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ইন্ডিয়া জোটের কো-অর্ডিনেশন কমিটির বৈঠকে যাওয়া হয়নি তাঁর। আর এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের মতো জরুরি জোট সদস্যকে ছাড়াই পরবর্তী দিকরেখা ঠিক করতে হচ্ছে জোট ইন্ডিয়া তথা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স-কে।
আরও পড়ুন: এনডিএ বনাম ইন্ডিয়া, দেশের নামে বিজেপির আসন টলাতে পারবে কি বিরোধী মহাজোট?
একদিকে এনডিএ জোট, অর্থাৎ কিনা বিজেপি ও তার শরিক দলগুলি, অন্যদিকে ইন্ডিয়া অর্থাৎ বিরোধী জোট, কার দিকে পাল্লা বেশি ভারী, তা বোঝা এই মুহূর্তে কঠিন। যদিও জোট ইন্ডিয়ার লাগাম অনেকটাই রয়েছে কংগ্রেস ও এনসিপি-র হাতেই। জাতীয় দলের মর্যাদা ধরে না থাকতে পারায় কিছুটা হলেও গুরুত্ব হারিয়েছে তৃণমূল। তার উপরে নেই স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। মুখে যা-ই বলা হোক না কেন, আজও তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতাকে ছাড়া যে তৃণমূল অচল, তা কিন্তু এই সব সময়ে বেশ ভালোই মালুম করা যায়।
এদিন কো-অর্ডিনেশন কমিটির বৈঠকে জোট ইন্ডিয়া-র শরিক দলগুলির মধ্যে আসন বণ্টনের ব্যপারে আলোচনা হওয়ার কথা, যেখানে তৃণমূলের থাকাটা অত্যন্ত জরুরি ছিল। এদিকে অজ্ঞাতকারণে সিপিএমের থেকেও কোনও প্রতিনিধি থাকছেন না আজকের বৈঠকে। এদিকে এদিনই নির্বাচনী প্রচার ও জনসভা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা রয়েছে জোট ইন্ডিয়ার বৈঠকে। গত সপ্তাহেই মুম্বইয়ে ইন্ডিয়ার বৈঠকে এই বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছিল। এদিন বৈঠক হওয়ার কথা প্রবীণ এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ারের বাড়িতে। খাতায় কলমে এটাই জোট ইন্ডিয়ার প্রথম কো-অর্ডিনেশন কমিটির বৈঠক।
এদিনের বৈঠকে তৃণমূলের তরফে কোনও প্রতিনিধির না-থাকাটা জোটে তৃণমূলের অবস্থানের উপর সওয়াল তো বটেই। তবে প্রাথমিক ভাবে দলের শীর্ষনেতৃত্ব ঠিক করেছিল, দলের তরফে অন্য কেউ বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন। তবে জোট ইন্ডিয়ার এমন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অন্য কাউকে পাঠালে কমিটির গুরুত্ব লঘু করা হবে বলে মনে করে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে দল। যার থেকে ফের স্পষ্ট হয়ে গেল, এই মুহূর্তে মমতা এবং অভিষেক ছাড়া তেমন কেউ-ই নেই, যে বা যাঁরা দলের হাল ধরতে পারে।
তবে রাজনৈতিক অভিজ্ঞরা মনে করছেন, এতটাও জলবৎতরলং নয় ব্যাপারখানা। যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করেই দান সাজিয়েছে তৃণমূল। ইতিমধ্যেই তৃণমূলের তরফে অনুপস্থিত থাকার বিষয়টি কংগ্রেস নেতা কে সি বেণুগোপাল ও এনসিপি-র শরদ পওয়ারকে জানানো হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, অভিষেককে ইডির সমন পাঠানো এখন আর শুধুমাত্র তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নয়। একই সঙ্গে জোট ইন্ডিয়ার সদস্যের বিরুদ্ধে পদক্ষেপও বটে। ফলে এই পরিস্থিতিতে অভিষেক ও তদুপরি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিই সহানুভূতি থাকবে জোট তথা দেশের বিরোধী দলগুলির। ফলে প্রতিহিংসার রাজনীতির অভিযোগ ছাপা বল মোদি সরকারের কোর্টে ঠেলা অনেকটাই সহজ হবে তৃণমূলের পক্ষে।
তবে জোট ইন্ডিয়া-র সঙ্গেও পুরোপুরি মনের মিল যে তৃণমূলের হচ্ছে, তা-ও নয়। তৃণমূল চায়, যত শীঘ্র সম্ভব, আসন বণ্টন নিয়ে অস্পষ্টতা কাটুক। নিজেরা অনুপস্থিত থাকলেও এদিনের বৈঠকে সেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে যাক এমনটাই প্রত্যাশা করছে তৃণমূল । এদিকে, এখনও দলের কমিটিতে থাকবে কোন কোন প্রতিনিধি, তা ঠিকই করে উঠতে পারেনি সিপিএম। এদিকে কংগ্রেসও শরিক দলের আসনভাগ নিয়ে ঢিলেমি দেখাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে খানিকটা আষাঢ়ে মেঘ দেখছে তৃণমূলও। তৃণমূল সূত্রের দাবি, অধিকাংশ রাজ্যেই বিরোধী শিবিরে বোঝাপড়া রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি ও পঞ্জাবে জট রয়েছে। তার কারণ কি কংগ্রেস ও কংগ্রেস সমর্থিত দলগুলির ক্ষমতায় না থাকা! খেয়াল করলে দেখা যাবে, এর মধ্যে দিল্লি ও পঞ্জাবে ক্ষমতায় রয়েছে আপএবং বাংলায় তৃণমূল। এই দু'টি দলের সঙ্গেই কংগ্রেসের বনিবনা তেমন ভালো না। অন্তত এতদিন তেমনটাই ঠাওর হয়েছে।
এদিকে, ইন্ডিয়া জোটের মুখ হিসেবে কি মমতাকেই চাইছে দেশ। দেশ চাইছে কিনা বোঝা কঠিন, তবে প্রতিবেশী দেশগুলির কাছে যে তেমনই বার্তা যাচ্ছে, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে এদিন মমতা বন্দ্যাপাধ্যায়ের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমসিঙ্ঘের সৌজন্যসাক্ষাতে। প্রথা মেনে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরে রনিল আচমকাই প্রশ্ন করে বসেন, "আপনিই কি বিরোধী জোটকে নেতৃত্ব দিতে চলেছেন?" যদিও এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য হেসে উড়িয়েছেন মমতা বন্দ্যাপাধ্যায়। তবে এই আপাত কথোপকথন যে তৃণমূলের পালে হালকা হাওয়া লাগিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন: খোদ উত্তরপ্রদেশেই ইন্ডিয়ার কাছে হেরে ভূত বিজেপি! কেন এই শোচনীয় হার?
তবে ইন্ডিয়া জোটের এমন জরুরি বৈঠককে দুর্বল করতে যে আগে থেকেই জল মেপেছে বিজেপি, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি-র এদিনই অভিষেককে ডাকার মধ্যে তেমনই ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা। মোদি বিরোধী হাওয়া এবং ইন্ডিয়া জোট, কোনওটা নিয়েই যে তেমন স্বস্তিতে নেই বিজেপি, তা তো গোড়া থেকেই স্পষ্ট। এমনকী দেশের নামের সঙ্গে বিরোধী জোটের নামের মিল থাকায় 'ইন্ডিয়া' নাম পাল্টে 'ভারত' রাখতে উঠেপড়ে লেগেছে বিজেপি। জি-২০ বৈঠকের আমন্ত্রণপত্র থেকে বৈঠক চলাকালীন প্রধানমন্ত্রীর নেমপ্লেটেও সেই ছবিই দেখেছে দেশ। এমনকী মৌখিক ভাবেও নিজেকে 'প্রাইম মিনিস্টার অব ভারত' বলে পরিচয় দিয়েছেন মোদি। এত কিছুর পরে আবার জোট ইন্ডিয়ার বৈঠকের দিনেই তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তলব। গোটা ব্যাপারটার মধ্যে বিজেপির টলোমলো আত্মবিশ্বাসই দেখছে ওয়াকিবহাল মহল। যদিও দিন কয়েক আগেই ইডি-র বিরুদ্ধে এ নিয়ে তোপ দেগেছিলেন অভিষেক। ইডি-র তদন্তের সাফল্যহার মাত্র ০.০৫ শতাংশ বলে উল্লেখ করে এই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার গতিপ্রকৃতি হাস্যকর বলে দাবি করেন অভিষেক। বলেন, "মানুষের করের টাকায় বছরের পর বছর তদন্ত করেও কোনও প্রমাণ জোগার করতে পারছেন না ইডির আধিকারিকরা। সংবাদমাধ্যমের সামনে গল্প বানানো হচ্ছে।" বহুক্ষেত্রেই কেন্দ্র সরকার নিজেদের রাজনৈতিক কাজে ইডিকে ব্যবহার করছে বলেও তোপ দাগেন তিনি। বুধবার অভিষেককে ইডি-র দফতরে ডাকার পিছনে কেন্দ্র তথা বিজেপি সরকারের তেমন কোনও অভিঃসন্ধি যে নেই, সেই সম্ভাবনাও কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছেন না রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা।