কোন মারাত্মক অভিযোগের জেরে বিপুল জরিমানার মুখে গুগল

Google Lawsuit: মোবাইলের মালিকানা আপনার হতে পারে, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনি ক্ষমতাহীন।

No one ever makes a billion dollars. You take a billion dollars.
-Alexandria Ocasio-Corte

মার্কিন এই রাজনীতিবিদ এই কথাটা বলেছিলেন এক সম্মেলনে। যদিও বক্তব্যটি ধনকুবের শিল্পপতিদের উদ্দেশে, কোনও সংস্থার উদ্দেশে নয়, কিন্তু শিল্পপতিরা ধনকুবের হন তাদের ফুলে-ফেঁপে ওঠা ব্যাবসার মাধ্যমেই। মজার বিষয় হলো, যে 'Multi billion dollar' সংস্থাগুলি শিল্পবিপ্লবের পর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবী শাসন করে এসেছে, তার মধ্যে একটিও সংস্থা নেই, যার গায়ে কাদার দাগ লাগেনি। কোনও না কোনও অভিযোগে তারা বিদ্ধ হয়েছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই সমস্ত অভিযোগ সঠিক প্রমাণ হয়েছে। তবে এটাই কি ধনতন্ত্রের সবথেকে বড় ব্যর্থতা? না কি এটাই ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার প্রথাসিদ্ধ আচরণ?

কম্পিটিশন কমিশন অফ ইন্ডিয়া ২০ অক্টোবর পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম প্রযুক্তি সংস্থা গুগলকে ১,৩৩৭.৭৬ কোটি টাকা জরিমানা করেছে। গুগলের অপরাধ? অনৈতিক এবং অপ্রতিযোগিতামূলক কাজ, যা ভারতে অন্যান্য প্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে ব্যবসায়িক ভাবে প্রতিযোগিতা করার সুযোগই দিচ্ছে না। গুগল অনৈতিকভাবে তার অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোনগুলিতে এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে, যাতে গুগলের পুরো মোবাইল স্যুট অ্যানড্রয়েড ফোনগুলিতে আগে থেকে ইনস্টল করা থাকে এবং সেটিকে চাইলেও ব্যবহারকারী আনইনস্টল করে অন্য কোনও সংস্থার মোবাইল স্যুট ইনস্টল করতে পারবেন না।

অ্যানড্রয়েড একটি ওপেন সোর্স মোবাইল ওপারেটিং সিস্টেম। গুগল এই প্রযুক্তির উদ্ভাবনের জন্য দায়ী ঠিকই, কিন্তু এই প্রযুক্তি গুগলের একার সৃষ্টি নয়। বাইডু, অ্যান্ডি রুবিন, আগোডা, ওপেন হ্যান্ডসেট অ্যালায়েন্স, গেমলফ্টের মতো সংস্থাও এই প্রযুক্তিকে দিনের আলো দেখাতে সহায়তা করেছিল। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরেই বিষয়টা এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে অ্যানড্রয়েড মানেই গুগল এবং গুগলের যাবতীয় যা অ্যাপ্লিকেশন এবং সব ধরনের প্রোগ্রাম তাতে মজুত থাকবে। মোবাইলের মালিকানা আপনার হতে পারে, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনি ক্ষমতাহীন।

সেই কারণেই Section 4, Competition Act অনুযায়ী গুগলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই আইনে স্পষ্টভাবে কোনও সংস্থার অনৈতিক এবং অন্যায্য ব্যবসায়িক কার্যকলাপ, তার বাজারের আধিপত্যকে অন্যায়ভাবে কাজে লাগিয়ে প্রতিযোগিতাহীন করে তোলার প্রবণতাকে রুখে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গুগল শুধুমাত্র মোবাইল স্যুটের ক্ষেত্রেই নিজের প্রভাবকে কাজে লাগায়নি। নিজের অ্যাপ স্টোর এবং গুগল ক্রোম ব্রাউজারকেও একইভাবে ব্যবহারকারীদের ওপর আরোপ করেছে। কোনও ব্যবহারকারীই মোবাইল কেনার পর এই বিষয়গুলি নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামান না। বিশেষ করে পণ্যটি যেহেতু গুগলের। সবাই বিনা প্রশ্নে গুগলের সতর্ক ভাবে আমাদের ওপর আরোপিত পণ্য গুলিকে আপন করে নেন। যেহেতু বাজারে গুগলের ভীষণ সুনাম রয়েছে, সেই কারণেই কেউ এই বিষয়টি ভেবে দেখার প্রয়োজনই মনে করেন না। এই মনস্তত্ত্বকে এবং নিজের সুনামকে এইভাবেই কাজে লাগিয়ে গুগল, দিনের পর দিন। কম্পিটিশন কমিশন অফ ইন্ডিয়া বা CCI এই কারণেই এত টাকার জরিমানা করেছে এই মার্কিন সংস্থাকে। সেই সঙ্গে নির্দেশ দিয়েছে, অতি দ্রুত যাতে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। বিগত দুই বছর ধরে চলতে থাকা এই তদন্তে CCI দেখেছে, কীভাবে গুগল ইন্ডিয়া ইন্টারনেট অ্যাপ্লিকেশনের বেশিরভাগ দিক, যেমন সার্চ ইঞ্জিন, মিউজিক, ব্রাউজার, অ্যাপ লাইব্রেরি এবং বাকি সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেছে। কীভাবে মোবাইল প্রস্তুতকারক এবং অ্যাপ প্রস্তুতকারকদের ওপর একতরফা শর্ত চাপিয়ে দিয়েছে।

গুগলের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুধুমাত্র ভারতের সীমানাতেই সীমাবদ্ধ নেই। অতীতে গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই-কে মার্কিন কংগ্রেসের সামনে হাজিরা দিতে হয়েছে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ নিয়ে ওঠা অভিযোগের কারণে। সম্প্রতি আমেরিকার টেক্সাসে অভিযোগ উঠেছে, গুগল লক্ষ লক্ষ টেক্সাসবাসীর বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করেছে তাদের অনুমোদন ছাড়াই। সেই সঙ্গে গুগলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, জার্মানি এবং জাপানেও।

গুগল না হয় দোষী সাব্যস্ত হলো। কিন্তু CCI-এর কি সেই ক্ষমতা আছে, যাতে গুগলকে দেওয়া শাস্তির কার্যকারিতা নিশ্চিত হয়? সংবিধান কতটা ক্ষমতা দিয়েছে তাদের? সরকারই বা কতটুকু সাহায্য করে এই প্রতিষ্ঠানকে?

জরিমানা ১,৩৩৭.৭৬ কোটি হলেও, CCI এর কতটা অর্থ সত্যিই আদায় করতে পারবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় থেকে যাচ্ছে। ২০১১-'১২ অর্থবর্ষ থেকে ২০১৭-'১৮ অর্থবর্ষের তথ্য যদি দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে, CCI এই ছয় বছরে মোট ১৩,৫২৩ কোটি টাকার জরিমানা ঘোষণা করেছে। কিন্তু আদায় করতে পেরেছে মাত্র ৫৫ কোটি টাকা। যা মোট জরিমানার অঙ্কের মাত্র ০.৪%। তবে এটাও ঠিক, ২০০৩ সালে এর প্রতিষ্ঠার পর খুব ধীরে হলেও CCI নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। ক্রেতার অধিকার রক্ষা এবং বাজারে কোনও সংস্থার একচেটিয়া আধিপত্যের কথা সামনে আনার মতো কাজও খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তা দায়িত্ব নিয়ে পালন করার সর্বতো চেষ্টা করেছে CCI। তার সাফল্য নির্ভর করছে প্রশাসন কতটা তার নির্দেশকে কার্যকর করতে সাহায্য করছে, তার ওপর। সুতরাং প্রশাসনের ভূমিকাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।

More Articles